আফজাল হোসেনের অন্য ভুবন

গ্রাফিকস: প্রথম আলোপ্রতিকৃৃতি: মাসুক হেলাল

১৯৭৮ সাল। আমি সদ্যই ঢাকায় এসেছি। রাতে ‘খেলাঘর’ অফিসে ঘুমাই। এই শহরে কাউকেই প্রায় চিনি না। ইত্তেফাকের আর্টিস্ট আইনুল হক মুন্না ভাই আমাদের কুমিল্লার ছেলে, এটাই শুধু জানি। একদিন ইত্তেফাক-এ গেলাম তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। মুন্না ভাই তখন এক স্মার্ট তরুণের সঙ্গে কথা বলছিলেন। সেই তরুণ ছিলেন ইমদাদুল হক মিলন। মুন্না ভাই তাঁর সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এর পর থেকে মাঝেমধ্যে ইত্তেফাকে গেলে ‘রোববার’ অফিসে তাঁর সঙ্গে দেখা করি। মুন্না ভাই ছিলেন চারুকলা কলেজে আফজাল ভাইয়ের সহপাঠী। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন চারুকলা কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস। ভিপি ছিলেন শিল্পী শাহাবুদ্দিন। সেই সংসদে আফজাল হোসেন ছিলেন কালচারাল সেক্রেটারি। আমি যেদিন মিলন ভাইয়ের সঙ্গে ইত্তেফাক অফিসে যাই, তখন সেখানে সাপ্তাহিক রোববার প্রকাশের প্রস্তুতি চলছিল। কাজ করছিলেন কবি রফিক আজাদ, কবি অসীম সাহা, শিল্পী কাজী হাসান হাবিব, কবি আবু করিম, বিজ্ঞান লেখক নাদিরা মজুমদার প্রমুখ। 

একদিন মিলন ভাই বললেন, ‘যাবে আমার সঙ্গে সাগরের দোকান খাবার দাবারে? ওখানে গেলে আফজালের সঙ্গে দেখা হতে পারে।’ 

মিলন ভাই ঢাকা স্টেডিয়ামের সামনে ‘খাবার দাবার’ রেস্তোরাঁয় আমাকে নিয়ে গেলেন। গিয়ে দেখি, সাগর ভাই মানে ফরিদুর রেজা সাগর সামনে দাঁড়িয়ে। দোকান তদারকের কাজ করছেন শাইখ সিরাজ। মিলন ভাই বললেন, ‘সাগর, ওর নাম মাসুক, কুমিল্লা থেকে এসেছে, চারুকলায় ভর্তি হবে।’ 

সাগর ভাই বললেন, ‘আফজাল আসবে।’

 সাগর ভাইয়ের কথা শেষ হতে না হতেই দোকানের সামনে আফজাল হোসেন রিকশা থেকে নামলেন। তাঁদের মধ্যে প্রাথমিক কিছু কথাবার্তা হলো। তারপর মিলন ভাই তাঁর সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতেই আমার দিকে তাকিয়ে আফজাল হোসেন বললেন, ‘তোমার কোনো কাজ আছে? না থাকলে চলো।’

তাঁর কথায় সায় দিয়ে রিকশায় উঠতেই শুরু হলো টুকটাক কথাবার্তা। জানতে চাইলেন কোথায় থাকি, কী করি, ইত্যাদি। মতিঝিলে অবজারভার ভবনের সামনে এসে থেমে গেল আমাদের রিকশা। তিনতলায় ‘কিশোর বাংলা’ অফিস। আফজাল হোসেন সিঁড়ি ভেঙে সোজা সেখানে নিয়ে গেলেন আমাকে। সাময়িকীটির সম্পাদক ছড়াকার রফিকুল হক দাদুভাই। তিনি বসেন ছোট একটা রুমে। গিয়েই দেখলাম, ভীষণ মনোযোগসহকারে পেপার ওয়েট দিয়ে টুকটুক করে পিটিয়ে একটা পিন সোজা করছেন। কিশোর বাংলা ছিল কিশোর সংগঠন ‘চাঁদের হাট’-এর মুখপত্র। আফজাল ভাইসহ ওই পত্রিকার সঙ্গে সংযুক্ত মানুষদের বেশির ভাগই ছিলেন চাঁদের হাটের কর্মী। সাইফুল আলম (বর্তমানে যুগান্তরের সম্পাদক) কতগুলো গল্প-কবিতার ছবি আঁকতে দিলেন আফজাল হোসেনকে। তিনি ছোট একটা টেবিলে বসে আঁকতে শুরু করলেন। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে দেখছি। ট্রেসিং পেপারে চায়নিজ ইঙ্ক দিয়ে ইলাস্ট্রেশন করছেন তিনি। এভাবে দুই ঘণ্টার মতো কাজ করলেন। অফিস থেকে বেরিয়ে ফকিরাপুল বাদশা হোটেলে রুটি আর কাবাব খাওয়ালেন। আবার আমাকে নিয়ে রিকশায় চড়ে মগবাজারে আলতাফ মাহমুদ সংগীত বিদ্যালয়ের সামনে এসে থামলেন। 

রাস্তায় আর কোনো কথা হলো না আমাদের মধ্যে। সেখানে তখন ঢাকা থিয়েটারের নাটকের মহড়া চলছিল। সেলিম আল দীনের নাটক ‘শকুন্তলা’। সেদিন সেখানেই প্রথম দেখি সুবর্ণা মুস্তাফা, হুমায়ুন ফরীদি, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, রাইসুল ইসলাম আসাদ, সেলিম আল দীন ও শিমূল ইউসুফকে। ছোটখাটো ও লম্বা চুলের হুমায়ুন ফরীদিকে সেদিনই আমি প্রথম দেখি। তিনি যখন ‘আমি নীল তক্ষক, একটুখানি ছুঁয়ে দিলে বেণুবন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে’ সংলাপটি বলে ঠা-ঠা করে হেসে উঠলেন, তখন তাঁর গলার স্বর শুনে আমি রীতিমতো চমকে উঠেছিলাম। আমাকে দেখিয়ে লম্বামতো এক লোককে আফজাল হোসেন বললেন, ‘বাচ্চু ভাই, ওর নাম মাসুক। ও কুমিল্লা থেকে এসেছে। চারুকলায় ভর্তি হবে।’ লম্বা লোকটি হলেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু। 

বাচ্চু ভাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার কাছে অনেক কিছু জানতে চাইলেন। তারপর একজনকে ডেকে বললেন, ‘ফারুক, ওর ভর্তির ব্যাপারটা তুমি দেখবে।’

সেখান থেকে সন্ধ্যার দিকে আফজাল ভাই আমাকে নিয়ে গেলেন বিটিভিতে। সেখানে তাঁর নাটকের রেকর্ডিং আছে। হুমায়ূন আহমেদের গল্প ‘নির্বাসন’-এর নাট্যরূপ দিয়েছেন তিনি। মূল চরিত্রটা করছিলেন হুমায়ুন ফরীদি। ‘আনিস’ নামের সেই চরিত্র এক যুদ্ধাহত পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার। ফরীদি তখন টিভিতে নতুন। তাঁকে একটু-আধটু দেখিয়ে দিচ্ছিলেন আফজাল হোসেন। নায়িকা ছিলেন শিমূল ইউসুফ। নাটকটির প্রযোজক ছিলেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু। এটাই আফজাল হোসেনের সঙ্গে আমার প্রথম দেখার স্মৃতি। 

১৯৮০ সাল। আফজাল হোসেন তখনো কিশোর বাংলা পত্রিকার আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করছেন। পাশাপাশি মঞ্চেও সক্রিয়। ঢাকা থিয়েটারের ‘কীত্তনখোলা’ নাটকে যাত্রাপালার নায়ক ‘রবিদা’ চরিত্রে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করছেন। 

চিত্রনায়িকা ববিতার সঙ্গে আফজাল হোসেন অভিনীত ‘নতুন বৌ’ চলচ্চিত্রটি কিছুদিন আগে মুক্তি পেয়েছে। ওদিকে বিটিভিরও দর্শকপ্রিয় নায়ক তিনি। পিয়ারসনস বিজ্ঞাপন নির্মাণ করে বিজ্ঞাপনের জগতে একটি নতুন ধারার সূচনা করেছেন আফজাল হোসেন। 

