জন্মদিনে শ্রদ্ধা
আমার বাবা শিল্পী কামরুল হাসান
শিল্পী কামরুল হাসানের ১০৪তম জন্মদিন আজ। কুড়ি বছর আগে শিল্পীর ৮৪তম জন্মদিনে বাবার স্মৃতিচারণা করেছিলেন শিল্পীকন্যা সুমনা হাসান। দৈনিক প্রথম আলোর তৎকালীন ‘সাহিত্য সাময়িকী’তে ২ ডিসেম্বর ২০০৫ সংখ্যায় লেখাটি প্রথম ছাপা হয়েছিল। সঙ্গে এক দিনের ডায়েরি ও একটি অপ্রকাশিত চিঠি—শিল্পী কামরুল হাসানের জন্মদিন উপলক্ষে নতুন পাঠকের জন্য প্রথমবার অনলাইনে।
তোমাকে দেখি না সেই কত দিন, কত মাস, কত বছর...। ষোলটি বছর কেটে গেছে তারপরও ভুলে যাই—তুমি নেই। ‘নয়ন সমুখে তুমি নাই, নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই।’
২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮ কবিতা উৎসবের সমাপ্তি দিন। সভাপতিত্ব করবে তুমি তা কিন্তু একবারও বলোনি। উত্তরা থেকে সকাল সকাল তোমাকে নিয়ে বেরিয়েছি, লম্বা পথ, তোমাকে টিএসসিতে নামাব। পথে অনেক গল্প, আমাদের উত্তরার লেকের পাড়ে একটি বিশাল বটগাছ ছিল। তুমি দেখিয়ে বললে এবারের পহেলা বৈশাখটা ওই বটগাছের নিচেই করব, এই উত্তরায়। উত্তরায় ছড়িয়ে দেব পহেলা বৈশাখের আমেজ—এ রকম কত কথা। তার ভেতর তোমার শারীরিক সুস্থতার কথাও উঠল। কথা হলো খুব শিগগিরই তোমাকে নিয়ে দেশের বাইরে গিয়ে তোমার হার্টের বাইপাসটা করিয়ে আসব। তুমি এবার খুব সহজেই সম্মতি দিলে, কী জানি কী ভেবে? নিজেই পকেট থেকে হার্টের ওষুধটা বের করে দেখিয়ে বললে, নিয়ে যাচ্ছি সাথে, তবে একদিন আর জিভের নিচে দিতে হয়নি, বেশ সুস্থ বোধ করছি—এ রকম আরও কত কথা। কিন্তু তখন কি ঘুণাক্ষরেও জানতাম ওই কথোপকথনই হবে তোমার সঙ্গে আমার শেষ কথা?
সেদিনই রাতে শেষ হলো কবিতা উৎসব, সাথে সাথে তুমিও হারিয়ে গেলে। আর ফেরোনি বাড়ি। তোমার অপেক্ষায় আমি তো তখন না খেয়ে বসে আছি। তুমি কি দেখেছ দূর থেকে?
বেশ কিছু দিন থেকেই তুমি আমাকে মাঝে মাঝেই ডেকে পাঠাতে। কী এক জরুরি কথা বলার আছে। কিন্তু একদিনের জন্যও তোমার সেই জরুরি কথাটা শেষ পর্যন্ত আমার কাছে বলতে পারোনি। যা তোমাকে প্রতিনিয়ত ব্যথিত করেছে, তোমার ভেতরটাকে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। কারণ তুমি তো কখনো কথার খেলাপ করোনি, সেটাই তোমাকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছিল। তোমার ধারণায় তারা তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী, তুমি তা-ই ভাবতে, শেষ পর্যায়ে তোমার ভুল যখন ভাঙতে শুরু করেছিল, তখনই তুমি চলে গেলে। তোমার মৃত্যুর পর আমি বুঝেছিলাম কী ছিল তোমার সেই অতি জরুরি কথা। যে জিনিস তুমি আমাকে দিয়েছিলে, তা তুমি আমার জন্য রক্ষা করতে না পারার পরাজয় তোমাকে এভাবে শেষ করে দিচ্ছিল তা তো তখন আমি জানতাম না। এখন বুঝি—যখন সব শেষ হয়ে গেছে। যাকগে সেসব কথা। তোমার রেখে যাওয়া অজস্র কাজ, সেগুলো ঠিকভাবে সামাল দিতে, সেগুলো নেড়েচেড়ে গোছাতে গোছাতেই কেটে কেল ১৬টি বছর।
