আলোকচিত্রের নভেরা

কামনা নামের সাপ ভাস্কর্যের সঙ্গে নভেরা। ১৯৭৩।
কামনা নামের সাপ ভাস্কর্যের সঙ্গে নভেরা। ১৯৭৩।

(জন্ম: ২৯ মার্চ ১৯৩৯ মৃত্যু: ৬ মে ২০১৫)

'ক্যামেরা অবসকিউরার চোখ শুধু যান্ত্রিকভাবে দেখে না, সে দার্শনিকভাবেও দেখে।' --—জোনাথান ক্রেরি।

ভাস্কর নভেরার পূর্বপুরুষ এসেছিল চট্টগ্রাম থেকে, ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায় যে প্রদেশকে উত্তাল সমুদ্র জলরাশির গাঙ্গেয় ব-দ্বীপময় কোমল পলিমাটির দেশ বলেছেন। আর এই ব-দ্বীপ রচিত হবার প্ররোচনায় ভূমির ভেতরে তৈরি হতো অতল খাদের প্রতিবিম্ব, উপসাগর সরে গেলে নরম পলির স্তরে অখণ্ড নম্য গড়নের অবয়ব ফুটে থাকত, সেখানে এমন একটি ভাস্কর্য-প্রবণ ভূমির দিগন্তে ছিল নভেরার পূর্বপুরুষের আবাস। মনে করা যেতে পারে সমুদ্রের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ অনিশ্চিত প্রকৃতি নভেরার মনন গঠনে ভূমিকা রেখে থাকবে। পরবর্তী জীবনে নভেরা যে পেশা বেছে নিয়েছিলেন, তার প্রস্ফুটনের বীজ প্রোথিত ছিল এই ভৌগোলিক বিন্যাসের প্রবাহে, যা ছিল খানিক প্রতিকূল এবং নবোদ্গত।


পঞ্চাশের দশকের বাংলা তখন এক পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। একদিকে সাম্প্রদায়িকতার দাঙ্গায় দেশভাগ-পরবর্তী মুমূর্ষ জনপদ জীবন, অন্যদিকে পরাধীন রাষ্ট্রে সাম্য স্বাধীনতা আর নিজ ভাষার জন্য যুদ্ধ ছিল বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন। তার কিছুদিন পর নভেরা ফিরেছিলেন পশ্চিমা দেশ থেকে ভাস্কর্যবিদ্যা পড়া শেষ করে, যে সৃষ্টির উৎকর্ণ প্রয়াস ছিল তাঁর কাজে, তাঁর ভাস্কর্যের গঠন-সৌষ্ঠব বা ভাস্কর্য মাধ্যম/উপাদান অনুষঙ্গে। আমরা তার শিল্পকর্ম বিশ্লেষণ করতে পারিনি কোনো দিন। এ শহরে মুক্তাঙ্গন ভাস্কর্য কেউ এর আগে দেখেনি। শিল্পী জয়নুল আবেদিনের প্রয়াসে অনুদান পেয়ে তিনি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের দেয়ালে নির্মাণ করেন প্রথম ম্যুরালচিত্র। শিল্পী বন্ধু হামিদুর রাহমানের সঙ্গে ভাষা আন্দোলনের জন্য স্মৃতিসৌধের শহীদ মিনারের নকশা প্রণয়ন করেন। একক প্রদর্শনী করেন, পুরস্কার পান। এসবই ছিল পূর্ব বাংলার দিগন্তে অসামান্য সব ঘটনা।


নভেরা এ দেশ ছেড়ে চলে গেলে বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গনে অদৃশ্য হয়ে পড়েন রাতারাতি। তারপর নানা সময় নভেরা নয়, তাঁর আলোকচিত্র আসে আমাদের কাছে।