প্রচ্ছদ ও অলংকরণশিল্পের স্বর্ণযুগ সেটা। দেশবরেণ্য শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, রফিকুন নবী, হাশেম খান, সৈয়দ এনায়েত হোসেন ও কালাম মাহমুদের মতো শিল্পীরা প্রচ্ছদ ও অলংকরণের জগৎকে উজ্জ্বল করে রেখেছেন। তাঁদের পাশাপাশি তরুণ আফজাল হোসেন নিজের একটি স্টাইলে এঁকে যাচ্ছেন বইয়ের প্রচ্ছদ ও ছড়া-কবিতার ইলাস্ট্রেশন।

পাশাপাশি বইয়ের প্রচ্ছদ ও শিশুতোষ বইয়ের ইলাস্ট্রেশনও করছেন সমানতালে। প্রচ্ছদ ও অলংকরণশিল্পের স্বর্ণযুগ সেটা। দেশবরেণ্য শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, রফিকুন নবী, হাশেম খান, সৈয়দ এনায়েত হোসেন ও কালাম মাহমুদের মতো শিল্পীরা প্রচ্ছদ ও অলংকরণের জগৎকে উজ্জ্বল করে রেখেছেন। তাঁদের পাশাপাশি তরুণ আফজাল হোসেন নিজের একটি স্টাইলে এঁকে যাচ্ছেন বইয়ের প্রচ্ছদ ও ছড়া-কবিতার ইলাস্ট্রেশন। আলী ইমামের ‘চারজন’, আবু হাসান শাহরিয়ারের ছড়ার বই ‘পায়ের নূপুর’ ও কবি সিকদার আমিনুল হকের কবিতাগ্রন্থ ‘পারাবত এই প্রাচীরের শেষ কবিতা’ প্রভৃতি বইয়ের প্রচ্ছদ, ইলাস্ট্রেশন ইত্যাদি কাজের মধ্য দিয়ে নিজের শৈল্পিক নৈপুণ্যের পরিচয়কে ক্রমে উজ্জ্বল করে চলেছেন তিনি। সেই সঙ্গে চলছে তাঁর লেখালেখি অর্থাৎ সাহিত্যচর্চা। এ সময় তিনি কিছু বইয়ের প্রচ্ছদ করেন, যা অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যেমন রাবেয়া খাতুনের উপন্যাস ‘বায়ান্ন গলির এক গলি’, সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাস ‘বারো দিনের শিশু’ এবং ইমদাদুল হক মিলনের ‘নায়ক’। তার আগে জনপ্রিয় নায়ক আফজালের এই গুণের কথা সবাই হয়তো জানতেন না। এর কিছুকাল পর প্রকাশিত হয় তাঁর নিজের উপন্যাস ‘বিরহকাল’, গল্পের বই ‘কানামাছি’ ও নাটক ‘পারলে না রুমকি’।

আফজাল ভাই তখন মতিঝিল কলোনিতে দীনু বিল্লাহর ফ্ল্যাটে থাকেন। মতিঝিলেই ‘অবজারভার’ ভবনে তাঁর অফিস। অবজারভার ভবন থেকেই তখন বিখ্যাত সিনেমা পত্রিকা ‘চিত্রালী’ বের হতো। সম্পাদক ছিলেন আহম্মদ জামান চৌধুরী। ছোট্ট একটি রুমে বসে গালে হাত দিয়ে তিনি পান চিবুতে চিবুতে নিজের লেখালেখি ও সম্পাদনার কাজ করতেন। অন্য টেবিলে বসে লিখতেন প্রতিবেদক আখতারুজ্জামান, হীরেন দে, মাহফুজ সিদ্দিকী, নরেশ ভূঞা ও আহাদ খান। ফটোগ্রাফার বেলাল কাঁধে ক্যামেরা ঝুলিয়ে টেবিলে টেবিলে এসে হাসাহাসি করতেন। নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেন তিনি। চিত্রালীর আর্টিস্ট ছিলেন সৈয়দ এনায়েত হোসেন। চিত্রালীকে সুন্দর করে সাজিয়ে তোলায় তাঁরও ভূমিকা ছিল। সহজ-সরল মানুষ, কিন্তু অসাধারণ ছিল তাঁর আঁকার হাত। ইলাস্ট্রেশনে যেন জাদু দেখাতেন।