তোমার ব্রাশের স্ট্রোক, রেখার গতিময়তার সঙ্গে আমি কার তুলনা করব? তোমার কাজের গতিসীমা কী ছিল। এখানে তোমার গতির সঙ্গে তুলনা করা যায় পৃথিবীর ক্রিকেটের দ্রুততম বোলার শোয়েব আখতারের বোলিংয়ের সঙ্গে কিংবা সেতারের তারের ওপর পণ্ডিত রবিশঙ্করের গতিময় অঙ্গুলি সঞ্চালনের সঙ্গে বা তবলার জাদুকর ওস্তাদ জাকির হোসেনের দ্রুতলয় তবলার বোলের সঙ্গে। কার সঙ্গে তুলনা করব? না, তুলনা আমি করব না। তোমার তুলির আঁচড়ে তোমার গতির সমন্বয়ের সঙ্গে মূল বিষয়বস্তু ফুটিয়ে তুলবার ক্ষমতার ব্যাপারটি বলে বোঝানোর মতো নয়। যারা দেখেননি তাদের বোঝানো যাবে না। আমি যখন তোমার কাজগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করি, তখন আমিও অবাক বিস্ময়ে ভাবি হাতের ওপর কতটা নিয়ন্ত্রণ থাকলে তবেই এ ধরনের কাজ করা যায়। তোমার দুটো হাতকে আমি কখনো বিশ্রাম নিতে দেখিনি। নিদ্রার কথা আলাদা। তুমি চলে গেলে, সেই গতিময় নক্ষত্রেরও পতন ঘটল।
তোমার রেখে যাওয়া শিল্পকর্ম, কাজ কিছুই এখনো সম্পূর্ণ গুছিয়ে উঠতে পারিনি। একে তো বিশাল দায়িত্ব, তার ওপর বড় কথা হলো, তোমার জিনিস নাড়াচাড়া করতে করতে স্মৃতির মধ্যে হারিয়ে ফেলি নিজেকে। তোমার সেই অতি প্রিয় খেরো খাতার পাতা উল্টাতে উল্টাতে তোমার সঙ্গেই চলে যাই তোমার শৈশবে।
এ রকমই কোনো একদিন তোমার জন্মের মাস ডিসেম্বরে তুমি হারিয়ে গেলে তোমার শৈশবে। তুমি যেন তখন তোমার মার চার-পাঁচ বছরের ছোট্ট শিশুটির মতো। মনে হচ্ছিল মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে কত কথাই না বলছ। মনে হয় জীবন্ত কথোপকথন। একসময় তোমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। আমিও আর আমার চোখের পাতাকে ধরে রাখতে পারি না, ভারী হয়ে আসে আমার চোখের পাতাও, গলাটা ব্যথায় ধরে আসে, লেখাগুলো ঝাপসা হয়ে যায়। আর পড়া যাচ্ছে না। একপাশে খাতাটা সরিয়ে তোমার কান্নার সঙ্গে যুক্ত করি নিজেকে। এভাবেই কেটে যায় আমার দিনগুলো। তাই এখনো শরতের শিউলি ফুল চোখে পড়লে তোমার কথাই মনে পড়ে। তোমার এই অনুভূতিটা আমার এই লেখার পাঠকদের সঙ্গে ভাগাভাগি করার লোভ সামলাতে পারছি না। বাবা, তাই তোমার খেরো খাতায় লেখা তোমার ‘মা’-এর সঙ্গে কথোপকথনের কিছুটা অংশ এখানে তুলে ধরছি...