সেখানে আমরা দেখেছি তাঁর ভাস্কর্য নির্মিত হতে, কারখানার উৎপাদিত পণ্য ব্রোঞ্জ বুনটে। যেখানে ব্রোঞ্জ কখনো তার শিল্পের ফর্মের চেয়েও হয়ে উঠেছে বাঙ্ময়। যে সঙ্কর ধাতু নিজেই শিল্পইতিহাসের স্মারক, সেই সঙ্কর ধাতু দিয়ে নভেরা ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। তাঁর ভাস্কর্যের ব্রোঞ্জ জং ধরা, চটে যাওয়া রং একধরনের আকস্মিক বর্ণস্পর্শময় নৃশংসতাকে প্রকাশ করে। তাঁর ভাস্কর্যের সঙ্কর-দেহে রয়েছে নিষ্প্রভ খরতা আর কর্কশতা। সেই প্রাণের বর্ণহীন সংবেদ আর দ্রবীভূত হবার নম্য ক্রীতদাসতুল্যতা যেন হয়ে উঠেছিল শিল্পীর স্বাধীন চিন্তার অনুষঙ্গ। ক্রমে দগ্ধ, ভুমিচ্যুত,অনিকেত অনান্দনিক এক পৃথিবী উদ্ভাসিত হয় নভেরার ভাস্কর্যে। ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞানে এই সঙ্কর ধাতুর পৃষ্ঠতল অগ্নিময় ক্রোধ, অবঘাতের শূন্যতা, কোথাও বিক্ষুব্ধ সত্যেরও উন্মোচন করে। আবার কোথাও তাঁর ভাস্কর্য ফর্মগুলো প্রলয়ের সংঘাতে ত্রস্ত স্বরে বলতে চায়, যা কিছু সুন্দর তা আসলে মর্মরে কারুময় নয়। যেন অকস্মাৎ উন্মোচিত হৃদয় নখর দংশনে খুবলে নেওয়া, তাঁর ভাস্কর্যের ক্ষুরধার অভিপ্সার আর্তি আপাতদৃষ্টে বিজন, ক্লিন্ন, বিষাদময়। এভাবে তাঁর ভাস্কর্যের প্রকৃতি শিল্প ও নন্দনতত্ত্বের পণ্যতুল্য প্রলোভনের পৃথিবীকে পরিত্যাগ করে।


আমরা ধরে নেই নভেরার কাছে এই ব্রোঞ্জ ধাতুর নিবিড় সেঁটে থাকা, অবিরল মসৃণতা, দীপ্রতা, স্ফুলিঙ্গপ্রতিম দগ্ধতা একটি অপরিহার্য শিল্পলক্ষণযুক্ত ভাস্কর্য উপাদান ছিল। নভেরার হাতে এই দ্রব্যের নানাবিধ আকার হতে বাধা ছিল না কোনো, নিরীহ যার প্রদোষকাল কিন্তু নবোদ্গত স্বাধীন সোচ্চার দাবানল যার স্পৃহা। বাতাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে দৃঢ়, দর্শকের মননে অবিকল নভেরার প্রতিচ্ছবি এই সঙ্কর ধাতু। সুতরাং এই ভাস্কর্য পর্বে নভেরা যেন কারিগরী দক্ষতার দিন শেষ বলে শামিল হলেন সমাজতন্ত্র প্রয়াসী একদল বিপ্লবী রুশ শিল্পী তাতলিন, রদচেঙ্ক, ইয়ভস ক্লেইন, মেলেভিচদের কাতারে।


তাঁর আলোকচিত্রের মধ্যে অদৃশ্য নভেরাকে আমরা স্পর্শ করেছি। নভেরা আমাদের সমাজে, শিল্প পরিমণ্ডলে অনন্য একজন ব্যক্তিত্ব। তাঁর কালো জামা গায়ে রুদ্রাক্ষের মালা পরিহিতা ছবিটি এ বাংলায় এক বর্ণিল স্মৃতির পালক, যেন আলো প্রতিস্মারক ত্বক ছিল তাঁর, দুর্বিনীত দৃষ্টি খানিক উদাসীন, অনতিক্রম্য রেখার মতো কৃষ্ণবর্ণ চোখ। তাঁর ব্যক্তিত্বের আভিজাত্য ছিল চমকপ্রদ। তিনি যেন তাঁর ভাস্কর্য থেকেও দিগুণ আলো বিকীর্ণ করেছেন এ বাংলায়। দর্শকের সঙ্গে তাঁর অনন্য সম্পর্ক তৈরি হয় এই আলোকচিত্রের মধ্য দিয়ে। দর্শকের কাছে তাঁর ছবি জীবন্ত হয়ে ওঠে, তাঁর ছবি সংলাপে রত হয়। একসময় তাঁর ছবিই মূলত হয়ে ওঠে তাঁর অস্তিত্ব।


