মিনালের শিল্পসংগ্রহের সাধনা

শিল্পী সমরজিৎ রায় চৌধুরী, ছাপচিত্র, ২০১৭সৌজন্যে: লেখক

একজন ফ্রেম বাঁধাইকারীর হাতে যখন বারবার পড়েছে বাংলাদেশের প্রধান শিল্পীদের কাজ, তখন সেই চোখে জন্ম নিতে বাধ্য এক বিশেষ শিল্পবোধ—এমনই এক শিল্পপ্রেমিক মিনাল মণ্ডল। আর সেই নীরব, নিরলস ভালোবাসার সঞ্চয়েই গড়ে উঠেছে তাঁর সংগ্রহ, যা আজ শুধু ব্যক্তিগত নয়, এক সাংস্কৃতিক দলিল।

দুই বছর আগে গ্যালারি শিল্পাঙ্গনের প্রদর্শনীর পর ‘দ্য ইলিউশন’ গ্যালারিতে প্রদর্শিত হচ্ছে ‘মিনালের সংগ্রহে-২’ শিরোনামের চিত্রপ্রদর্শনী। দেশের খ্যাতনামা নবীন-প্রবীণ ৭৫ শিল্পীর চিত্রকর্মে সাজানো এই প্রদর্শনী নিছকই একটি ব্যক্তিগত সংগ্রহ প্রদর্শন নয়, বরং এটি এক ধরনের ইতিহাস পাঠ, এক যুগসঞ্চিত রুচির প্রকাশ।

শিল্পী শহিদ কবির, ‘শিরোনামহীন’, জলরং, ২০২৫
সৌজন্যে: লেখক

এখানে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, আবদুশ শাকুর শাহ, রফিকুন নবী, শাহাবুদ্দিন আহমেদ, শিশির ভট্টাচার্য্য, খালিদ মাহমুদ মিঠুর রেখার নান্দনিকতা যেমন রয়েছে, তেমনি রঙের মাধুর্য রয়েছে শিল্পী বীরেন সোম, কনকচাঁপা চাকমা, নাজমা আক্তার, কুন্তল বাড়ৈসহ অনেকের কাজে। শুধু কি রেখা আর রং? বিষয়ের বিস্তার, ফর্মের গাঁথুনি, পরিশ্রম ও যত্নের ছাপ রয়েছে প্রায় প্রতিটি কাজে। উদাহরণ হিসেবে সমরজিৎ রায় চৌধুরীর চিত্রের দিকে তাকালেই বোঝা যায় এবং এসব ছবি থেকে চোখ সরানো দায়। অর্থাৎ ছবির গল্প, রূপ ও নির্মাণকৌশল এমনই টান সৃষ্টি করে যে মনের অজান্তে নিঃশব্দ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ভাবনায় ডুবিয়ে রাখে মুছলিম মিয়ার ছাপচিত্রে নারীর মুখাবয়বে পাখির নকশা-চিত্রে নিপুণ আলংকারিকতার ভেতরে রয়েছে স্বভাবের গভীর রূপান্তর। এমন কম্পোজিশন ও থিমে যে শিল্প-দর্শন প্রকাশ পায়, তা নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী।

শিল্পী কনকচাঁপা চাকমা, ‘শিরোনামহীন‘, অ্যাক্রেলিক, ২০২৫
সৌজন্যে: লেখক

মনিরুল ইসলামের বিমূর্ত কল্পবিশ্বের পাশে দেখা গেছে শহিদ কবিরের সৌন্দর্যচর্চার অবয়ব, যেখানে নারীর বসন ও ভঙ্গিমায় শুদ্ধতা–গাম্ভীর্যের একরৈখিক ছন্দ।

এমনকি নবীনদের মধ্য থেকেও এমন কিছু শিল্পকর্ম বেছে নেওয়া হয়েছে, যা চিত্রভাষার অভিনবতা ও বিশুদ্ধতা তুলে ধরে। সর্বোপরি বলা যায়, অধিকাংশ ছবিতে রয়েছে বিস্ময়কর রসবোধ।

শিল্পী মুছলিম মিয়া, ‘শিরোনামহীন’, ছাপচিত্র, ১৮৯৮
সৌজন্যে: লেখক

মিনাল নিজে শিল্পী না হলেও শিল্পচর্চার আঙিনায় তাঁর অবস্থান একধরনের ‘দাইমা’র মতো। সন্তান যখন জন্ম নেয়, তখন দাইমার হাতে পড়ে তার প্রথম পরিচর্যা—একটু গুছিয়ে, পরিপাটি করে সে তুলে দেয় সন্তানের অভিভাবকের হাতে। তেমনি শিল্পীরা যখন চিত্র আঁকে, ফ্রেমারের কাজ তখন সেটিকে এমনভাবে উপস্থাপন করা, যাতে দর্শকের চোখে ছবিটি তার যথাযথ ভাবসম্প্রসারণে পৌঁছায়।

শিল্পী কারু তিতাস, ‘শিরোনামহীন’, অ্যাক্রেলিক, ২০১৯
সৌজন্যে: লেখক

মিনাল বাঁধাই কাজের সূত্রে কৈশোর থেকে বছরের পর বছর এ দেশের অসংখ্য শিল্পীর কাজগুলোকে স্পর্শ করেছেন, ছেনে দেখেছেন, শিল্পীদের স্টুডিওতে গিয়েছেন, করণকৌশল জেনেছেন। ফলে তাঁর মধ্যে তৈরি হয়েছে শিল্পের প্রতি আন্তরিক টান ও পরিপক্ব শিল্পবোধ।

শিল্পী আহমেদ নাজির, ‘শিরোনামহীন’, অ্যাক্রেলিক, ২০০৬
সৌজন্যে: লেখক

এই শিল্পবোধের প্রমাণ তাঁর নিজের আঁকা একটি বিমূর্ত চিত্রকর্ম, যেখানে রঙের স্তরে স্তরে গঠিত হয়েছে টেক্সচারনির্ভর এক অনুভূতির পরিসর। এটি নিছকই সৌখিন চিত্রাঙ্কন নয়, বরং একজন দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষকের স্পর্শ ও বোধের সংকলন। প্রদর্শনীতে আলোকচিত্র অনুকরণভিত্তিক বাস্তবতার ছবি নেই বললেই চলে; আছে প্রজ্ঞাপুষ্ট বাছাই, সুরুচিপূর্ণ বৈচিত্র্য। ফলে মিনালের সংগ্রহের শিল্পমানই শুধু নয়, একধরনের অন্তর্লোকপ্রবণ বাছাইদৃষ্টি স্পষ্ট।

শিল্পী মিনাল মণ্ডল, ‘শিরোনামহীন’, মিশ্র মাধ্যম, ২০১১
সৌজন্যে: লেখক

এই প্রদর্শনী মূলত শিল্পের প্রতি নীরব ভালোবাসা, দীর্ঘদিনের সংগ্রহ-সাধনা ও শিল্পের প্রতি অন্তর্লীন অনুভবের দৃষ্টান্ত, যা বাংলাদেশের সংগ্রাহক সংস্কৃতিতে উজ্জ্বল সংযোজন হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এর মধ্যে পাওয়া যাবে বাংলাদেশের চিত্রকলার গত তিন দশকের ভিজ্যুয়াল ভাষার একটি সংক্ষিপ্ত অভিধান।

প্রদর্শনীটি গ্যালারি দ্য ইলিউশনে দর্শকদের জন্য ১৩ জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত খোলা থাকবে।