আমার হারিয়ে যাওয়া প্রিয় অলস রবিবার
৪ঠা পৌষ ১৩৯৪ বাং
২০ এ ডিসেম্বর ১৯৮৭ ইং
২৮ এ রবিউস সানি ১৪০৮ হিঃ
সময় সকাল সাড়ে ছটা
আজ ভোর রাত্রি সাড়ে চারটায় শয্যা ত্যাগ করে তার পরবর্তী সকল কাজ সমাধা করে বেশ কিছু দিন পরে প্রাতঃভ্রমণে বের হয়েছিলাম। নতুন ‘বিজয় সরণী’তে। ভালোই লাগছিল, তবে আজ একটি বটিকা জিভের নিচে রাখতে হয়েছিল।
আগামী ৩১-এ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই বাসায় আছি। তারপর চলে যাচ্ছি উত্তরায়, এখান থেকে বেশ দূরে আজ প্রাতঃভ্রমণে যাওয়ার পথে লোহার ছোট গেইট পার হয়েই বাঁ হাতে একটি ছোট এবং রুগ্ন শিউলি গাছ দেখি, আজও দেখলাম ওই রুগ্ন গাছটি কিছু শিউলি ঝরিয়ে রেখে দিয়েছে। কয়েক দিন প্রাতঃভ্রমণ শেষে বাড়ী ফেরার পথে একমুঠো করে শিউলি নিয়ে এসেছি, গন্ধ শুঁকেছি, সেই শিউলির গন্ধ আমাকে বারবার নিয়ে গেছে আমার ফেলে আসা গ্রামের বাড়ীতে, যেখানে আমার মা এক শিউলি গাছ অতি যত্নে লাগিয়েছিল। আমার সেই মমতাময়ী মা সেই শিউলি গাছ থেকে শিউলি ঝরার আগে নিজেই ঝরে গেলেন, সকিনা তখন মাত্র আড়াই বছরের শিশু। সকিনা আজ তার মেয়ের জামাই এবং নাতনিদের নিয়ে বেশ সুখেই আছে। অপূর্ব সুন্দর কাপড়ের পুতুল তৈরি করে, সকিনা মায়ের লাগানো শিউলি গাছের কথা কিছুই জানে না, জানে না তার গর্ভধারিণী মাকে।
১৯৩৬ সালের জানুয়ারি মাসের এমনি একদিনেই আমার মা শিউলি ফুলের মতই ঝরে পড়েছিল। এমনি শীতকাল, আজ ২০-এ ডিসেম্বর। মা যেন আমার পাশটিতে দাঁড়িয়ে...আমি আর পারছি না। চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে, বহুদিন পরে মায়ের জন্য কাঁদছি। আর কলম চালাচ্ছি। আর পারছি না।
সকাল আটটা
স্নানাদি এবং চা-নাস্তা সাথী করে আবার খতিয়ান খাতা নিয়ে বসলাম। সকালে আজ মায়ের জন্য বহুদিনের অশ্রু ঝরিয়ে মনটা বেশ হালকা হয়েছে, মনে হচ্ছে মা আমাকে ছেড়ে চলে যায়নি।
অনেক দিন আগে, তখন আমি চাকুরী করি এবং প্রতিদিন অফিসে আমার খতিয়ান খাতা দিয়ে যেতাম, তার পাতা করে মায়ের কথা লিখেছিলাম, লিখেছিলাম বললে ভুল হবে, বরং মার সাথে কথা বলেছিলাম। আজও কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে ভীষণ, আমার মেয়ে রত্না তোমাকে দেখেনি, তুমিও তার জন্য অপেক্ষা না করেই চলে গেলে। আমি জানি আমার রত্নাকে দেখলে তুমি অবশ্যই খুশী হতে। রত্না ছেলেবেলায় বেশ বুঁচি ছিল। এখন তার টিকালো নাক। তোমার পুতনীর বিয়ে দিয়েছি, তোমার পুতনীজামাইও খুব ভালো। খুব মিষ্টি খেতে ভালোবাসে। কিন্তু তোমার হাতের পুলিপিঠে বা চন্দ্রপুলি যদি একবার পেত, তাহলে যে কী করত জানি না। আমার চোখ বেয়ে আবার অশ্রু ঝরছে। আজ বহুদিন পরে তুমি আমাকে বড় কাঁদাচ্ছ। কেন বল তো মা।
কোনো চিন্তা কর না, আমি ভালোই আছি। খুব ছবি আঁকছি, আমার ছবি বাংলাদেশের জাতীয় যাদুঘরে সংরক্ষিত হবে, তোমার সেই দুষ্টু ছেলের ছবি দেখতে প্রতিদিন হাজার হাজার লোক আসবে দেখতে। তারা তো জানবে না কে আমাকে পেটে ধরেছিল!
আমাকে নিয়ে তোমার আব্বার কি দুশ্চিন্তা ছিল! ছবি এঁকে কি সংসার চলবে? কত রকম ভাবনা ছিল তোমাদের। তুমি চলে যাওয়ার পর ১২ বছর পর আব্বাও চলে গেলেন, তোমার পাশটিতেই তো শুয়ে আছেন। গোরস্তানে সেই জায়গাটিতে। যে জায়গাটি সরকার থেকেই নানাজীকে অর্থাৎ তোমার বাপজীকে বিনা পয়সায় দেওয়া হয়েছিল।
অথচ নানাজী রইল গ্রামে পড়ে, আর তাঁর মেয়ে জামাই তাঁর জায়গা দখল করে পরম নিশ্চিন্তে শুয়ে রয়েছে।
(ডায়েরির অংশ)
২.