শিল্পী আফজাল হোসেনের আঁকা কয়েকটি বইয়ের প্রচ্ছদ
সৌজন্যে: লেখক

কিশোর বাংলায় ঢোকার পথে বাঁ পাশেই ছিল অবজারভার পত্রিকার অফিস। কিশোর বাংলা অফিসে ঢুকতে গেলেই দেখতাম গল্পকার ফিউরি খন্দকার বড় একটা গোল টেবিলে বসে কী যেন লিখছেন। তাঁর চারপাশে বসা অন্যরাও তাঁরই মতো মাথা নিচু করে লিখছেন। প্রায়ই এই দৃশ্য দেখতাম। পরে জেনেছি যে তাঁরা নিউজ তৈরি (সাবিং) করতেন। কিশোর বাংলার অফিসে ঢুকেই আফজাল ভাই ছোট একটা টেবিলে গিয়ে বসতেন। তারপর গভীর মনোযোগ দিয়ে আঁকার কাজ করতেন। এখানে কাজ করার সময়ই দু-একটি সিনেমায় নায়কের চরিত্রেও অভিনয় করেন তিনি। তবে আমার মনে হতো, ঢাকাই চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে আফজাল ভাই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন না। মঞ্চ আর টিভিতেই তিনি অভিনয় করতেন বেশি। তাঁকে আমি কখনো ক্রিম-পাউডার মাখতে দেখিনি। দেখিনি নাটকের সংলাপ মুখস্থ করতেও। ঢাকা থিয়েটারের ‘হাত হদাই’ নাটকের সেট করতে দেখেছি তাঁকে। কী নিষ্ঠার সঙ্গে যে কাজ করতেন তিনি! কাজের ব্যাপারে ছিলেন খুবই খুঁতখুঁতে। বারবার সেট করতেন আর ভাঙতেন। 

আফজাল ভাই খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে ছিলেন বেশ উদাসীন। আমি আর আফজাল ভাই কত দিন যে সেগুনবাগিচার চিটাগাং হোটেলে নদীর পাঙাশ মাছ আর গরুর মাংস দিয়ে ভাত খেয়েছি! নতুন কোনো কিছু করার ভাবনা মাথায় ঢুকলেই তিনি আমাকে রিকশায় চাপিয়ে ঢাকা শহর চক্কর দিতেন। আবার কখনো রিকশা থেকে নেমে থান কাপড়ের দোকানে, দরজি অথবা বইয়ের দোকানে ঢুকতেন। এ সময় চুপচাপ, অনেকটা যেন ঘোরের মধ্যে থাকতেন তিনি। আবার এসে কাজে বসতেন। 

একটা সময় বন্ধুবান্ধব ছাড়া থাকতেই পারতেন না আফজাল ভাই। খেতে, কাজ করতে বন্ধুদের সঙ্গ তাঁর লাগতই। বন্ধুদের নিয়ে পত্রিকা বের করেছেন। নাম ‘আকর্ষণ’। ‘দোয়েল’ নামে অ্যাড ফার্ম করেছিলেন। অফিস ছিল বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে, ফরিদুর রেজা সাগর ও শাইখ সিরাজের ‘খাবার দাবার’ দোকানের চতুর্থ তলায়। একসময় ‘দোয়েল’ থেকে বেরিয়ে সানাউল আরেফিন ও আফজাল ভাই শুরু করলেন ‘মাত্রা’ নামে নতুন অ্যাড ফার্ম। সালটা ১৯৮৪।

মাত্রা চালু করার পর কিছু বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আফজাল ভাইয়ের দূরত্ব তৈরি হয়। ফলে সারা দিনই তিনি মাত্রার কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন। রাতে সানা ভাই (সানাউল আরেফিন) পুরান ঢাকার কায়েতটুলীতে চলে যেতেন। সেখানে তাঁর ভাইয়ের ভগ্নিপতি শরফুদ্দীন আহমেদের বাসা। বিজয়নগরে যে দেড় কামরার ছোট্ট একটা বাড়িতে ছিল মাত্রার অফিস, সেই বাড়িও ছিল শরফুদ্দীন আহমেদের। তাঁর একটা চায়নিজ রেস্টুরেন্টও ছিল। তার আগে ‘নান্দনিক’ নামে একটা বড় মাপের বিজ্ঞাপনী সংস্থা ছিল শরফুদ্দীন আহমেদের। সেই সংস্থায় কাজ করেছেন শিল্পী হাশেম খান, কবি ফজল শাহাবুদ্দীন, রাইসুল ইসলাম আসাদ ও দিলশাদ খানম। ওখানকারই একটা রুম ও একটুখানি বারান্দা নিয়ে শুরু হয় ‘মাত্রা’র কাজ। 

