বৈশাখের ভরদুপুরে গরুর গাড়িতে করে পাকা ধান নিয়ে ফিরছেন কৃষক। খালে জমে আছে বৃষ্টির পানি। খালটা পাড়ি দিতে পারলেই বাড়ি যাওয়া যায় নিশ্চিন্তে। খালের ওপারেই কৃষকদের গ্রাম। গ্রামের পাশ দিয়ে সোজা চলে গেছে যে সরু রাস্তা, তার পাশেই খালটা। গরুর গাড়ি নিয়ে খাল পাড়ি দেওয়া গেল কোনোমতে। কিন্তু ধানের বোঝার যে ওজন, তাতে ঢালু থেকে ওপরে ওঠা কঠিন। জোয়াল লাগানো গরু দুটি প্রাণপণ চেষ্টা করছে ডাঙায় উঠতে। কিন্তু এই চেষ্টা পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার মতোই শ্রমসাধ্য। গাড়িচালক আর ফসলের মালিকেরা নামলেন পানিতে। শরীরের সব শক্তি দিয়ে তাঁরা চাকা দুটো ঠেলে ওপরে তোলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোনোভাবেই তা নাড়ানো যাচ্ছে না। ময়মনসিংহের এক নিভৃত গ্রামে গরুর গাড়ি আর মাটিঘেঁষা মানুষের এই বিশেষ মুহূর্তটা নাইব উদ্দিন আহমেদ তুললেন তাঁর দরদি ক্যামেরায়।
১৯৫৪ সালে ছবিটা যখন তোলা হয়, তখনো ভাটির দেশে দুর্ভিক্ষ চলছে। ছবিটা নাকি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের খুব মনে ধরে। তিনি নাইব উদ্দিনের কাছে এর একটা প্রিন্ট চেয়ে নেন। পরে এই ছবি অবলম্বনে আঁকেন একটি শিল্পকর্ম, একটু ভিন্ন কম্পোজিশনে। এরপর এগ টেম্পেরা, কালো কালি ও তেলরঙে আঁকলেন আরও কয়েকটি ছবি। এসব মাধ্যমে তিনি যোগ করলেন নানা রং আর বিন্যাসে আনলেন গতিময়তা। আর এভাবেই চিরায়ত বাংলার এক বাস্তব দৃশ্য শিল্পীর রংতুলিতে এক কালজয়ী শিল্পকর্ম হয়ে ওঠে। আলোকচিত্র ও শিল্পকলা মাধ্যমের এই দুই পথিকৃৎ শিল্পীর ছবি দুটি লোকজীবনের প্রাত্যহিক সংগ্রামের আখ্যান হিসেবে চিরায়ত রূপ লাভ করে।
১৯৫৪ সালে ছবিটা যখন তোলা হয়, তখনো দেশে দুর্ভিক্ষ চলছে। ছবিটা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের খুব মনে ধরে। তিনি নাইব উদ্দিনের কাছে এর একটা প্রিন্ট চেয়ে নেন। এই ছবি অবলম্বনে আঁকেন একটি শিল্পকর্ম, একটু ভিন্ন কম্পোজিশনে।
নাইব উদ্দিন আহমেদ ও নওয়াজেশ আহমদের যৌথ অ্যালবাম ‘বাংলাদেশ’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। ঢাকার ইস্টার্ন রিগ্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে ইংরেজি, ফরাসি ও জার্মান ভাষায় প্রকাশিত অ্যালবামটির ‘দ্য পিপল’ অধ্যায়ে নাইব উদ্দিনের সাদাকালো ছবিটি ছাপা হয়। ছবিটির শিরোনাম ‘ম্যান অ্যাট ওয়ার্ক: পুশিং আ কার্ট’। নাইব উদ্দিনের