নভেরার জন্ম, তাঁর বেড়ে ওঠার পৃথিবী তেমন করে জানা ছিল না কারও। তাঁর কাছের-দূরের বিভিন্ন জনের অভিজ্ঞতার ছেঁড়া ছেঁড়া গল্পে বর্ণিত তাঁর জীবন। অকস্মাৎ তিনি যেন আবির্ভূত হয়েছিলেন একটা অসম সমাজে, যেখানে একজন নারী শিল্পীর স্বাধীন অস্তিত্ব ছিল বিঘ্নপূর্ণ। নভেরা খুব দ্রুতই উপলব্ধি করে থাকবেন, পুরুষতান্ত্রিক বলয়ে তখনকার শিল্পচর্চার পরিসর ছিল আবদ্ধ এবং স্বপ্নহীন। কাছের বন্ধুদের সহযোগিতায় সাময়িকভাবে কিছু কমিশনের কাজ করলেও তিনি আপোষহীন শুদ্ধ জীবনের সংকল্পে অচিরেই এই স্থান পরিত্যাগ করেছিলেন। প্রয়োজনে সামাজিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন, সবার অলক্ষ্যে নিভৃত জীবন বেছে নিয়েছিলেন।


এ বাংলায় থেকে যায় শুধু তাঁর কিছু আলোকচিত্র আর শিল্পকর্ম। তার ছবি যেন তার সঙ্গে দর্শকের একধরনের সেতুবন্ধন, দর্শক তাঁর আলোকচিত্রের সঙ্গে নানা রকম সংলাপে রত হয়েছিল। শিল্পকলার দৃষ্টি বলে আলোকচিত্রের যন্ত্র থেকে যে রশ্মি উদ্ভাবিত হয়ে নভেরার শরীরের সিল্যুয়েট তৈরি করে, সেটা দর্শককেও আকাঙ্ক্ষার মায়াজালে বেঁধে রাখে। শুধু ছবির আলোটা থাকে শরীরহীন, অপার্থিব। সেই আলোটা একসময় দর্শকের কাছে পার্থিবতার প্রতিরূপ হয়ে ওঠে।


নভেরার ছবিতে প্রাচীন গাছপালাঘেরা একটা উঠোন হয়ে ওঠে আমাদের পুরোনো চেনা শহরতলি ষাটের দশকের ঢাকার একটুকরো স্মৃতিফলক। সেই ঔপনিবেশিক হলুদ রঙের দালান ঘিরে বুনো লতার ঝোপের পাশে নভেরার ছবিটি যখন দেখছি, তখন সেই শহর আর নেই, সময়টিও নেই। আর এভাবে ছবিটি যেন একধরনের ঐতিহাসিকতা পায়। ছবির সঙ্গে আর যা কিছু জড়িয়ে থাকে—পুরোনো গাছের বাকল, ক্রান্তীয় রৌদ্রদগ্ধ আর্দ্র-তপ্ত নীল আকাশ আর বিস্মৃতপ্রায় ষাট দশকের বিবর্ণ জনপদের এক সুচারু কৃশতা। ১৯৫৬ সালের ঢাকার কোনো এক বিকেলবেলার অত্যাশ্চর্য সবুজ পাতার বিস্মরণের মতো নভেরার আনত অন্যমনস্ক ভঙ্গিটি যেন পিকচারেস্ক নিসর্গ হয়ে ফুটে থাকে দর্শকের হৃদয়ে, দর্শককে যা স্নাত করে।


নভেরার ছবি যেন মেঘবার্তা। তাঁর ছবিতে আমরা খুঁজে পাই উনিশ শতকের দেশভাগ-উত্তর বিপন্ন জনপদে এক নারী ভাস্করের আবির্ভাব, উত্থান, তাঁর সংগ্রাম, এবং নির্বাসনের মতো অজ্ঞাত বিষাদময় গল্পের সত্য ভুমি। তাঁর ছবিতে তাঁর জীবন যেন দৃশ্য-গন্ধের এক গভীর প্রদেশ তৈরি করে দর্শকের হৃদয়ে। এভাবে শেষমেশ নভেরার ছবির সত্য জায়গা হয়ে ওঠে দর্শকের মন।


