প্রদর্শনী দেখা মানে যেন রফিকুন নবীকেই দেখা
‘রনবী’ নামেই তিনি জনসাধারণের কাছে বিপুল সমাদৃত। তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি ‘টোকাই’ সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। ‘টোকাই’ নামটিও তাঁরই দেওয়া। খুব সহজ–সরল ভাষায় মাত্র দু-একটি কথায় টোকাইয়ের মুখ দিয়ে তিনি সমাজের পর্বতপ্রমাণ অসংগতির কথা তুলে ধরেন। এই রনবীই সেদিন কথা বলছিলেন বেশ রসিয়ে রসিয়ে। সেই কথার মধ্যে টোকাইয়ের সেই তীর্যক ও রসাল বাক্য ছিল তো লুকিয়ে–চুরিয়ে।
ইমেরিটাস অধ্যাপক বরণ্যে শিল্পী রফিকুন নবী বা রনবীর ৮০ বছর উপলক্ষে তাঁর ছয় দশকের শিল্পকর্ম নিয়ে এক আনুপূর্বিক প্রদর্শনী একযোগে চলছে এখন জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রদর্শনকক্ষ ও ধানমন্ডির গ্যালারি চিত্রকে। সেই প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শিল্পী আর দর্শকেরা কত কী-ই না বললেন!
জাতীয় জাদুঘরের বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মিলনায়তনে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে রফিকুন নবীর সহপাঠি শিল্পী ও অভিনয়শিল্পী কেরামত মাওলা যেমন বললেন, ‘বন্ধুর জন্য তিনি গর্বিত।’ আবার এখন চারুকলায় পড়ছেন, এমন এক শিক্ষার্থী বললেন, ‘এই প্রদর্শনীতে স্যারের প্রায় সব কাজ আছে। ফলে এ প্রদর্শনী দেখা মানে যেন রফিকুন নবীকেই দেখা।’ আদতেই এ প্রদর্শনীতে শিল্পী রফিকুন নবীর শিল্পীজীবনের কয়েকটি কালের দেখা মেলে। এই গুণীজনের ৮০তম জন্মদিন উদ্যাপনের জন্য ‘শিল্পী রফিকুন নবীর ৮০তম জন্মজয়ন্তী উদ্যাপন কমিটি’ বিস্তারিত কর্মসূচি নিয়েছে। এর আওতায় ৫ নভেম্বর শুরু হয়েছে তাঁর ছয় দশকের কাজের এই আনুপূর্বক প্রদর্শনী।
প্রদর্শনীর উদ্বোধনী পর্বটিও ছিল বেশ ব্যতিক্রমী। ওই দিন বিকেল চারটায় প্রধান অতিথি হিসেবে প্রদর্শনীর উদ্বোধন করার কথা ছিল জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর। আমন্ত্রিত অতিথিরা সবাই সময়মতো এলেও প্রধান অতিথির আসতে বিলম্ব হচ্ছিল অনেক। জানানো হলো, তিনি সরকারি কাজে আছেন। ফলে রীতি বদলে আলাদাভাবে শুরু হলো আয়োজন। সঞ্চালক শিল্পী আফজাল হোসেন, রফিকুন নবীকে মঞ্চে আসার অনুরোধ করলেন। অতিথিদের বললেন মঞ্চে এসে ফুল দিয়ে শিল্পীকে শুভেচ্ছা জানাতে।
ফুলেল শুভেচ্ছা জানানের মধ্যেই শিল্পীর অনুরোধে সভার সভাপতি ও জন্মজয়ন্তী উদ্যাপন কমিটির আহ্বায়ক আসাদুজ্জামান নূর মঞ্চে এসে আবৃত্তি করলেন সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা ‘আমার পরিচয়’।
অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে এলেন প্রধান অতিথি স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। এ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও জাতীয় জাদুঘর পর্ষদের সভাপতি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। আরও ছিলেন চারুকলা অনুষদের ডিন ও জন্মজয়ন্তী উদ্যাপন পরিষদের সদস্যসচিব শিল্পী নিসার হোসেন, জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মো. কামরুজ্জামান ও আয়োজক গ্যালারি চিত্রকের নির্বাহী পরিচালক শিল্পী মনিরুজ্জামান।