ছবিটা পরবর্তী সময়ে ‘গরুর গাড়ি’ কিংবা ‘চাকা’ নামেই অতি পরিচিত হয়ে ওঠে। অন্যদিকে ১৯৭৭ সালে নজরুল ইসলাম রচিত ‘জয়নুল আবেদিন (আর্ট অব বাংলাদেশ সিরিজ: ১)’ বইটি প্রকাশ করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। বইয়ের দুই পৃষ্ঠাজুড়ে ‘দ্য স্ট্রাগল’ শিরোনামে জয়নুলের টেম্পেরা মাধ্যমের শিল্পকর্মটি ছাপা হয়। ক্যাপশনে বলা হয়, ১৯৫৯ সালে ১৫৫ বাই ৬২৭ সেন্টিমিটার মেসোনাইট বোর্ডে টেম্পেরা মাধ্যমে আঁকা। উপান্ত সময়ে জয়নুল ৬০ বাই ২৪৩ সেন্টিমিটার ক্যানভাসে তেলরঙে ছবিটা আবার আঁকলেন। ‘গ্রেট মাস্টারস অব বাংলাদেশ: জয়নুল আবেদিন’ নামে যে অ্যালবামটি ২০১৩ সালে স্কিরা ও বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত হয়, তার দুই পৃষ্ঠাজুড়ে জয়নুলের এ শিল্পকর্মটি ছাপা হয়। ছবিটি ১৯৭৬ সালে আঁকা বলে প্রকাশনাটি উল্লেখ করে।
টেম্পেরা ও তেলরং ছাড়াও আমি এই ছবির আরও একটি সংস্করণ খুঁজে পাই বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর থেকে ২০০৬ সালে প্রকাশিত সৈয়দ আলী আহসান রচিত ‘জয়নুল আবেদিন: শিল্পী ও শিল্পকর্ম’ বইয়ে। কালো কালিতে আঁকা ছবিটির শিরোনাম ‘স্টাডি: পুশিং কার্ট’। ছবিটি কবে আঁকা, তার উল্লেখ নেই। তবে ছবিটি সত্তরের দশকে আঁকা হতে পারে বলে কয়েকজন শিল্পসমালোচকের ধারণা। মোটামুটি এই হলো দুই মাধ্যমের দুই ছবি নিয়ে বেসিক তথ্য।
তবে এই দুই ছবি নিয়ে নতুন আলোচনার সূচনা হয় নাঈম মোহায়মেনের বই ‘বাংলার আলোকচিত্রের বাস্তবতা অভিযান’ প্রকাশের পর। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত এ বইয়ের ‘নাইব উদ্দিন ও জয়নুলের চাকা’ অধ্যায়ে সাউথ এশিয়ান মিডিয়া একাডেমি-পাঠশালার শিক্ষক মুনেম ওয়াসিফের একটি পুরোনো আলোচনা সামনে নিয়ে আসা হয়। মুনেম কাদায় আটকে পড়া জয়নুলের সেই পেইন্টিং আর তার পাশাপাশি নাইব উদ্দিনের তোলা ছবি দেখিয়ে দর্শকদের প্রশ্ন করেন, কোন কাজটা আগের? কে কাকে উদ্দীপনা দিয়েছেন? জয়নুলের পেইন্টিং দেখে নাইব উদ্দিন কি বেরিয়ে গিয়েছিলেন অনুরূপ একটা চাকা খুঁজতে? নাকি নাইব উদ্দিনের ছবি দেখে জয়নুল অনুপ্রাণিত হয়ে স্টুডিওতে বসে ছবিটি এঁকেছিলেন?
কোন কাজটা আগের? কে কাকে উদ্দীপনা দিয়েছেন? জয়নুলের পেইন্টিং দেখে নাইব উদ্দিন কি বেরিয়ে গিয়েছিলেন অনুরূপ একটা চাকা খুঁজতে? নাকি নাইব উদ্দিনের ছবি দেখে জয়নুল অনুপ্রাণিত হয়ে স্টুডিওতে বসে ছবিটি এঁকেছিলেন?