যে দেশ স্বাধীন হয়েছিল ১৯৭১ সালে, সেই আত্মপরিচয়ের ভাঙন ও উন্মোচনের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের স্বদেশে নভেরা কোনো দিন ফিরে আসেননি। এ বাংলায় দর্শক নভেরাকে আর কোনো দিন দেখেনি। শুধু ছবিতেই দেখা তাঁর ভাস্কর্য, তাঁর অন্যমনস্ক তাকিয়ে থাকা অথবা তাঁর বাড়ি বদলে যাওয়া, এমনকি তাঁর মৃত্যুদৃশ্যও ছবির মাধ্যমে হাজির হয় দর্শকের কাছে। শিল্প-ইতিহাস বলে, আলোকচিত্রে স্পর্শগ্রাহ্যতার একমাত্র পথ হলো আলোক-রশ্মি। বাস্তবিকভাবে যে রশ্মি নভেরার অবয়ব স্পর্শ করেছিল, তা আলোকচিত্রীর মধ্য দিয়ে দর্শকের অম্লান চৈতন্যধার হয়ে উঠেছিল একসময়।


দর্শকের মনোজগতে নভেরার আলোকচিত্র বেঁচে আছে প্রায় অর্ধশতকজুড়ে এ বাংলায়। তাঁর ছবির দিগন্তপ্রসারিত বৃক্ষশাখা, তাঁকে ঘিরে থাকা আন্দোলিত স্মৃতির বাতাস, অনুপম উদ্ভিদ মঞ্জুরি নিয়ে উনিশ শ পঞ্চাশের ছবির ফ্রেমের উদ্ভাসে নভেরা দুই হাজার বিশ সালেও জীবন্ত থেকে যান। দর্শকের কাছে এই ছবি তাঁর উপস্থিতি এবং অদৃশ্যমানতা দুটোই।

নভেরা আহমেদ, এক্সিবিশন ক্যাটালগ।
নভেরা আহমেদ, এক্সিবিশন ক্যাটালগ।

নভেরার আলোকচিত্র যেন আকস্মিকতা, পিকচারেস্ক ভূস্বর্গের মতো ভুলে যাওয়া নভেরাকে হঠাৎ পাওয়া। তাঁর প্রতিকৃতির মধ্যে যে স্পেসের সংলগ্নতা, ছবির ভেতরে যে আলো নভেরাকে ঘিরে রেখেছে, যে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে তিনি ছবিটি তুলেছিলেন, তাকে ঘিরে থাকা সবুজ বনানী, সেই উনিশ শ ষাটের আকাশ, সেই সূর্যরশ্মিবিন্দু, সেই সিল্যুয়েট, এমনকি তাঁর প্রদর্শনী দেখতে আসা মানুষগুলো—যদিও ছবিতে নেই কোথাও, কিন্তু তাঁদের সমেত আমরা ছবিটি দেখি। আমাদের অবচেতনকে যা দিয়ে জাগিয়ে রাখে, তা নভেরার ছবির ফ্রেমে নেই। আলোকচিত্রের সময়টিও নেই, মানুষটিও হারিয়ে গেছে, তাই এই ছবি দুঃখ দেয়। দর্শক নভেরাকে ঘিরে একটি নন্দনতাত্ত্বিক শোক রচনা করার প্রয়াস পায়। ছবিতে তাঁর তাকিয়ে থাকার মধ্য দিয়ে দর্শক তার মধ্যে প্রবেশ করে, স্পর্শ করে, যা কিছু নভেরার অভিব্যক্তির অতিন্দ্রীয়তা, ব্যক্তিত্বের ঔজ্জ্বল্য, যেখানে নভেরার আলোকচিত্রের রশ্মি অঙ্গীভূত হয়ে থাকে দর্শকের শরীরেও।

