কাঠখোদাইয়ে অবচেতন মনের অনুসন্ধান

সিগমুন্ড ফ্রয়েডের স্বপ্নতত্ত্বকে উপজীব্য করে ‘কার্ভিং দ্য সেলফ; ইড : ইগো : সুপারইগো’ শীর্ষক একক প্রদর্শনীতে নিজের মনস্তাত্ত্বিক সত্তার বিভিন্ন স্তরের অনুসন্ধান করেছেন শিল্পী আবু আল নঈম। শিল্পীর কাঠখোদাই করা রেখা, রঙের ঝরনাধারায় গড়া ইমেজ, অর্ধ-রূপায়িত অবয়ব ও বিমূর্ত গঠনের মধ্যে দর্শক দেখতে পান দমিত কামনা, চৈতন্যে রূপান্তরিত অবচেতনের ছায়া, আত্মার ছাই হয়ে থাকা এক ব্যক্তিগত ভাষা।

১ / ৫
‘আমি কী?’, কাঠখোদাই, ২০২৩
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব অনুযায়ী স্বপ্ন যেমন ব্যক্তির গোপন বাসনা ও অবদমিত অনুভবের রূপক, তেমনি নঈমের শিল্পকর্ম একেকটি স্বপ্ন-ইমেজ, যেখানে কাঠ খোদাইয়ের প্যাটার্ন ও অন্ধকার থেকে আলোতরঙ্গে ওঠা রঙিন স্তরবিন্যাস দর্শককে নিয়ে যায় অন্তর্দৃষ্টি-নির্ভর এক অভিজ্ঞতার জগতে।

নঈমের কাঠখোদাই মাধ্যমের ছাপচিত্র শুধু কারিগরি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়—এটি এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক অভিযাত্রা, যেখানে শিল্পী তাঁর নিজের অন্তর্জগতে নিমগ্ন হয়ে চেতন, অবচেতন এবং অচেতন স্তরের অন্তঃস্রোতে সাঁতার কেটেছেন। নিছক শিল্পচর্চা নয়, এ যেন আত্মানুসন্ধান ও আত্মপ্রকাশের এক বৌদ্ধিক তপস্যাও।

২ / ৫
‘স্ব-প্রকৃতি’, কাঠখোদাই, ২০২৩
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

তাঁর কাজে অনুপস্থিত এক্সটারনাল থিয়েটার, নেই অতিরিক্ত গ্ল্যামার বা কুশলী ফর্মের প্রদর্শন। তিনি বরং শিল্পকে এক ব্যক্তিগত অন্বেষণের ক্ষেত্র হিসেবে দেখেছেন। নিখুঁত কারিগরি অনুশীলনে আটকে না থেকে নঈম মনস্তাত্ত্বিক গহিনে প্রবেশ করেছেন। ‘ডার্ক টু লাইট’ প্রক্রিয়ায় তার কাঠের লেয়ার গঠন একদিকে যেমন আত্মা থেকে বস্তুজগতে আসার দার্শনিক ইঙ্গিত বহন করে, তেমনি বহুমাত্রিক ইম্প্রেশন তৈরির মাধ্যমে একেকটি প্রিন্টকে করে তোলে ভাবনা ও চেতনার জৈব গাঁথুনি। আবার কাঠ খোদাইয়ের প্রতিটি ধাপ, প্লেট, কাটার পরিত্যক্ত টুকরোগুলো সাজিয়ে তৈরি করেছেন ইনস্টলেশনধর্মী শৈল্পিক দলিল ‘আত্মার ছাই’। যেখানে শিল্পপ্রক্রিয়ার অবশিষ্ট পদার্থ দিয়েই তৈরি হয়েছে আরেকটি শিল্পকর্ম।

৩ / ৫
‘ভাঙা গাছের গুঁড়ি’, কাঠখোদাই, ২০২৩
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

প্লেটোর মতে, প্রকৃত শিল্প সৃষ্টির মুহূর্তে শিল্পী যেন কোনো ঐশ্বরিক উন্মাদনায় চালিত হন, এবং সেই উন্মাদনাই তাঁকে নিয়ে যায় কল্পনার অপার উচ্চতায়। নঈম সেই পথেরই এক ধ্যানী পথিক। ‘অন্বেষণ’, ‘আমি কী?’, ‘ক্ষয়’, ‘স্থানচ্যুতি’, ‘মনের আশা’—এইসব চিত্র-শিরোনাম নিছক ভাবপ্রকাশ নয়, বরং একেকটি আত্মজিজ্ঞাসারও অনুবাদ। ‘ভাঙা গাছের গুঁড়ি’ চিত্রে যেমন দেখা যায় ক্ষয়ের নিঃসঙ্গ সৌন্দর্য, আবার ‘খুলি’ বা ‘আত্মার ছাই’-এ আছে মৃত্যু ও অস্তিত্বের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস। তাঁর কাজে সমবিবাদী রঙের জটিল বিন্যাস নেই, নেই আলোকচিত্রের কায়দা। রঙের ঝরনাধারায় গড়ে ওঠা চিত্ররূপকে মনে হয় যেন সমুদ্রপৃষ্ঠের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া কোনো পাখির চোখে দেখা বিমূর্ত মানচিত্র।

৪ / ৫
‘খুলি’, কাঠখোদাই, ২০২৪
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

শিল্পী আবু আল নঈম ফ্রয়েড ও প্লেটোর চিন্তাধারাকে একত্রে ধারণ করে পূর্ব ও পশ্চিমের সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্মিলিত করে গড়ে তুলেছেন এক অনন্য শিল্পবীক্ষণ। যেখানে কাঠ খোদাইয়ের ছায়াতলে ফুটে উঠেছে শিল্পীর নির্জন আত্ম-অন্বেষণের অভিজ্ঞান।

৫ / ৫
‘অন্বেষণ’, কাঠখোদাই, ২০২৩
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপচিত্র বিভাগ থেকে ‘শিল্পগুরু সফিউদ্দিন আহমেদ পুরস্কার’ প্রাপ্তির অংশ হিসেবে সফিউদ্দিন শিল্পালয়ে গত ২৫ জুলাই শুরু হওয়া প্রদর্শনীটি চলবে আগামী ৩০ জুলাই পর্যন্ত।