জয়নুলের স্মৃতিতে নজরুল
বাংলার শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনের দুই দিকপাল—বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। প্রতিবছর ২৫ মে নজরুলের জন্ম ও ২৮ মে জয়নুলের প্রয়াণ দিবসকে ঘিরে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে থাকে নানা আয়োজন। দৈনিক পত্রিকার শিল্প-সাহিত্য পাতাজুড়েও থাকে তাদের সরব উপস্থিতি। ১৯৬৮ সালের ২৫ মে অধুনালুপ্ত দৈনিক আজাদ–এ তেমনই একটি চোখে পড়ার মতো আয়োজন ছিল।
নজরুল ও জয়নুল দুজনই তখন জীবিত। দৈনিক আজাদ–এ নজরুল জন্মবার্ষিকী সংখ্যায় আ ন ম গোলাম মোস্তফা ‘নজরুলকে যেমন দেখেছি’ শিরোনামে জয়নুল আবেদিন, জসীমউদ্দীন, ডক্টর এনামুল হক ও মনসুর উদ্দিনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন।
আট পৃষ্ঠার সেই ক্রোড়পত্রের পুরোটাই ছিল নজরুলবন্দনা। জয়নুল আবেদিনের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, তিনি ১৯৪৬ সালে নজরুলের দুটি প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন। সেই ড্রইংগুলো করার পেছনে শিল্পীর উদ্দেশ্য এবং অভিজ্ঞতাসহ ছাত্রজীবনে নজরুলকে দেখার অনুভূতি তিনি ব্যক্ত করেছেন। নজরুলকে নিয়ে জয়নুলের সেই স্মৃতিকথা এখানে কিঞ্চিৎ পরিমার্জিত ও বর্তমান বানান রীতিতে উপস্থাপন করা হলো।
জয়নুলের স্মৃতিতে নজরুল
নজরুলজীবনের সঙ্গে জড়িত এমন দুটি ছবি আমার মনে আছে। একটি ১৯৩০-৩১ সালের। তখন আমি স্কুলের ছাত্র; আর একটি ১৯৪৬ সালের। তখনো দেশভাগ হয়নি। একটি ছবিতে নজরুলের মানবদরদী মনের পরিচয় পেয়েছি আমি। আরেকটি আমার ব্যর্থতার ছবি।
হ্যাঁ, সেটি ১৯৩০ কি ৩১ সাল। আমি তখন ময়মনসিংহ স্কুলের ছাত্র। একদিন শোরগোল পড়ল কাজী নজরুল ইসলাম আসছেন। সবাই ছুটলাম স্টেশনে। দলে দলে। সেখানে লোকে লোকারণ্য।
এরপর কবি এলেন। গায়ে গেরুয়া বসন। নিজ চোখে দেখলাম কবিকে। অগণিত মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করল। সাদর অভ্যর্থনা জানানো হলো কবিকে। দেওয়া হলো অসংখ্য মানপত্র। কবি সেখানে গান গাইলেন। এখনো গানটি মনে আছে আমার—‘উঠরে চাষী, জগদ্বাসী ধর কষে লাঙল।’ এরপর তিনি ফিরে গেলেন কলকাতায়।
কলকাতায় তাঁর ঘনিষ্ঠ অনেকে থাকেন এবং আমার সঙ্গেও অন্তরঙ্গ পরিচয় আছে, এমন একজন লোকের কাছে শুনেছিলাম—কবি এসব মানপত্র পেয়ে প্রথমে অভিভূত হয়েছিলেন। তারপর তার মনে প্রশ্ন জেগেছে—মানুষ এসব আমায় কেন দিয়েছে, ভালোবেসে না আবগের উন্মাদনায়। হঠাৎ তিনি উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, মানুষ আমায় ভালোবাসবে কে—আমি তাদের কী দিতে পেরেছি? না না এগুলো আমার পাওনা নয়। এই বলে তিনি মানপত্রগুলো একে একে ভেঙে ফেলেছিলেন।
আরেকবার কবিকে দেখেছি ১৯৪৬ সালে। তখন তিনি শ্যামবাজারে থাকতেন। থাকতেন মানে, তাঁকে রাখা হয়েছিল। আমি একবার ঠিক করলাম, তাঁর শখানেক ছবি আঁকব। বসা ও শোয়া অবস্থায়। তারপর সে ছবিগুলোর সঙ্গে তাঁর কিছু কবিতার পঙ্ক্তি সংকলিত করে নিজেই ছাপব। আর প্রাপ্ত অর্থ সবটাই কবির নামে জমা করার ব্যবস্থা করব। কোনো প্রকাশককে এ দায়িত্ব দেব না। বইয়ের সর্বস্বত্ব থাকবে কবির।
এই ভেবেই গিয়েছিলাম। সেদিন ছিল রোববার। সকাল বেলার দিকে। পাশাপাশি দুটি ঘরে শুয়েছিলেন কবি আর কবিপত্নী। আমি কবির স্ত্রী ও অন্যদের জানালাম, আমি এসেছি—এ অবস্থায় স্কেচ করতে।
কবির স্ত্রী তো খুব খুশি হলেন। কবির শাশুড়ি আড়ালে যাতায়াত করছিলেন। তাঁকেও এ ব্যাপারে তৎপর দেখলাম। কবির এক ছেলে খুব সাহায্য করলেন আমায়, সম্ভবত বড় ছেলেটাই।
প্রথম দিনই শুরু করলাম। কালি, কলম, তুলি কিছুই আনিনি। কাঠ–কয়লা দিয়ে আঁকা শুরু করলাম। ভেবেছিলাম, কবি ভালোভাবে সিটিং দেবেন না; কিন্তু দেখলাম, তা না। তিনি চুপটি করে বসে থাকলেন। মাঝেমধে৵ উঠে চলে যাচ্ছিলেন, আবার এসে বসছিলেন। তখন তিনি লোকজন খুব একটা চেনেন না। মাঝেমধে৵ মুচকি হাসেন ও শব্দ করেন।
এভাবে দুটি ছবি আঁকলাম। ছবির নিচে তার সই দিতে বলায় শিশুর মতো তিনি সই করলেন। বাংলা সন কত, আমরা খোঁজাখুঁজি করছিলাম। দেখলাম, তিনি ঠিকভাবে বাংলা সন লিখে দিয়েছেন।
সেদিন বিদায় নিলাম আগামী দিনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে; কিন্তু কাঠ–কয়লায় আঁকা ছবি আনব কী করে? কবির স্ত্রী অন্য কোনো বাঁধাই করা ছবি ভেঙে দুখানা কাচ এনে দিলেন। আমি সে কাচে ছবি দুখানা নিয়ে এলাম; কিন্তু প্রতিশ্রুতি দিয়ে এলেও এরপর আমি আর যেতে পারিনি। কারণ, তার পরের দিন থেকে ওই এলাকায় শুরু হলো ভীষণ দাঙ্গা। আমি আর ঢুকতেই পারলাম না সে এলাকায়। আমার ইচ্ছা পূরণ হলো না।