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটোগ্রাফি বিভাগের প্রধান নাঈম মোহায়মেন এ ব্যাপারে কিছু যুক্তিতর্কও তুলে ধরেন। তিনি লেখেন, ‘যেহেতু শিল্পকর্ম নির্মাণের তারিখ লিপিবদ্ধ করার চল ছিল না, তাই কোন কাজটি আগে এসেছিল এটা নির্ণয় করা কষ্টকর। জয়নুলের “সংগ্রাম” চিত্রকর্মের আদি রচনাকাল নিয়ে একটা ছোট বিতর্ক বিরাজমান। এ ব্যাপারে বিভিন্ন মাধ্যম (এগ টেম্পেরা, তেলচিত্র) এবং নামের (দ্য স্ট্রাগল, লাইফ, জীবনসংগ্রাম) জটিলতা দেখা দিয়েছে। পরবর্তীকালে শাওন আকন্দ [২০০৯] এ ব্যাপারে নতুন গবেষণা করেছেন। পাকিস্তানি পত্রিকায় ১৯৫৪ সালে ছাপানো ছবি এবং আলতাফ গওহর, নজরুল ইসলাম, সৈয়দ আজিজুল হক ও নিসার হোসেনের লেখা পর্যবেক্ষণ করে আকন্দ প্রস্তাব করেন, মূল সৃষ্টিকাল ১৯৫৪। নাইব উদ্দিনের ফটো তার আগেই তোলা।’
নাঈমের এই রচনার সূত্র ধরে আমি শিল্পগবেষক শাওন আকন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি আমাকে ত্রৈমাসিক ‘শিল্পরূপ’ পত্রিকায় ২০০৯ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত তাঁর লেখা ‘জয়নুলের “সংগ্রাম” নিয়ে নতুন কিছু কথা’ শিরোনামের প্রবন্ধটি পাঠান। জয়নুলের ছবিটি যে ১৯৫৪ সালে আঁকা, এর পক্ষে তিনি সে সময়ের মাসিক মাহে-নও পত্রিকার একটি রিভিউ ও সাপ্তাহিক পাকিস্তানি খবর পত্রিকার একটি আলোকচিত্রকে শক্তিশালী রেফারেন্স হিসেবে তুলে ধরেন। তাঁর এই রেফারেন্সের সূত্র ধরে নিজের চোখে দেখার জন্য আমি বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভসে যাই এবং পত্রিকা দুটি সংগ্রহ করি। পত্রিকার তথ্যমতে, ১৯৫৪ সালের মধ্য আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত চার সপ্তাহব্যাপী পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিলের আয়োজনে ঢাকার বর্ধমান হাউসে (বর্তমানে বাংলা একাডেমি) দুই পাকিস্তানের শীর্ষ শিল্পীদের সেরা চিত্রগুলো নিয়ে যে প্রদর্শনী হয়, সেখানে জয়নুলের গরুর গাড়ির ছবিটিও প্রদর্শিত হয়। তবে প্রদর্শিত ছবিটির কোনো শিরোনাম ছিল না।
১৯৫৪ সালের নভেম্বর মাসে মাহে-নও পত্রিকার উর্দু সংস্করণে এ প্রদর্শনী নিয়ে আলতাফ গওহরের একটি সমালোচনা ছাপা হয়। লেখাটি অনুবাদ করেন এ এন এফ আহমদ। ১৯৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মাহে-নও পত্রিকার বাংলা সংস্করণের ৩৩ থেকে ৩৫ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘ঢাকায় চিত্রকলা প্রদর্শনী’ শিরোনামে আলতাফ গওহরের লেখার অনুবাদটি ছাপা হয়। ৩৫ নম্বর পৃষ্ঠায় গওহর লেখেন, ‘প্রদর্শনী ঘরের নিচের তলার মাঝের কামরায় একটি চিত্র বড় ক্যানভাসের উপর অঙ্কিত ছিল। চিত্রটি শিল্পী জয়নুল আবেদীন কর্তৃক অঙ্কিত। ইহাতে কাদায় আটকাইয়া যাওয়া একটি গরুর গাড়ী দেখান হইয়াছে; চালক