‘রফিকুন নবীর মতো একজন গুণীকে সম্মান জানাতে পেরে আমরা নিজেরাই সম্মানিত হয়েছি।’ বলতে বলতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শারমিন চৌধুরী বললেন, ‘শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে জীবনবোধ সৃষ্টিতে এই বরেণ্য শিল্পী অনন্য ভূমিকা রেখেছেন।’ অনুষ্ঠানে তিনি রফিকুন নবীর কার্টুনসমগ্রের চার খণ্ডের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন।
বিশেষ অতিথি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘সমাজের অসংগতিগুলো তুলে ধরে সমাজকে নতুন করে গড়ে তোলার বার্তা দিয়েছেন রফিকুন নবী।’
আর নিজের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়েও রফিকুন নবী কথা বললেন নিজের স্বভাবসুলভ সরস বাচনভঙ্গিতে। তাঁর কথা শুনে মনে হচ্ছিল, যেন টোকাইয়ের কণ্ঠই শুনতে পাচ্ছি আমরা, স্পিকারের উপস্থিতিতে বক্তব্য দিতে গিয়ে বললেন, তাঁর যেন মনে হচ্ছে সংসদে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন।
তবে শিল্পীর সব কথাই কি সরস, মধুমাখা ছিল? একদম নয়। এদিন তিনি বললেন, কিছু কঠিন কথাও, ‘দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক যে অবস্থা, তাতে সহজ মসৃণ জীবন যাপন করা যায় না।’
আর সভাপতির বক্তব্যে আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘শিল্পী তাঁর শিল্পকর্মে মানুষের জীবন, প্রকৃতি, সমাজ বাস্তবতাসহ বাঙালিত্বকে তুলে এনেছেন। দেশকে সমৃদ্ধ করেছেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান যখন শেষ, দেখা গেল, একটি ক্যানভাসের সামনে বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক তরুণ। পাশে দাঁড়ানো তাঁর দুজন বন্ধু। একজন তাঁকে প্রশ্ন করলেন, ‘কী দেখিস অমন বিস্ময় নিয়ে?’ ওই তরুণের উত্তর ছিল, ‘বাংলাদেশের সৌন্দর্য।’রফিকুন নবীর ছবি আসলেই আমাদের সামনে বাংলাদেশকে তুলে ধরে, সেদিনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও যেনবা উঠে এসেছিল এক টুকরো বাংলাদেশ।
জন্মদিনের উৎসব
এই প্রদর্শনী ছাড়াও শিল্পীর জন্মদিন ২৮ নভেম্বর, মঙ্গলবার বিকেলে চারুকলা অনুষদে জন্মদিনের উৎসব হবে। এতে শিল্পীর প্রায় ৯ হাজার কার্টুন, বইয়ের প্রচ্ছদসহ বিভিন্ন মাধ্যমের শিল্পকর্ম নিয়ে সপ্তাহব্যাপী প্রদর্শনী শুরু হবে। এদিন উনসত্তরে ছড়া নামে একটি বইও প্রকাশিত হবে।
যা দেখবেন দর্শকেরা
জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রদর্শনকক্ষে এ প্রদর্শনী ৩০ নভেম্বর এবং গ্যালারি চিত্রকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে। দর্শকেরা শিল্পীর ছয় দশকের বিভিন্ন মাধ্যমের দেড় শতাধিক শিল্পকর্ম দেখতে পাবেন।
১৯৫৭ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় পেনসিলে আঁকা একটি ছবি আছে জাদুঘরে প্রদর্শনীর শুরুতেই। এ ছাড়া এখানে কাঠখোদাই, চারকোল, জলরং, তেলরং,অ্যাক্রিলিকসহ বিভিন্ন মাধ্যমের কাজ রয়েছে।
রফিকুন নবী বিভিন্ন মাধ্যমে বহু নিরীক্ষাধর্মী কাজ করেছেন। নিজেকে কোনো একটি রীতিতে সীমিত রাখেনি। দর্শকেরা তাঁর কাজের ক্রমবিবর্তনের পরিচয় পাবেন প্রদর্শনীতে।