মাত্রায়ও আমি আফজাল ভাইয়ের সঙ্গে ছিলাম। সে সময় তাঁকে অনেক কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। মাত্রায় তাঁর সঙ্গে আমি কয়েক বছর যুক্ত ছিলাম। সারা দিন কাজ করে রাতে আফজাল ভাই, সানা ভাই আর আমি এক রিকশায় করে কায়েতটুলীতে যাই, রাতে সেখানে থাকি। ভিসিআরে ছবি দেখি কখনো কখনো। সানা ভাইয়ের বোন, ভাগনি কাঁকন ও কান্তা, ভাগনে অপুর সঙ্গে একটা অসাধারণ পারিবারিক পরিবেশে আমরা সময় কাটাই। সানা ভাইয়ের ছোট ভাই পনির ও ভাগনে অপু বিয়েসহ নানা রকম অনুষ্ঠানের ভিডিও করেন। আমি তাঁদের সে ভিডিও এডিটিংয়ের কাজ দেখি। এরশাদের জমানা তখন। বিশ্ববিদ্যালয় আট মাস ধরে বন্ধ। আফজাল ভাই রাত ১০টা-সাড়ে ১০টা নাগাদ ঘুমিয়ে পড়েন। ওঠেন খুব সকালে। বুবুর বাসায় গোসল ও নাশতা সেরে সকাল আটটার মধ্যে আমরা ‘মাত্রা’য় চলে আসি। তারপর কাজে বসে পড়ি। আফজাল ভাই আর আমি এক টেবিলে বসেই কাজ করতাম। তখন দেখেছি, কী নিষ্ঠা ও মনোযোগ দিয়ে আফজাল ভাই কাজ করতেন। প্রতিদিনই নতুন নতুন ডিজাইন করছেন। আগের দিন যা করতেন, পরদিন তার সব বাতিল করে আবার নতুন ধরনের ডিজাইন করতেন। 

মাত্র দুটো চেয়ার আর দুটো টেবিল নিয়ে ছিল মাত্রার অফিস। একটা টেবিলে বসতেন সানা ভাই, অন্যটিতে বসতেন আফজাল ভাই ও আমি। সানা ভাইয়ের অ্যাড ফার্মে কাজ করার কিছু পূর্ব-অভিজ্ঞতা ছিল। কিছুদিন নান্দনিকে কাজ করেছেন তিনি। সেসব কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘রেকসপরন’ নামে আয়রন সিরাপের লেবেল তৈরি। এটির ডিজাইন ও ছাপার মাধ্যমেই শুরু হয় ‘মাত্রা’র কাজ। এক ঢাকাইয়া ভদ্রলোক ছিলেন প্রোডাক্টটির মালিক। এর পরপরই ‘গোল্ডেন পাফ’ নামের একটি খইয়ের প্যাকেটের ডিজাইন তৈরি করাও প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘মাত্রা’কে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে।

বিকেলে আফজাল ভাই ঢাকা থিয়েটারর ‘কেরামত মঙ্গল’ নাটকের মহড়ায় যেতেন। নাটকটি তখন সেলিম আল দীনের রচনা আর নাসির উদ্দীন ইউসুফের পরিচালনায় মঞ্চস্থ হচ্ছিল। জামিল আহমেদের শিল্পনির্দেশনায় সে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ! ‘কেরামত মঙ্গল’ নাটকের পোস্টার ডিজাইন করবেন আফজাল ভাই। এই নাটকে তিনি অভিনয় করছেন ‘চশমা ডাকাত’-এর ভূমিকায়। মাত্রায় বসেই ‘কেরামত মঙ্গল’ নাটকের পোস্টার ডিজাইনের কাজ শুরু হলো। সানাউল আরেফিন হলেন মডেল। দুহাতে ভ্রূণ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, এমন ভঙ্গিমায় তাঁকে রেখে আফজাল ভাই ড্রয়িং করে চলেন। আঁকেন, আবার বাতিল করে দেন। এভাবে প্রতিদিনই সানা ভাই নতুন করে দুহাত তুলে দাঁড়িয়ে থাকেন। আর আফজাল ভাই এঁকে চলেন। 

সানা ভাই একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘এটা কবে শেষ হবে রে, জানিস?’