গাড়ীর চাকা ধরিয়া তাহা কাদা হইতে উপরে তুলিবার চেষ্টা করিতেছে। চিত্রটিতে অত্যধিক অসহায় অবস্থার আভাস পরিলক্ষিত হয়। মনে হয় যেন চিত্রকর অতি চতুরতার সহিত প্রত্যেকটি ভাবভঙ্গী ফুটাইয়া তুলিতে চেষ্টা করিয়াছেন। এক দিকে এক বলবান ও সুদৃঢ় চালককে দেখান হইয়াছে ও অপর পার্শ্বে দেখা যাইতেছে বলিষ্ঠ বলদ যুগল ঘাড় সোজা করিয়া পূর্ণ শক্তিতে গাড়ী তুলিতে চেষ্টা করিতেছে। জীবন্ত বস্তুর চিত্রে এরকম ভাব ফুটান বড় কঠিন। শিল্পী জয়নুল আবেদীনের আরও অনেক মনোমুগ্ধকর চিত্র প্রদর্শনীতে শোভা পাইতেছিল। শিল্প-রসিকগণ তাঁর নতুন অঙ্কিত “ডিজাইন” নামীয় চিত্র দেখিলে ইহার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হইবেন সন্দেহ নাই। এই শিল্পীর ভবিষ্যৎ খুবই প্রতিশ্রুতিশীল। ইনি কখনও অপর কোনো শিল্পীর পদ্ধতি অনুসরণ করেন নাই—এবং যাহা কিছুর চিত্র তিনি আঁকিয়াছেন তাহার অন্তর্নিহিত দুর্বলতা ও দৃঢ়তা সম্পূর্ণভাবে দেখাইয়াছেন। তাঁহার অঙ্কিত গোযান-চালক ও কাদায় আবদ্ধ দুইটি বলদের চিত্র দর্শনে অনেক সময় অতিবাহিত হইবার দরুন তাঁহার অন্যান্য চিত্রাদি দেখার সুযোগ আমাদের ঘটে নাই।’
১৯৫৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সাপ্তাহিক পাকিস্তানি খবর পত্রিকায় অনুষ্ঠানের একটি ছবি বড় করে ছাপা হয়। ছবিতে দেখা যায়, দেয়ালে টাঙানো জয়নুলের গরুর গাড়ির চিত্রকর্মটির দিকে তাকিয়ে আছেন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ।
অপর দিকে ১৯৫৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সাপ্তাহিক পাকিস্তানি খবর পত্রিকার তিন নম্বর পৃষ্ঠায় এ প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের একটি ছবি বড় করে ছাপা হয়। ছবিতে দেখা যায়, দেয়ালে টাঙানো জয়নুলের গরুর গাড়ির চিত্রকর্মটির দিকে তাকিয়ে আছেন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ। তাঁর পাশে ঢাকা আর্ট ইনস্টিটিউটের প্রিন্সিপাল জয়নুল আবেদিন ও পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিলের সেক্রেটারি খায়রুল কবীরসহ আরও দুজন উপস্থিত। ফলে জয়নুলের ছবিটি যে ১৯৫৪ সালে আঁকা, পত্রিকা দুটির রেফারেন্স তারই সাক্ষ্য দেয়।
এখন প্রশ্ন হলো, কোন ছবিটি আগে সৃষ্টি? এটা বোঝার জন্য অবশ্য জয়নুল ও নাইব উদ্দিনের সম্পর্কের রসায়নটাও বোঝা দরকার। দৃশ্যশিল্পের সঙ্গে যাঁদের বোঝাপড়া আছে তাঁরা নিশ্চয়ই অবগত, নাইব উদ্দিনের ছবিতে জয়নুলের কত প্রভাব। জয়নুলও নাইব উদ্দিনের ছবি দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ছবি এঁকেছেন। