সাউন্ড উইদিন স্টিলনেস: পয়েন্টালিজমের বিমূর্ত ভিজ্যুয়াল

শিল্পী ফারজানা রহমান ববির দ্বিতীয় একক চিত্রকলা প্রদর্শনী সাউন্ড উইদিন স্টিলনেস আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য ঢাকায় প্রদর্শিত হচ্ছে। প্রদর্শনীতে প্রবেশমাত্রই অনুভব হয় এ এক নীরব, অথচ গভীর অনুধ্যানের যাত্রা। যেখানে রং, বিন্যাস, বিন্দু ও রেখার মধ্য দিয়ে শিল্পী ধ্বনি ও নীরবতার পারস্পরিক সম্পর্ক অনুসন্ধান করেছেন। প্রদর্শনীর প্রতিটি সিরিজ—‘অ্যাম্বিয়েন্ট সাইলেন্স’,‘ ব্লসমস’, ‘ব্লসমস ইন ওয়াইল্ডারনেস’, ‘সাউন্ডস অব সেলফ’—একই অস্তিত্ববাদী ও ধ্যানমূলক সূত্রে বাঁধা।

১ / ৫
অ্যাম্বিয়েন্ট সাইলেন্স ১। শিল্পী ফারজানা রহমান ববি
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

‘অ্যাম্বিয়েন্ট সাইলেন্স’ সিরিজের প্রথম ছবিটি একটি বিমূর্ত বিন্যাস। এই ছবিতে শিল্পী রং, বিন্দু ও টেক্সচারের পারস্পরিক সম্পর্কের মাধ্যমে একধরনের অনির্দিষ্ট অথচ সজীব দৃশ্যমান জগৎ নির্মাণ করেছেন। নীল রঙের আধিক্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় গভীরতার প্রতীক জল বা আকাশের বিস্তারকে। সেই গভীরতার ওপর ছড়িয়ে আছে সবুজ, কমলা ও সোনালি রঙের ছন্দময় ছিটে—যা জীবনের উচ্ছ্বাস, উষ্ণতা ও আলোকপ্রবাহের অনুভূতিকে জাগিয়ে তুলছে।

রঙের স্তরগুলো এখানে শুধু দৃশ্যমান প্রভাব নয়, বরং অনুভূতির ভাষা—যেন শিল্পী এক অভ্যন্তরীণ জগতের মানচিত্র এঁকেছেন, যেখানে দৃষ্টির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো স্পর্শ, সুর ও শ্বাসের অনুরণন।

এই চিত্রে আকার অনুপস্থিত হলেও, বিন্দু ও দাগের পুনরাবৃত্তি একধরনের অপটিক্যাল রিদম তৈরি করেছে, যা আমাদের জর্জ সুরার পয়েন্টালিজমের কথা মনে করিয়ে দেয়, যদিও এটি তেমন শৃঙ্খলাবদ্ধ নয়; বরং বেশি স্বতঃস্ফূর্ত, প্রায় জৈবিক। এই স্বতঃস্ফূর্ততাই চিত্রটির প্রাণ।

পয়েন্টালিজমের প্রসঙ্গ অবতারণার অন্যতম কারণ, এর বৈশিষ্ট্যগুলোর অনেক কিছুরই এখানে উপস্থিতি। যেমন পয়েন্টালিজমের ছবিতে ব্রাশস্ট্রোক প্রায় অনুপস্থিত থাকে; শুধুই বিন্দু দিয়ে তৈরি। সরাসরি মিশ্রিত রং ব্যবহার না করে পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ রং ব্যবহার করা হয়। আলো, ছায়া ও গভীরতা তৈরির জন্য বিন্দুর ঘনত্ব পরিবর্তন করা হয়। ছবিতে গাণিতিক শৃঙ্খলা থাকে, কারও কারও ছবিতে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণও থাকে। এই চিত্রকে পয়েন্টালিজম জায়গা থেকে চিহ্নিত না করে ডিভিশনিজমের জায়গা থেকেও চিহ্নিত করা যায়। কারণ, এই ছবিতেও রংগুলোকে ছোট ছোট অংশে বিভক্ত করে ব্যবহার করা হয়েছে। রংগুলো ক্যানভাসে একসঙ্গে না মিশে, দর্শকের চোখে গিয়ে মিশে যাচ্ছে মাঝেমধ্যে। ফলে ছবির কোনো অংশে হলুদ আবার কোনো অংশে সবুজের ভ্রম তৈরি হচ্ছে।