শিল্প-ইতিহাসের দৃষ্টিতে ক্যমেরার লেন্স অপটিকস/সিল্যুয়েট-দর্শন
জোনাথন ক্রেরি তাঁর 'সাসপেনশন অব দ্য পারসেপশন'-এ বলেন, ক্যামেরা অবসকিউরার লেন্সের চোখ একটি ত্রিভুজাকৃতি ডায়াগ্রামের মধ্য দিয়ে আবির্ভূত হয়। ছবি তোলার সময় সে বিষয়ের সঙ্গে বা প্রতিকৃতির সঙ্গে অন্য যা কিছু দ্রব্যবাচকতা/পণ্যবাচকতা, তাকেও সম্পৃক্ত করে। ইমানুয়েল কান্ট বলেন, অবচেতনের দেখাকে পার্থিব দেখায় রূপান্তর করে ক্যামেরার লেন্স। তিনি বলেন, আলোকচিত্রের ক্যামেরার পর্দার মধ্য দিয়ে মানুষের অভিপ্রায়, প্রেম, দুঃখ সবই দৃশ্যমান হয়, যখন ক্যামেরার সিল্যুয়েট এক বিন্দুর পরিপ্রেক্ষিত আলোর বিন্দু থেকে দৃশ্যমান হয় ত্রিভুজাকৃতির রেখাচিত্রের নিরালম্ব শূন্যতায়। ক্যমেরার সেই ঘরে যখন অবচেতনের গভীর অভীপ্সার কোনো প্রতিবিম্ব পড়ে, তখন স্ফটিক আলো স্ফুলিঙ্গ আকারে নিঃসৃত হয়ে একটি প্রতিকৃতির জন্ম দেয়।

ক্যামেরা অবসকিউরা, (আলোকচিত্র যন্ত্র আবিষ্কার)
ক্যামেরা অবসকিউরা, (আলোকচিত্র যন্ত্র আবিষ্কার)

 ক্যামেরার লেন্স সব সময় না-দেখা ভুবনের গল্প বলে
ফরাসি দার্শনিক রোলা বার্থ তাঁর বহুল আলোচিত বই 'ক্যামেরা লুসিদা'তে বলেছেন, ক্যামেরার চোখ সব সময় না দেখাগুলোকে দেখতে চায়, যা তার সামনে নেই, ক্যামেরার লেন্সের প্রধান আকর্ষণ সেই অদৃশ্য দিগন্ত। অজ্ঞাত অনুষঙ্গের খোঁজে থাকে সে, যে না দেখতে পাওয়া দিগন্তের প্রতিফলিত অস্তিত্বের মধ্যে আসলে সত্য পৃথিবী বাস করে। ক্যামেরা সেই অদেখা ভুবন দেখে। যা দেখা যায় না কিন্তু দৈবজ্ঞ বলে তাঁর অন্তহীন দৃপ্ত পদচারণের রশ্মি জ্বেলে রাখে সে, ক্যমেরার লেন্স সেই বিদেহী তরঙ্গকে দর্শকের সামনে এনে দিতে চায়। তাই ক্যামেরা অবসকিউরার লেন্স শুধু যান্ত্রিকভাবে দেখে না, তার রয়েছে মন। সে ক্রমাগত দার্শনিকভাবে মানুষের দৃষ্টি আর সত্য পৃথিবীর নিবন্ধন করে চলে।


তাই নভেরার আলোকচিত্রের মধ্যে বয়ে যাওয়া বাতাস যেন সোনালি শাঁসের সুতো, অম্লান আলোর সেই উনিশ শ পঞ্চান্ন সালের কোনো এক বিকেলবেলার কাশমঞ্জরির সৌরভ নিয়ে প্রবাহিত হয় দর্শকের হৃদয়ে। দর্শক এক না-দেখা নভেরাকে দেখেন, যাতে তাঁদের মনে হতে থাকে নভেরার অদৃশ্যতাই ছিল নভেরার শক্তি।


ধরে নেওয়া যায়, ক্যামেরার প্রতিক্ষেপক প্রযুক্তি তাই দেখাতে পারে নভেরার নভেরা হয়ে ওঠাকে। এই দেখা আলোকচিত্রী তৈরি করেন না হয়ত, এই দেখার উৎপত্তিস্থল দর্শকের মন, যা নভেরাকে ঘিরে ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে প্রবহমান। তাঁর আলোকচিত্রের মধ্যে তাই দর্শকের বিস্মিত হৃদয় জেগে থাকে, একদিন সেটিও নভেরার ছবির সঙ্গে ফ্রেম-বন্দী হয়, এবং একসময় ফ্রেম ছাপিয়ে নভেরা হয়ে ওঠেন রক্তমাংসময় অস্তিত্ব। দর্শকের প্রেমাসিক্ত হৃদয় অধিকার করে রাখে যে নভেরা, তা আসলে ফ্রেমের বাইরের পৃথিবী।