তোমাকে মনে পড়ে শিশিরে ভেজা শিউলি ফুলের শরতের সকালে, ২১ ফেব্রুয়ারিতে, মনে পড়ে ২৬ মার্চে, ১৬ ডিসেম্বর, মনে পড়ে বৈশাখী মেলায়, নবান্নোৎসবে। বহু বছর আগে তুমি আমাদের দেখিয়ে গেছ এসব কীভাবে পালন করতে হয়; এসব উৎসব ও দিনগুলো পালনের পদ্ধতি তোমারই সৃষ্টি। কিন্তু আজ উৎসবের আনন্দের কাছে তুমি ম্লান হয়ে গেছ। হারিয়ে গেছ ‘তুমি’ বলে একজন ব্যক্তি। কেবল আমার অন্তরে তুমি আছ। এসব তোমাকেই খোঁজে। কী জানি হয়তো তুমি দূরে কোথাও দাঁড়িয়ে চুপিসারে দেখছ সবকিছু আর মুচকি হাসছ, ভাবছ তোমাকে তো কেউ দেখতে পাচ্ছে না।
আমি তো দেখেছি তোমার ভূমিকা ১৯৬৯-এর অসহযোগ আন্দোলনে, তারপর ’৭০-এ গণঅভ্যুত্থান থেকে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী কর্মকাণ্ডে; একটি নতুন দেশের উন্নয়নে একটি সমৃদ্ধ জাতি গড়ার লক্ষ্যে তোমার বিভিন্নমুখী কর্মসূচি গ্রহণ এবং একান্ত সম্পৃক্ততা। তুমি ছিলে একজন সমাজসচেতন, স্পষ্টভাষী, অন্যায়ে আপসহীন প্রগতিবাদী শিল্পী। শুধু শিল্পী বললে তোমাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হবে, যা তুমি একেবারেই নও। তুমি অত্যন্ত সত্যনিষ্ঠ বলিষ্ঠ নীতির প্রতীক। সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত সচেতন মানুষ।
সবাই স্বাধীনতা যুদ্ধ ও তার পরে অনেকের অবদানের কথা বলে। তোমার কথা আর শুনি না। তাই ভাবি হারিয়ে যাচ্ছ তুমি ইতিহাস থেকে, কেবল তোমার ‘এই জানোয়ারটিকে হত্যা করতে হবে’ পোস্টারটি একেবারে তোমাকে মুছে ফেলতে পারেনি ইতিহাস থেকে। এদেশে আমরা নিজেদের সঠিক ইতিহাস এখনো লিখতে পারিনি। পরের প্রজন্মকে জানাতে পারিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের সঠিক ইতিহাস। আমি তো জানি তুমি স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক, ‘জাতীয় পতাকা’র রূপকার; বিমান বাংলাদেশের ‘বলাকা’ ও পর্যটন করপোরেশন ‘পিপিসি’র রূপকারও তুমি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সাড়া জাগানো বিখ্যাত পোস্টারের কথাও আমি ভুলিনি।
তুমি যে বাংলাদেশকে এত ভালোবেসে গেলে, সেই স্বাধীন দেশেরই মৌলবাদীচক্র তোমার ফাঁসির দাবি তুলেছে, তোমার নামে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তোমার অজস্র শিল্পকর্ম নষ্ট করেছে। তোমাদের জন্য আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। প্রতিদানে আমরা কতটুকু দিতে পেরেছি? সরকার পরিবর্তন হয়, কিন্তু স্বার্থত্যাগী ব্যক্তিরা ইতিহাসের অন্তরালেই চলে যাচ্ছেন। তোমাদের মতো মানুষের স্মৃতি ধরে রাখার প্রয়োজনীয়তা এখন আর স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের কাছে নেই!