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ, যা অতি পরিচিত পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে; সেই সময় থেকে দুজনের পরিচয়। জয়নুল তখন কলকাতা আর্ট স্কুলের শিক্ষক আর নাইব উদ্দিন ইসলামিয়া কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র। ওই মন্বন্তরই দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে দেয়। জয়নুল কলকাতার রাস্তায় ঘুরে ঘুরে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা প্রত্যক্ষ করতেন আর ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতেন তাঁদের মর্মস্পর্শী জীবন। নাইব উদ্দিনও তাঁর সঙ্গে থেকে সেসবের ছবি তুলতেন।
দেশভাগের টানাপোড়েনে ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে দুজনই কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় আসেন। ১৯৫১ সালে জয়নুলের উৎসাহে নাইব উদ্দিন ঢাকায় জনস্বাস্থ্য বিভাগে আর্টিস্ট হিসেবে যোগ দেন। তখন পেশাদার আলোকচিত্রীদের আর্টিস্টই বলা হতো। ১৯৫৬ সালে নাইব উদ্দিন বৃত্তি নিয়ে কলম্বোতে যান সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার পড়তে। ফাঁকে শ্রীলঙ্কান আর্ট কাউন্সিলে ফটোগ্রাফি বিষয়ে কোর্স করতে গিয়ে ফটোগ্রাফির বৃহৎ পরিমণ্ডল সম্পর্কে অবহিত হন। নাইব উদ্দিন যখন দেশে ফেরেন তখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। তিনি নাইব উদ্দিনকে পিআইডিতে যোগ দিতে বললেন। তিন বছর চাকরি করার পর সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের ফরমায়েশি ছবি তুলতে তাঁর আর ভালো লাগল না। ১৯৬১ সালে ময়মনসিংহে পূর্ব পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) স্থাপিত হলো। পিআইডির চাকরি ছেড়ে তিনি যোগ দেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বিভাগে, প্রধান আলোকচিত্রী হিসেবে। ওখানে গিয়ে তিনি সৃষ্টিশীল ছবি তোলার সুযোগ পেলেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য-শোভিত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্র নদ, বিভিন্ন ঋতুতে তার রূপবৈচিত্র্য, নদীপাড়ের কর্মব্যস্ত মানুষ, গারো পাহাড় আর বনাঞ্চল তাঁর ক্যামেরার আরাধনা হয়ে ওঠে।
দৃশ্যশিল্পের সঙ্গে যাঁদের বোঝাপড়া আছে তাঁরা নিশ্চয়ই অবগত, নাইব উদ্দিনের ছবিতে জয়নুলের কত প্রভাব। জয়নুলও নাইব উদ্দিনের ছবি দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ছবি এঁকেছেন। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ; সেই সময় থেকে দুজনের পরিচয়।