ভাস্কর নভেরা আহমেদ।
ভাস্কর নভেরা আহমেদ।

যে নভেরাকে দর্শক উনিশ শ পঞ্চাশ বা ষাটের দশকেও কোনো দিন দেখেনি, সেই নভেরা জীবন্ত থাকে দর্শকের কাছে, ফরাসি দেশে নভেরার বয়স উত্তীর্ণ হয়, কিন্তু বাংলায় সে থাকে উষ্ণ তরুণ প্রাণ। এভাবে নভেরার আলোকচিত্রে দর্শক এক নব্য স্পেসের দেখা পায়, দর্শক যা যা দেখতে চান, তাঁর উনিশ শ পঞ্চাশ কিংবা তাঁর উনিশ শ বাষট্টি, তনি তা তেমনি দেখতে পানি। নভেরার দেখাকে তিনি যেভাবে দেখাতে চান, তাঁর সেই অখণ্ড মনোভঙ্গির দিকে দর্শকের ঝোঁক প্রবল হতে থাকে। দর্শক যেন নিজেই নিজের আরেকটি সত্তায় রূপান্তরিত হন একসময়, এবং তিনি নভেরার একটি প্রতিকৃতি বানান। দার্শনিক জ্যাক দেরিদা যেমন বলেছিলেন, 'একটি আলোকচিত্রে যখন আমার তাকিয়ে থাকা তোমার তাকিয়ে থাকা দেখে, চকিত আমি তখন আসলে তোমাকে স্পর্শ করি, আমি তখন চোখ দিয়ে তোমার চোখের পাতা স্পর্শ করি। তোমার জীবন পানে আমি তখন এগিয়ে যেতে থাকি।'
আলোকচিত্রের দর্শন বলে, নভেরার নিজেকে ছবিতে দৃশ্যমান করার আগে পর্যন্ত তাঁর কোনো অস্তিত্ব ছিল না। আবার অন্যদিকে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবার আগে তিনি নভেরা ছিলেন কিন্তু তারপর তিনি ছবি হবার সঙ্গে সঙ্গে পরিণত হন একটি আখ্যান কাব্যে, একটা স্মৃতির ফ্রেমে, একটি মিথের শরীরে। যখনি তিনি প্রতিকৃতি হন তক্ষুনি তিনি তাঁর নিজের ব্যক্তিত্ব থেকে বিচ্যুত হন। সেখানে নিশ্চিহ্ন হয় তাঁর বাস্তব অস্তিত্ব। তাই সংশয় হয়, ক্যামেরার লেন্সের সামনে নভেরার যে অভিব্যক্তি, সে পরিচয়ে আসলে তাঁর নিজের অবদান থাকে কতখানি? আলোকচিত্রী যেভাবে তাঁকে দেখাতে চেয়েছিলেন, সেই নভেরাই কি শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছেন দর্শকের হৃদয়ে? এভাবে নভেরা একদিন আলোকচিত্রীর নান্দনিক পরিভাষার স্মারক, পণ্যতুল্যতার নিদারুন প্রতিচ্ছবিতে পরিণত হন।


একসময় নভেরা যখন নিজে জানতে পারেন যে তিনি আলোকচিত্রের বিষয়, মিডিয়ার আকর্ষণ, তিনি দ্রব্যবাচক/পণ্যবাচকতার সমতুল্য কিছু, যাঁর কাজের চেয়ে পণ্যমানতা বা নারীবাচকতাই অগ্রগণ্য হয়েছে বেশি, তখন কি নভেরার সত্য অবয়বের মৃত্যু হয়? যে নভেরা এপিক হয়েছেন, ফিরে ফিরে এসেছেন দর্শকের কাছে বারবার, তিনি কি ছিলেন তবে শুধু এক ছায়ামূর্তি?