১৯৬৯-এর অসহযোগ আন্দোলন থেকে ১৯৮৮ সালে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং তারপর তোমার বিদায়। মৃত্যুর ১০ মিনিট আগে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে তোমার উচ্চারিত বাক্য আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। এটি যেন খনার বচনে পরিণত হয়েছে। কিন্তু তোমাকে আর কারোর মনে পড়ে না।
একই ব্যক্তির স্মৃতি রক্ষার্থে একাধিক সড়ক, পার্ক, উদ্যান, অডিটোরিয়ামের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত তোমার নামে ছোট্ট একটা সড়ক কি সড়কদ্বীপ বা কোনো গ্যালারির নামকরণের প্রয়োজন বোধ করে না কেউ। আমরা সত্যিই অকৃতজ্ঞ।
আমি তো তোমাকে হারিয়েছি। হারিয়েছি মাথার ওপর বটবৃক্ষের ছায়া। আমাদের গোটা পরিবার হারিয়েছে ছায়াদানকারী সেই বৃক্ষ; শুধু প্রশ্ন—যাদের জন্য তুমি তোমার জীবনের মূল্যবান সময় ব্যয় করলে, ত্যাগ স্বীকার করলে, সেই জাতি তোমার অবর্তমানে তোমাকে কতটা মনে করে? পূর্ব পাকিস্তানের সময় তোমার নিজ হাতে গড়া পাকিস্তান স্মল অ্যান্ড কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (পিসিক) কি জাঁকজমক অবস্থায় চলত। তখনই বহু প্রতিকূলতায় বাংলার ঐতিহ্য কৃষ্টি পৃথিবীর অন্যান্য দেশের কাছে তুলে ধরার জন্য চলত গবেষণা ও মানোন্নয়ন। এখন এটি স্বাধীন দেশ বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার হতদরিদ্র চেহারা। কোথায় তার জৌলুশ। ভাগ্যিস তোমাকে এর এই কৃশকায় চেহারা দেখে যেতে হয়নি। না হলে তুমি অত্যন্ত মর্মাহত হতে। স্বাধীনতা পাওয়ার পর বোধ হয় আমাদের নিজস্ব কৃষ্টি বা ঐতিহ্যবোধ আন্তর্জাতিক বাজারে দেখানোর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। তোমার মৃত্যুর পর ওই ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার তোমারই হয়তো কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী ওখানকার একটি হলরুমের নাম রেখেছে তোমার নামে, যা চোখে না পড়ার মতোই। এ হলরুমের যে জীর্ণদশা তাতে মনে হয় না ওই ঘরটি ব্যবহার-উপযোগী, আদৌ ওই হলঘরে কিছু হয়েছে বলে আমার জানা নেই। যদিও আমার তথ্যে ভুল থাকতে পারে।
তোমার চিত্রকর্মের একটি অংশ ‘রমণী’, তোমার অতি প্রিয় বিষয় বেছে নিয়ে একটি প্রদর্শনী করতে গেলাম। সেখানে অদ্ভুত সব সমালোচনার মুখোমুখি হতে হলো। আরো দুঃখজনক হলো, যারা সমালোচনা করেছেন তারা একসময়কার তোমার অতি কাছের আপনজন এবং শুভাকাঙ্ক্ষী বলে পরিচিত। তুমি আমার বাবা, তাই আমিও তোমার মতোই হব কিছুটা হলেও। তাই চিন্তা করো না। তোমার প্রদর্শনী আমি বিশাল করেই করব ইনশাল্লাহ। আমি তো তোমার মেয়ে, তোমার আদর্শ আমার রক্তে—এ রকমই তোমার এক জন্মদিনে আমি শান্তিনিকেতন থেকে তোমাকে মনে করেছিলাম। তার উত্তরে তুমি আমাকে একটা চিঠি লিখেছিলে। আমি তোমার ওই অপূর্ব সুন্দর চিঠিগুলোর একটি এখানে পাঠকদের সাথে ভাগাভাগি করে এ লেখাটি শেষ করতে চাই:
শিল্পী কামরুল হাসানের লেখা একটি চিঠি
৭৬ বি রাজাবাজার দক্ষিণ
তেজগাঁও, ঢাকা-১৫
বাংলাদেশ
পরম কল্যাণীয়াষু