জয়নুলের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারটি জীবদ্দশায়ই নাইব উদ্দিন লিখে গেছেন তাঁর ফটো অ্যালবাম ‘আমার বাংলা’য়। ‘শিল্পীর কথা’ অধ্যায়ে নাইব উদ্দিন লিখেছেন, ‘ম্যাট্রিকুলেশন শেষে ১৯৪৩ সালে আমি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হই। এ সময় জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসানসহ অনেক শিল্পীর সাথে আমার পরিচয় ও হৃদ্যতা হয়। তাঁদের সাহচর্যে আমার শিল্পবোধ ও শিল্পমনন সমৃদ্ধ হয়। ’৪৩-এর মন্বন্তরের ছবি আঁকার সময় শিল্পী জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে আমিও কলকাতার অলিগলি রাজপথ ঘুরেছি—মন্বন্তরের ছবি তুলেছি। ইসলামিয়া কলেজের পাশে, ধর্মতলা মোড়ে এক স্টুডিও থেকে দুর্ভিক্ষের ছবি প্রিন্ট নেওয়ার সময় তখনকার বিখ্যাত আলোকচিত্রী সুনীল জানা আমার ছবির ভূয়সী প্রশংসা করেন।’ ময়মনসিংহের প্রসঙ্গ টেনে নাইব উদ্দিন লেখেন, ‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে পূর্ণিমা-তিথিতে, বর্ষায় বা শরতে কাশফুলের মায়ায়, এ ব্রহ্মপুত্রের নীলজলে, নৌকায় বহুদিন বহুক্ষণ কাটিয়েছি।’
‘আমার বাংলা’র সম্পাদক রাফিউল ইসলামের কাছে জানতে চাই, ‘নাইব উদ্দিন এই ছবি নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলেছিলেন কি না?’ রাফিউল বলেন, ‘আমার বাংলা প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালে। এই অ্যালবাম প্রকাশ হওয়ার আগে বিভিন্ন সময় তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। ভিডিও ক্যামেরায় তাঁর যে সাক্ষাৎকারমালা ধারণ করা হয়, তার পরিধি নয়-দশ ঘণ্টার কম হবে না। অনেক বছর আগের কথা হলেও স্পষ্ট মনে আছে—নাইব উদ্দিন সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে তিনি এই ছবিটির একটি কপি উপহার দিয়েছিলেন। আর জয়নুলের সঙ্গে তেতাল্লিশের মন্বন্তরের সময় তিনি যেসব ছবি তুলেছিলেন, সেগুলো হারিয়ে গেছে।’
এই যে একাগ্রচেষ্টা ও দেহভঙ্গি জয়নুল আবেদিন এঁকেছিলেন, তেমনি নাইব উদ্দিন আহমেদের তোলা একই রকম ছবি আছে। জয়নুল আবেদিন এ ছবিটি এত পছন্দ করেছিলেন যে তাঁর কাছ থেকে একটি প্রিন্ট কপি চেয়ে নিয়েছিলেন।
‘আমার বাংলা’র ভূমিকায় বরেণ্য চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার লিখেছেন, ‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের যে বিখ্যাত ছবি—গরুর গাড়ি কাদায় পড়ে আছে, তার ওপরে ফসল। যে ফসল নিয়ে যাচ্ছে তার আকাঙ্ক্ষা, আমার আঙিনায় আমার ফসল তুলবই। অর্থাৎ ফসল যে নিয়ে যাবে তার আঙিনায়, তার নিজের জন্য, একটি পরিবারের জন্য, একটি গ্রামের জন্য এবং সর্বোপরি একটি দেশের জন্য। এই যে একাগ্রচেষ্টা ও দেহভঙ্গি জয়নুল আবেদিন এঁকেছিলেন, তেমনি নাইব উদ্দিন আহমেদের তোলা একই রকম ছবি আছে। জয়নুল আবেদিন এ ছবিটি এত পছন্দ করেছিলেন যে তাঁর কাছ থেকে একটি প্রিন্ট কপি চেয়ে নিয়েছিলেন। এখানে চিত্রশিল্পীর সঙ্গে আলোকচিত্রশিল্পীর সম্পর্ক কতটা নিবিড়, সেটাই প্রকাশ পেয়েছে।’