নভেরার সেই আলোকচিত্রের অবয়বে তাঁর ভাস্কর হিসেবে আবির্ভাব, তাঁর তপস্বীর বেশ, তাঁর দেশ-ত্যাগ ইত্যাদি গল্পগুলো বেঁচে থাকে। ক্যামেরার সিল্যুয়েটের দিগন্তে তাঁর সমস্ত জীবন এভাবে ধরা পরে। ছবিতে তাঁর নৈর্ব্যক্তিক অভিব্যক্তি, ছবি তোলার মুহূর্তেও তিনি শৈল্পিক, অন্যমনস্ক, দুস্তর। ছবি তোলার মুহূর্ত আর দর্শকের ছবিটি দেখার সময় কখনোই এক হয় না বলে সমস্ত আলোকচিত্রের ঘটনা মূলত অতীত, তাই সেখানে এক দৈব, বিস্মরণ আর আকস্মিকতার অচেনা দিগন্ত জেগে থাকে।

ভাস্কর নভেরা আহমেদ।
ভাস্কর নভেরা আহমেদ।

উনিশ শতকের বায়োপলিটিকস/নভেরা গেইজ
গত শতকে পৃথিবীতে 'বায়োপলিটিকস' শব্দটি অবরুদ্ধতার প্রতিশব্দ হিসেবে চর্চিত হয়েছে বারংবার, যা দার্শনিক মিশেল ফুকো প্রথম ব্যাখ্যা করেন। আমরা দেখতে পাই এ বাংলায় শিল্পী নভেরা সেই বাস্তবতাকে ষাটের দশকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। নভেরার আলোকচিত্রের অভিব্যক্তি সেই সাক্ষ্য দেয়, তাঁর দর্শককে তিনি বলেন, সাংস্কৃতিক বস্তু পণ্য হয়, তাঁর ভাস্কর্যকে পণ্যদ্রব্যের মত তাঁর নিজের আলোকচিত্রের সঙ্গে ব্র্যান্ডিং করা হয়েছিল। মানুষ যেমন করে প্রভু হয় দাস-সম্পত্তির, শিল্প-সম্পত্তির, নভেরাও একরকম সম্পত্তি হিসেবে সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবরুদ্ধতার প্রতীক হয়ে ওঠেন এ বাংলায়।
নভেরার স্বাধীন জীবনযাপন, তার ব্যক্তিগত পোশাক-পরিচ্ছদ, তাঁর শিল্প অন্বেষণ, তাঁর ভাস্কর্য আমরা আজ স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে দেখলেও পঞ্চাশের দশকে একজন নারী শিল্পীর আত্ম-প্রতিষ্ঠার বিদ্রোহ, দৃঢ়তা, সৃজনশীল পৃথিবী কিছুতেই মানব-স্বভাব বলে বিধৃত হয়নি। এসবকে কেউ তাঁর জৈবিক বা সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারও ভাবতে পারেনি। তিনি ছিলেন বিপ্রতীপ শক্তির বিপরীতে ক্রুদ্ধ দাবানল। তাঁর সত্য অন্বেষণ, স্বয়ংসম্পূর্ণ আধুনিক মানুষের মতো আপোষহীন জীবনযাপন, যা অন্যদের কাছে রোমাঞ্চকর হিসেবে প্রতিপন্ন হয়েছিল। একজন সুন্দর নারী শিল্পীর জীবন সংগ্রাম শুধু আখ্যানের পুঁজি হয় এ বাংলায়। তাই নভেরার আলোকচিত্র তাঁর ভাস্কর্যের মতোই আমাদের শিল্প-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে মোহনীয় প্রতিকৃতির মর্যাদা পায়। তাঁর জীবনের নানাবিধ ব্যক্তিগত ঘটনা দর্শকের অন্বেষণের গ্রন্থনা হয়, নভেরার ছবিতে তাঁর বিষাদময়তা, তাঁর নৈর্ব্যক্তিকতাও এভাবে এক নান্দনিক পাঠ হয়ে ওঠে সমাজে।
শিল্প-ইতিহাসের দৃষ্টিতে তাঁর গেইজ বলে, আমি জানি, তুমি জানো যে আমি জানি।