‘অ্যাম্বিয়েন্ট সাইলেন্স’ সিরিজের আরেকটি ছবি। বিমূর্ত এই ক্যানভাসের ধূসর-নীলের ঘন কুণ্ডলী এক অন্ধকার সমুদ্রের মতো শ্বাস নেয়, যার চারপাশে নেগেটিভ স্পেস শূন্যতাকে অস্তিত্বের শক্তিতে রূপান্তরিত করে। যে শক্তির অন্তরালে আছে ধ্যানমগ্নতা। যা তৈরি হয়েছে ছবির গাঢ় রংগুলোর বাইরের হালকা ওয়াশের অংশগুলোতে। এখানে জলরঙের অনিয়ন্ত্রিত প্রবাহ ও ইঙ্কের ক্ষয়িষ্ণু স্তর মিলে তৈরি হয়েছে এক স্নায়ুতন্ত্র—যেখানে একাকী গাছের শিরা ও বিদ্যুৎ-রেখা জীবনের শেষ স্পন্দনকে ধরে রেখেছে।

২ / ৫
অ্যাম্বিয়েন্ট সাইলেন্স ২। শিল্পী ফারজানা রহমান ববি
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

‘ব্লসমস’ সিরিজের ছবিগুলোতে রেখার ভেতর বিকাশমান বিমূর্ত প্রস্ফুটন ক্যানভাসে বিকাশ, উদ্ভাসন ও পুনর্জন্মের এক নান্দনিক ইঙ্গিত। কিন্তু এই বিকাশ এখানে রঙের বিস্ফোরণে নয়, বরং রেখার জটিল পুনরাবৃত্তিতে, ছন্দের অনিবার্য অনুশাসন মনে হয়। চিত্রগুলো প্রথম দেখায় যেন এক প্রাযুক্তিক টেক্সটাইল বুনন—সুসংগঠিত কিন্তু স্পন্দমান। নীলের প্রশস্ত আয়তক্ষেত্র মাঝখানে স্থিরতার প্রতীক, তার ওপর-নিচে সাদা পটভূমিতে লাল ও কালোর সূক্ষ্ম তরঙ্গরেখা যেন জীবনের ক্ষুদ্র অথচ ক্রমাগত আন্দোলনের দাগ। রেখাগুলোর কম্পন যেন শব্দহীন সংগীত। নীলের ভেতরের শীতলতা ও লাল-কালোর উষ্ণ সংঘাত একসঙ্গে মিশে তৈরি করে মনস্তাত্ত্বিক ভারসাম্য। শিল্পী এখানে কোনো নির্দিষ্ট আকারের দিকে যাননি; বরং রেখার পুনরাবৃত্তি ও সূক্ষ্ম অনিয়মের মাধ্যমে তিনি আমাদের সামনে এক প্রক্রিয়াগত নন্দন তুলে ধরেছেন।

চিত্রগুলোর বিমূর্ত গঠন দর্শককে থামতে বাধ্য করে। কাছে গেলে দেখা যায়, রঙের প্রতিটি স্তর যেন আলাদা নিশ্বাস নিচ্ছে—একটি নিশব্দ কোরাস। দূর থেকে এটি আবার শৃঙ্খলার প্রতীক, একটি সংগঠিত ক্ষেত্রের মতো। এই দ্বৈততা—অরাজকতার ভেতর শৃঙ্খলা—হয়তো শিল্পীর মূল বক্তব্য। ব্লসময় আধুনিক বিমূর্ত শিল্পের ধারায় এক গভীর সংযোজন, যেখানে নান্দনিকতা ও গণিতের সূক্ষ্ম ছন্দ মিলেমিশে গেছে। এটি শুধু রঙের নয়, চিন্তারও প্রস্ফুটন। এখানেও আছে মেডিটেশন। চিত্রগুলোর গঠণপ্রণালির দিকে তাকালেও যে কেউই একটা ধ্যানমগ্ন সময় পার করতে পারবেন।

৩ / ৫
ব্লসমস। শিল্পী ফারজানা রহমান ববি
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

‘ব্লসমস ইন ওয়াইল্ডারনেস’ সিরিজটি সামগ্রিকভাবে ‘ব্লসমস’ সিরিজের মতোই—রং, পুনরাবৃত্তি ও টেক্সচারের মধ্য দিয়ে এক ধৈর্যশীল বিকাশের উপাখ্যান। এখানে প্রতিটি চিত্র যেন নীরব উচ্চারণের ভিন্ন সুর।