 যা-ই হোক, শেষে আফজাল ভাইয়ের হাতেই অসাধারণ একটা পোস্টার হলো ‘কেরামত মঙ্গল’ নাটকের। এভাবেই ‘মাত্রা’র এগিয়ে চলা।

 আফজাল ভাই বিটিভির নাটকে অভিনয় করছেন। পাশাপাশি পরিচালক উদয়ন চৌধুরীর সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত ছবি ‘ডাক দিয়ে যাই’তেও অভিনয় করছেন। মাঝেমধ্যে শুটিং হয়। আবার বন্ধ থাকে। এ সময় মাত্রায় যোগ দিয়েছেন খন্দকার আলমগীর। আলমগীর ভাই ব্যঙ্গ করে ছবিটির নাম দিয়েছিলেন ‘ডাক দিয়ে নাই’! এমন নাম দিয়েছিলেন তিনি ছবিটার শুটিং নিয়মিত হতো না বলে। এমনও হয়েছে যে একই দিনে আফজাল ভাই সকালে সিনেমার শুটিং করেছেন, সন্ধ্যায় তাঁর নিজের দল ঢাকা থিয়েটারের নাটকে অভিনয় করে রাতে প্রায় দৌড়ে টেলিভিশনে গিয়ে রেকর্ডিং করেছেন। একদিন সকালে আফজাল ভাই আর আমি রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছি, রিকশা পাওয়া যাচ্ছিল না। রামপুরায় বিটিভি স্টেশনে যাব। আফজাল ভাই বললেন, ‘এতগুলো মিডিয়ায় কাজ করি, বিদেশে হলে তো আমার হেলিকপ্টার থাকত। আর এখন আমি একটা রিকশাও পাই না।’

হোসেনী দালান রোডের পিয়ারু সরদারের ছেলেরা ডেকোরেটর ও অন্যান্য ব্যবসার পাশাপাশি লোকাল গার্মেন্ট ব্যবসায় আসেন, নাম দেন ‘পিয়ারসনস’। পিয়াসনসের লোগো, স্লোগান, পেপার অ্যাড, মডেল নির্বাচন, তাদের পোশাক ডিজাইনে আফজাল ভাই আনলেন আধুনিকতা। পিয়ারসনসের স্লোগান ছিল এ রকম—‘আজ এবং আগামীকালের পোশাক পিয়ারসনস’। 

পিয়ারসনসের টিভিতে সম্প্রচারিত বিজ্ঞাপনে একটা সাদা ঘোড়া ধীরগতিতে দৌড়ে যায়। শুরু হয় মধুর কিছু কণ্ঠের হামিং। সঙ্গে মিউজিক বাজতে শুরু করলেই শিশুরা টিভির সামনে দৌড়ে চলে আসত।

 এভাবে পেপার অ্যাডেও আফজাল ভাই আনলেন নতুনত্ব। বিটিভির বিজ্ঞাপনে আনলেন আধুনিকতা। শুধু তা-ই নয়, এ দেশের বিজ্ঞাপন চিত্র নির্মাণের পূর্বের ধারা থেকে বেরিয়ে এসে পুরো কাজটিই তিনি করেন দেশীয় কারিগরি সহায়তা নিয়ে।

 ঢাকায় পা রেখেই যে আফজাল ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয়ের সৌভাগ্য হয়েছিল, তারপর একটানা অনেকগুলো বছর পত্রিকা ও বিজ্ঞাপনী সংস্থার অফিসে তাঁর সাহচর্যে থেকে ডিজাইন ও ইলাস্ট্রেশনের কাজ এবং ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সেট নির্মাণের কাজ করার অভিজ্ঞতা—এসবের কিছুই হয়তো সম্ভব হতো না তাঁর সঙ্গে ওই প্রথম পরিচয়ের সুযোগটা না হলে। মুখে কোনো রকম উপদেশ বা পরামর্শ না দিয়েও এভাবে তিনি আমার গুরুর ভূমিকা পালন করে গেছেন।