পুরান ঢাকার চিত্রনথি

নানান রঙের গম্বুজের গতরে বাহারি রং ও জাতের পায়রা বৈকালিক রোদে আলস্যযাপনের আড্ডারত। ছাদে বসে একদল শিশু ঘুড়ি ওড়াচ্ছে—পাশে উঁচু মিনার। অজস্র তার আর রঙিন নিশানের মারপ্যাঁচে ঘেরা অলিগলিজুড়ে রিকশা, ফেরিওয়ালা ও মানুষের আনাগোনা। দুপাশে সারি সারি ইমারত। শিল্পী আল-আখির সরকার এভাবেই কখনো পাখির চোখে, কখনো অলিগলির পথে ঘাড় উঁচু করে, পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ও সংস্কৃতিকে কলম, কালি-তুলি ও চোখধাঁধানো রঙের প্রবাহে তথ্যবহুল চিত্রনথি করেছেন। এ চিত্র-নথির পাঠ নিতে হলে যেতে হবে রাজধানীর ভূমি গ্যালারিতে। সেখানে ‘শতবর্ষের ঢাকা’ শিরোনামের প্রদর্শনীতে ঢাকার স্থাপনা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের নস্টালজিক স্মৃতিতে অবগাহন করতে পারবেন দর্শক। তথ্যবহুলতার বিচারে বলা চলে শিল্পী পুরান ঢাকাকে চিত্রে লেখা প্রবন্ধে সাজিয়েছেন।

চিত্রগুলো ইম্প্রেশনিস্ট ধারায় আঁকা। রঙের ব্যবহার, কম্পোজিশন ও উপস্থাপনে পোস্টারধর্মী ভাব রয়েছে। কাঁচা লাল, নীল, হলুদ রঙের ফুটকি আর ফ্লুরোসেন্ট রঙের উজ্জ্বলতার আধিক্যে চিত্রজমিনগুলো দেখতে অনেকটা পানমসলাসজ্জিত পরপর সাজানো মনোহারি দৃশ্যের মতো চিত্তাকর্ষক।

নদী-নৌকা, ডকইয়ার্ড, মাছের আড়ত, বইয়ের দোকান, ফুলের দোকান, বৈচিত্র্যময় খাবার, সরাইখানা, স্কুল, কলেজ, সিনেমা হল—ঐতিহ্যবাহী বাণিজ্যিক এই শহরে কী নেই? সবকিছুই দারুণভাবে ডকুমেন্টেশন করেছেন শিল্পী। ‘শতবর্ষের মঞ্জিল’, ‘শ্যামবাজারের সাকরাইন’, ‘ভিক্টোরিয়া পার্ক’, ‘মোগল স্মৃতি’, ‘শাঁখারীবাজার’, ‘ঢাকা গেইট’, ‘বড় কাটরা’, ‘ছোট কাটরা’, ‘হোসেনি দালান’, ‘ইসলামপুর’, ‘কাগজিটোলা’, ‘চকবাজার’, ‘কার্জন হল’, ‘বিউটি বোর্ডিং’ প্রভৃতি নামের ছবিগুলোতে বৈচিত্র্যময় স্থাপত্যের নিদর্শনই বেশি। শুধু তা–ই নয়, সংস্কৃতিতেও বহমান রয়েছে বহুধারার মেলবন্ধন। বিশেষত বুড়িগঙ্গা নদী অববাহিকায় গড়ে ওঠা জনজীবনে সর্ব ধর্মের সংস্কৃতি রয়েছে। এ জন্যই মন্দির, মসজিদ, প্যাগোডায় ভরপুর পুরান ঢাকা। শিল্পী কালি, কলম, তুলি ও রঙের আঁচড়ে লিপিবিন্যাসের ঢঙে ক্লোজআপ কম্পোজিশনে সাজিয়েছেন এসব তথ্য, যা ঢাকার শতবর্ষের ইতিহাসের ডকুমেন্টেশন হিসেবেই বিবেচনা করা যায়।

ডকুমেন্টেশনের গুরুত্বের বাইরে শৈল্পিক সার্থকতা রয়েছে কিছু কাজে। যেমন ‘ঢাকায় থাকি’, ও ‘ঋষিকেশ দাস রোডের কৃষ্ণচূড়া’ ছবি দুটির গঠন ও বিন্যাসের স্বকীয়তায় পরিচয় মেলে।

‘শতবর্ষের মঞ্জিল’, ‘প্রাণের নদী’, ‘কালের সাক্ষ্য’ প্রভৃতি ছবিতে বুড়িগঙ্গা নদীর মনোহারী দৃশ্যপট দেখলে সমকালের নদীদূষণের প্রতিবাদে মন সোচ্চার হয়ে উঠবে এ কথা বলা যায়। এ ছাড়া ‘ঢাকা গেট’, ‘লোহার পুল’, ‘আংটা ঘর’, ‘নবাব বাড়ি’, এমন অনেক দৃশ্য ঢাকাকে জানতে আগ্রহী করবে। সব মিলিয়ে আল-আখিরের শিল্পকর্ম শুধু পুরান ঢাকার ডকুমেন্টেশনের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, ঐতিহ্য সংরক্ষণেও আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করবে।

প্রদর্শনীটি শেষ হচ্ছে আজ ৩১ জানুয়ারি।

মলয় বালা