শিল্পী যেন একধরনের কনটেমপ্লেটিভ অ্যাবস্ট্রাকশনের পথ অনুসরণ করেছেন, যেখানে ফর্মের পরিবর্তে প্যাটার্ন ও রঙের ঘনত্বই হয়ে ওঠে অনুভূতির ভাষা। ক্ষুদ্র বিন্দু, ঘূর্ণনধর্মী রেখা ও সূক্ষ্ম স্পর্শে তৈরি এই ঘন টেক্সচারগুলোও অনেকটা পয়েন্টালিজমের উত্তরাধিকার বহন করে, কিন্তু তার ভেতর আছে একধরনের আধ্যাত্মিক নীরবতা—যেন রঙের মধ্য দিয়ে ধ্যান।

সিরিজটি ফেনোমেনোলজিক্যাল অ্যাবস্ট্রাকশনের কাছাকাছি দাঁড়ায়—যেখানে দর্শক চিত্রকে কেবল দেখেন না, বরং তার রং-কম্পন ও ভিজ্যুয়াল রিদমের সঙ্গে শরীরীভাবে যুক্ত হন। প্রতিটি ফ্রেম যেন নিজেই এক ক্ষুদ্র ভূগোল।

৪ / ৫
ব্লসমস ইন ওয়াইল্ডারনেস। শিল্পী ফারজানা রহমান ববি
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

তবে ‘ব্লসমস ইন ওয়াইল্ডারনেস’-এর স্ক্রিনপ্রিন্টের একটি ছবি এই সিরিজ থেকে পুরো আলাদা। আবেগপ্রবণ ও গতিশীল এই চিত্রকর্ম প্রাকৃতিক এবং বিমূর্ত আকার একত্র হয়ে গঠন করেছে এক জৈবশক্তির প্রবাহ। উজ্জ্বল রঙের সমন্বয়—বিশেষত প্রাণবন্ত লাল, গভীর কালো এবং দীপ্তিময় হলুদ—চিত্রটিকে এক তাৎক্ষণিক প্রাণশক্তি দেয়। এই রংগুলোর সংঘর্ষ ও সংলাপে জন্ম নিয়েছে এক অব্যক্ত আন্দোলন, যা একই সঙ্গে অস্থির ও জীবন্ত।

ওপরের বাঁ কোণে হলুদের তীব্র উপস্থিতি যেন সূর্যের আলো বা কোনো বিস্ফোরিত শক্তির কেন্দ্র, যার চারপাশে লাল ও কালোর ঘূর্ণি আবেগের উন্মত্ততা প্রকাশ করছে। ব্রাশ, টেক্সচারাল স্তর, বা স্প্রে-প্রযুক্তির সূক্ষ্ম ব্যবহার চিত্রটিকে দিয়েছে এক ধোঁয়াটে বাস্তবতা।

৫ / ৫
ব্লসমস ইন ওয়াইল্ডারনেস ২। শিল্পী ফারজানা রহমান ববি
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

সার্বিকভাবে, ‘ব্লসমস ইন ওয়াইল্ডারনেস’ শেষ পর্যন্ত এক দার্শনিক প্রস্তাবনা: প্রতিকূলতা কোনো অবসান নয়, বরং সৃষ্টির মাটি। যে অনুর্বর ভূমিতেও ফুল ফোটে, সেটিই প্রকৃত শিল্পের জন্মভূমি।

এই প্রদর্শনীতে শিল্পী ফারজানা রহমান ববির কাজ দৃশ্যমান বাস্তবকে অনুবাদের অধিক এক অভ্যন্তরীণ ভূগোলের মানচিত্র; যেখানে শব্দ ও নীরবতা একে অপরের পরিপূরক। সাউন্ড উইদিন স্টিলনেস তাই শেষ পর্যন্ত এক নান্দনিক ও দার্শনিক অনুসন্ধান, প্রকৃতির ভেতর আত্ম-উন্মোচনের এবং নীরবতার মধ্যে সৃষ্টিশীল স্পন্দনের।

গত ৩১ অক্টোবর শুরু হওয়া প্রদর্শনী সাউন্ড উইদিন স্টিলনেস চলবে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত। প্রতিদিন বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।