এই দুই শিল্পীর কাজের শৈলী বুঝতে মুনেম ওয়াসিফের আরেকটি প্রবন্ধের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করা যেতে পারে। প্রবন্ধটি ২০১২ সালে ‘কামরা’র প্রথম খণ্ডে মুনেম লিখেছেন, ‘তাঁর [জয়নুল] সাথে সখ্যতার প্রভাব আমরা নাইব উদ্দিনের ছবিতে দেখতে পাই। গুণটানা, লাঙ্গল, গরুর গাড়ি, সাঁওতাল, গ্রামের নারী, এই ছবিগুলোতে জয়নুল থেকে নাইব উদ্দিন অথবা নাইব উদ্দিন থেকে জয়নুল বারবার ঘুরেফিরে এসেছে। কিন্তু এই দুই শিল্পীর সম্পর্ক কেবল বিষয়ের বেলায় নয়, এমনকি ফর্মের ক্ষেত্রেও পুরোমাত্রায় হাজির। এই দুই শিল্পীর গুণটানার ছবিতে একই ফর্ম বারবার ফিরে আসে। জয়নুলের মতো নাইব উদ্দিনের ছবিতে ছিল অদ্ভুত সারল্য ও পরিমিতি বোধ। ক্যামেরা ছোট হওয়ার কারণে যখন ইউরোপে মুহূর্ত ধরবার দৌড় চলছে, নাইব উদ্দিন তখন বাংলায় আপন মনে ছবি তুলে যাচ্ছেন, সময় নিয়ে। তাঁর ছবির মুহূর্ত অনেক স্থির, ভাস্কর্যের মতো।’
জয়নুল-নাইব উদ্দিনের শিল্পকর্মের এক গুরুত্বপূর্ণ আঙ্গিক তুলে ধরেন প্রফেসর ইমেরিটাস ও শিল্পসমালোচক নজরুল ইসলাম। আমার এক প্রশ্নের জবাবে প্রফেসর নজরুল বলেন, ‘সংগ্রাম’ শিরোনামে সর্বাধিক পরিচিত এ কাজটি জয়নুলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম হিসেবে বিবেচিত। নাইব উদ্দিনের ফটোগ্রাফ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে জয়নুল ছবিটি আঁকেন। শুরুতে ছবিটির কোনো শিরোনাম ছিল না। ১৯৭৭ সালে জয়নুলকে নিয়ে যখন বই লিখি তখন আমিই ছবিটার নাম দিই—সংগ্রাম। নাইব উদ্দিনের ছবিটা রিয়েলিস্টিক আর জয়নুলের ছবিটা ইম্প্রেশনিস্টিক ধারার। তবে দুটো ছবিই অসাধারণ। একটা ব্যাপার লক্ষ করলে দেখবে, জয়নুল কিন্তু নাইব উদ্দিনের ছবিটা হুবহু আঁকেননি, এঁকেছেন উল্টো করে।
ফলে ছবির পারস্পেকটিভ ও কম্পোজিশন বদলে গেল। একটা বাস্তব ছবি দেখে মনে যে ছায়া পড়ে, তা ভেঙেচুরে আরেকটা শৈল্পিক রূপ দিতে পারার স্বাধীনতা চিত্রশিল্পীর জন্য এক বাড়তি সুবিধা। আলোকচিত্রীর বেলায় এই সুযোগ সীমিত।’ পেইন্টিং ও ফটোগ্রাফি পাশাপাশি রেখে প্রফেসর নজরুল বলেন, ‘ছবি দুটোর মূল পার্থক্য হলো—নাইব উদ্দিনের গরুর গাড়িতে পাকা ধান আর জয়নুল সেখানে রেখেছেন আস্ত গাছ।’ জয়নুলের টেম্পেরা ও তেলরং মাধ্যমে আঁকা শিল্পকর্মের সূক্ষ্ম পার্থক্যগুলোও তুলে ধরলেন তিনি। বললেন, ‘তেলরঙে অনেক এলিমেন্ট সংক্ষেপ করা হয়েছে। তেলরঙে দেখবে গরুর মুখে, গলায় ও জোয়ালে বাঁধা দড়িটা নাই।’
নাইব উদ্দিনের লেখা, শিল্পসমালোচকদের আলোচনা, বিভিন্ন বইয়ের তথ্য আর সাময়িক পত্রের রিভিউ পর্যালোচনা করে আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি, জয়নুল আর নাইব উদ্দিনের ছবি একই বছরে সৃষ্টি। কোনোটা একটু আগে, কোনোটা পরে। এখন প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক, কে কাকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন? এমন প্রশ্ন জারি থাকুক।