শস্য–সংস্কৃতি–সমৃদ্ধির শিল্পোৎসব

‘হেমন্তের রং–১’। শিল্পী শারমিন আক্তার লিনালেখকের সৌজন্যে

বাংলার কৃষিজ জীবন, উর্বরতা ও সামষ্টিক আনন্দের চিরন্তন প্রতীক নবান্ন। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে আয়োজিত প্রদর্শনীটি ফসল, কৃষিশ্রম ও গ্রামীণ সংস্কৃতির বহুরূপ প্রকাশকে এক শিল্পমঞ্চে রূপ দেয়। এখানে নবান্ন কেবল নতুন ধানের স্বাদগ্রহণ নয়; এটি মাটির প্রতি মানুষের নিবিড় সম্পর্ক, কৃষকের পরিশ্রম ও বাংলার লোক–ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবনের উৎসব। এই প্রদর্শনীতে শিল্পীরা শস্যকে দেখেছেন প্রতীকের ভাষায়—ধানের দোলায়মান শিষ যেন বাংলার অতীত ও বর্তমানের সেতুবন্ধন, কৃষকের হাতের কাদামাখা রেখাচিত্র যেন সংগ্রাম ও আশার চিহ্ন আর নতুন অন্নের ঘ্রাণ যেন এক নবজাগরণের ইঙ্গিত। কাগজে চারকোল, জলরং, ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক মাধ্যমে উঠে এসেছে শস্যের অন্তর্নিহিত নান্দনিকতা।

‘নব’ অর্থ নতুন, ‘অন্ন’ অর্থ খাদ্য। অর্থাৎ নতুন ধান থেকে প্রস্তুত করা প্রথম খাদ্যই নবান্ন। মূলত অগ্রহায়ণ মাসে (নবান্নের মাস) ধান কাটার পর গ্রামে-গঞ্জে যে আনন্দমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হতো, তা-ই আজকের নবান্ন উৎসবের ঐতিহাসিক ভিত্তি। বাংলার কৃষিজীবন যত দীর্ঘ, নবান্ন উৎসবের ইতিহাসও তত পুরোনো। নবান্ন কোনো নির্দিষ্ট সাল থেকে শুরু হওয়া উৎসব নয়, বরং হাজার হাজার বছর ধরে বাংলার মানুষের কৃষি, ঋতুচক্র ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত একটি আদি লোকায়ত ঐতিহ্য। ধানভিত্তিক সভ্যতার আদিম যুগ থেকে শুরু করে আধুনিক বাংলাদেশ পর্যন্ত নবান্ন বিভিন্ন রূপে পালিত হয়ে এসেছে—কখনো ধর্মীয় আচার, কখনো পারিবারিক আনন্দ, কখনো সমবায় সামাজিক মিলনমেলার উৎস হিসেবে।

১ / ৫
‘ধান কাটা‘। শিল্পী হেলাল শাহলেখকের সৌজন্যে

শিল্পী শারমিন আক্তার লিনার ‘হেমন্তের রং-১’ চিত্রটিতে নতুন শস্য ঘরে তোলার দৃশ্য যেন সোনালি স্মৃতিতে ভেজা এক মৌসুমি গান। নারীর কৃষিশ্রম সেখানে শুধু শ্রম নয়, মাটির প্রতি এক নিবিড় মমতা, জীবনের প্রতি এক শাশ্বত আস্থা। শস্য ঘরে তোলার মুহূর্তটি নস্টালজিক পরিবেশে রং ও কম্পোজিশনের নরম খেলায় ফুটে ওঠে গ্রামীণ জীবনের প্রাণশক্তি ও শ্রমের সৌন্দর্য এবং জাগ্রত হয় নতুন আশার সুর।

শিল্পী হেলাল শাহর ‘ধান কাটা’ চিত্রে কৃষকের দৈনন্দিন সংগ্রামের ছাপ ফুটে উঠেছে জলরঙের নরম রেখায়—আকাশের নিচে কৃষকের হাতে বাঁকা কাস্তে, দিগন্তজোড়া ধানখেতের ঢেউ আর মাটির কাছে নত মানুষের নীরব জীবনযাপন।

প্রদর্শনীর সার্বিক ভাবনায় উঠে এসেছে নতুন অন্নের আগমনী সুর, মানুষের পরিশ্রমে বোনা সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি। ‘নবান্ন’ প্রদর্শনী তাই শুধু ছবি নয়; এটি আমাদের স্মৃতিতে ফিরে যাওয়া, শেকড়ের স্পর্শে একটু নত হওয়া এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রকৃতিকে রক্ষা করার নীরব অঙ্গীকার। প্রদর্শনীটি ২১ নভেম্বর শুরু হয়ে শেষ হয় ২৯ নভেম্বর।