তাঁর আলোকচিত্রের আখ্যান হয়ে ওঠে আমাদের শহরের সামাজিক ইতিহাস। তাঁর অভিব্যক্তির অন্তরালে ধ্বনিত হয়, এ দৃষ্টি স্নিগ্ধতার বদলে সত্য অনুসন্ধানে দৃঢ়।


ভাস্কর নভেরা আহমেদ।
ভাস্কর নভেরা আহমেদ।

নভেরা নিয়ে অমরগাথা
শিল্পী নভেরাকে নিয়ে নানা গল্প রচয়িত হয়েছে এ বাংলায়। তাঁর বন্ধুদের স্মৃতিচারণায় নভেরা চিরকালের অধরা হিসেবে বর্ণিত হয়েছেন। এক দ্বীপে বাস করেও অনপনেয় দূরত্বের সংবেদনে তাঁদের জীবনে শেষমেশ নভেরা বিমূর্ত, রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার স্মারক হিসেবে থেকে গেছেন। সমকক্ষ শিল্পী বন্ধুদের কাছেও তিনি অস্পষ্ট, রহস্যময়। তাঁর শিল্প-ইতিহাস গ্রন্থনাতে নভেরাকে নিয়ে অন্যদের রচিত ডায়েরি, জার্নাল, গল্প, কাছের বন্ধুদের স্মৃতিচারণায় তাঁর একটি অবয়ব তৈরি হতে দেখি। একদিকে মনে হয় যেন তাঁর প্রতিবিম্ব, প্রতিকৃতি বা ব্যক্তিত্বের আর কোনো সৃজনশীল প্রণোদনা ছিল না মোহনীয় সৌন্দর্য ছাড়া। এ দেশে তাঁর একমাত্র অনুপেক্ষণীয় গুণ ছিল তাঁর ব্যক্তিগত জীবন। অন্যদিকে নভেরার চৈতন্যের ঐক্যসূত্রকে, তাঁর মাতৃভূমি পরিত্যাগ করাকে সমবেদনার প্রসন্নতায় বর্ণিত হতে দেখেছি। তাঁর কীর্তির চেয়ে, তাঁর শিল্পের চেয়ে বড় হয়েছে তাঁর নারী জীবন।

ভাস্কর নভেরা আহমেদ, সম্ভাব্য ১৯৭০ সাল।
ভাস্কর নভেরা আহমেদ, সম্ভাব্য ১৯৭০ সাল।

নভেরার আলোকচিত্রে দর্শক
দর্শক আলোকচিত্রের মধ্যে দিয়ে নভেরাকে আবিষ্কার করেছেন যেমন, তেমনি একসময় এ গল্পের কথকও হয়ে উঠেছে দর্শক। দর্শকের অবচেতনে নভেরার অস্তিত্বকে শিল্প-ইতিহাসের ভাষায় বলে, 'পিগম্যালিয়ান প্রচ্ছায়া, যা তাঁর ছবির অভিব্যক্তিতে ফুটে ওঠে, যা রক্তমাংসময়, উষ্ণতর, এবং কখনো বিষাদময়; আর এসবই তাঁর স্বায়ত্তশাসিত ব্যক্তিত্বের সাক্ষ্য হয়ে ফুটে থাকে। ধনতান্ত্রিক বুর্জোয়া পৃথিবীর পণ্য সংস্কৃতিতে নভেরা যেন ছিলেন এক দুরতিক্রম্য শৃঙ্খল এবং অনমনীয় অভিব্যক্তির প্রপঞ্চ। কে কাকে তৈরি করেছে? নভেরাকে দর্শক, নাকি দর্শককে নভেরা? তাঁর আলোকচিত্রের ভঙ্গিতে সজীব দীপ্রতা, তাঁর স্বকীয় শিল্প-স্পৃহার অজ্ঞাত তপস্বিনী রূপটি দর্শকের কাছে ছিল মুগ্ধকর। তাঁর স্বাধীন জীবনযাপন, ব্যক্তিত্বের বর্ণিল দাহ্যতার ইন্ধনে ছিল বাস্তব একজন শিল্পীর বিকীর্ণ প্রভা, যা ছিল অনেকটা দর্শকের কাছে তাঁকে অনুধাবনের সাঁকো। নভেরার ছবিতে কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন সব সময় দর্শক।