মা, রত্না। তোমার ১০/১/৮২ তারিখের লেখা চিঠিখানি এই মাত্র আমার হাতে এসে পড়ল। তোমার আগের লেখা চিঠিখানি আমি পাইনি। তোমার চিঠি পাওয়ার অপেক্ষায় আমি অস্থির ছিলাম। গত ৫/১/৮২ তারিখে তোমার প্রদ্যোৎ চাচা, চাচি এবং চন্দনারা আমার সাথে দেখা করে গেছে।
শান্তিনিকেতনে তোমার মন বসে গেছে জানতে পেরে আমার খুব আনন্দ লাগছে। তোমাদের পৌষ মেলার সংবাদ আমি পেয়েছিলাম। আবার তো বোধ হয় সামনেই মাঘ উৎসব আছে। মা তুমি এখন বড় হয়েছ। জীবন এবং সৌন্দর্য সম্পর্কে বুঝবার মতো বুদ্ধি হয়েছে, এখন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের পালা। চন্দনার মা তোমার খুব প্রশংসা করলেন। ঢাকায় আসবার জন্য মনটা মাঝে মাঝে চঞ্চল হবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু বর্তমানে তুমি যে সুন্দর পরিবেশের মাঝে আছ তার মধ্যে যত দিন কাটাতে পারবে তোমার ভবিষ্যৎ জীবন গঠনের জন্য ততই মঙ্গল।
তুমি শান্তিনিকেতনে গিয়ে যে ভাগ্যবতী হয়েছ, সে কথা আমি তো আগেই তোমাকে লিখেছিলাম মা।
রবীন্দ্রনাথ একজন মহামানব ছিলেন।
না হলে ভবিষ্যৎ বাঙ্গালী জাতির জন্য শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করে যেতেন না। তুমি যে বিষয়ে পড়াশোনা করতে গেছ তা তো করবেই, তা ছাড়াও সংস্কৃতির অন্য দিকগুলোও ভালো করে হৃদয় দিয়ে অনুভব করবে। উপলব্ধি করবে। তোমার আর সব বন্ধুদের সাথে সহজভাবে নিজের স্বতন্ত্র বজায় রেখে মিশবে। তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নাই। সকলের জীবনেই সুসময় এবং অসময় আসে। এর ভেতরেই আমাদেরকে তৈরি হতে হয়। কোনো কোনো অস্বাভাবিক পরিস্থিতি পরবর্তীকালের জন্য মঙ্গল ডেকে আনে।
তোমার জীবনেও মঙ্গলবার্তা বয়ে নিয়ে আসুক, এটাই আমার একান্ত কাম্য। কলকাতা গেলেই তোমার প্রদ্যোৎ চাচাদের কাছে অবশ্যই যাবে। তাঁরা তোমার অকৃত্রিম শুভার্থী। আমি ভালোই আছি। আমি গত ৯/১/৮২ তারিখ থেকে ১৪/১/৮২ তারিখ পর্যন্ত সিলেট-এ বেড়িয়ে এলাম। তোমার বন্ধুর বোনের বিয়েতেও গিয়েছিলাম। (কাদের সাহেবের মেয়ে স্বেতা) হঠাৎ করেই অন্য কাজে সিলেট গিয়েছিলাম।
রংগুলি যে তোমার কাজে লাগছে জানতে পেরে খুব খুশি হলাম design কেবল কাগজেই করার বস্তু নয়, জীবনের সর্ব্বক্ষেত্রেই design ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। চলায়, বলায়, নৃত্যে, গানে। কাজে-কর্ম্মে সব জায়গাতেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এবং আজ তুমি যেখানে আছ, সেই শান্তিনিকেতনেই কবিগুরু তার বীজ বপন করে গেছেন।
যাই হোক তুমি ভালো থাকবে। শরীরের প্রতি বিশেষ যত্নবান হবে। গত ২/১২/৮১ তারিখে আমিও তোমার কথা মনে করেছিলাম। ষাট বছর পার করে দিলাম। ছবি আঁকায় মন দিয়েছি। এ ছাড়া খেরো খাতার পাতায় লিখে চলেছি নিয়মিত।
তোমার বাবলু ভাই আমাদের কাছে থাকায় খুব সুবিধা হয়েছে আমার। বাবলু খুব ভালো কবিতা লিখছে। খুব বলিষ্ঠ লেখা এবং আবৃত্তির গলাও খুব চমৎকার। খুব ভরাট গলার অধিকারী।
আমার খেরো খাতা ঘেঁটে ঘেঁটে বাবলুই লেখা নির্বাচন করে দেয় পত্রিকার জন্য। তোমার প্রদ্যোৎ চাচারাও আমার খেরো খাতা দেখে খুব প্রশংসা করে গেল।
আমার চিঠি পেয়েই উত্তর দিও।
আমার অশেষ শুভেচ্ছা নিও।
ইতি
তোমার আব্বু
সোমবার
১৮/১/৮২
ঢাকা।