আদিকাল থেকেই টিকে থাকার সংগ্রামে মানুষ দুই ভাগে দায়িত্ব ভাগ করে নিয়েছিল—এক দল যেত শিকার করতে, আরেক দল থাকত ঘরে সন্তান দেখভালে। জৈবিক ও সামাজিক নিয়মেই দীর্ঘ সময় ধরে এই কাজের বিভাজন স্থায়ী রূপ নেয়, আর ধীরে ধীরে পুরুষপ্রধান সমাজ ঠিক করতে শুরু করে কোন কাজ নারীর। সহস্রাব্দ পেরিয়ে আজ উত্তর-আধুনিক সভ্যতায় নারী যতই নানা স্বপ্নের সম্ভাবনার জানালা খোলা পায়, কোথাও যেন সেই মুক্ত ডানার উড়াল থমকে যায়; বৈষম্যের রেশ রয়ে যায় সমাজজুড়ে।
নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ১৯০৫ সালে লেখা ‘সুলতানার স্বপ্ন’ গল্পের বইটি ইউনেসকোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড (এশিয়া প্যাসিফিক) স্বীকৃতপ্রাপ্ত। বইটি প্রকাশের ১২০ বছর পর সমাজে নারীদের অবস্থান কত দূর এগিয়েছে, সেই পটভূমিতে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে শুরু হয়েছে ২০ জন শিল্পীর শিল্পকর্ম নিয়ে ‘পুনর্কল্পনায় সুলতানার স্বপ্ন’ শীর্ষক প্রদর্শনী।
গ্যালারির বিশাল আঙিনাজুড়ে বেশির ভাগ স্থাপনা-শিল্পগুলোতে নারীদের অদৃশ্য শ্রমের দৃশ্যায়ন, প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে তাঁদের নিরন্তর এগিয়ে চলা, পুরুষ কর্তৃত্বের এ দেশকে সুলতানার স্বপ্নের নারীস্থান নামক স্থানে রূপান্তরের ইচ্ছা, মাটির গায়ে সে স্বপ্নের প্রত্নতাত্ত্বিক যাত্রা—এ রকম আরও বহুমাত্রিক দৃশ্যায়ন দেখা যায়।
‘সুলতানার স্বপ্ন’ গল্পে নায়িকা সুলতানা ঘুমিয়ে পড়ার পর স্বপ্নে এমন এক দেশে পৌঁছে যায়, যেখানে সমাজের সব ক্ষমতা নারীদের হাতে, আর পুরুষেরা ঘরবন্দী ও পর্দার আড়ালে থাকে। এই স্বপ্নরাজ্যের নাম নারীস্থান। সুলতানা সেখানে ঘুরতে গিয়ে বুঝতে পারে, নারী যদি সুযোগ পায়, তারা নিজস্ব শক্তি দিয়ে পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে। কিন্তু ঘুম ভাঙার পর সে বাস্তব সমাজে ফিরে এসে কষ্ট ও হতাশা অনুভব করে। কারণ, তার পৃথিবীতে নারী এখনো অবদমিত।
এটি ছিল রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের প্রগতিশীল নারীবাদী দুর্দান্ত একটি গল্প, যেখানে সমাজের পুরুষদের ব্যঙ্গাত্মক আলপিনের খোঁচা দেন লেখিকা।
শিল্পীদের চোখে ১২০ বছর আগের বাস্তবতা আর এখনকার বাস্তবতা প্রায় অভিন্ন। ‘সুলতানার স্বপ্ন’ কেবল সামাজিক প্রক্রিয়ার ভেতরই ঘুরপাক খায়—এ পটভূমি নিয়েই সমসাময়িক শিল্পভাষার ছাঁচে ফেলে প্রদর্শনীটি নারীদের স্বপ্ন কেমন হয়, তার এক দৃশ্যমান প্রকাশ। এ যেন অতীতের অন্ধ আঁতুড়ঘরের যে রেশ এখনো সমাজের প্রতিটি কোণে রয়ে গেছে, তা মুছে ফেলার এক দার্শনিক যাত্রাকে সবার সামনে তুলে ধরা।
‘পুনর্কল্পনায় সুলতানার স্বপ্ন’ প্রদর্শনী চলবে আগামী ৭ মার্চ ২০২৬ পর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে।