কিবরিয়ার পারাপার: বীরভূম থেকে ঢাকা

মোহাম্মদ কিবরিয়া (১ জানুয়ারি ১৯২৯-৭ জুন ২০১১)
মোহাম্মদ কিবরিয়া (১ জানুয়ারি ১৯২৯-৭ জুন ২০১১)
>চিত্রকর্মকে আত্মপ্রকাশের মায়াময় আশ্রয় হিসেবে দেখেছেন কিবরিয়া। প্রকৃতির অন্তর্গত জীবনকে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন ক্যানভাসে। এ ছাড়া দুনিয়ার প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার যথোপযুক্ত মাধ্যম হিসেবেও একে গুরুত্ব দিয়েছেন।

বাংলাদেশের বিমূর্ত চিত্রকলার অন্যতম পথিকৃৎ শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া। প্রসঙ্গত এবং ঐতিহাসিক কারণে এখানে উল্লেখ করতেই হয়, বিমূর্ত চিত্রকলার প্রথম রূপকার ছিলেন শিল্পী আমিনুল ইসলাম। তারপর কিবরিয়াও বিমূর্তধারায় কাজ শুরু করেন। তাঁরা দুজনই এ দেশের বিমূর্ত চিত্রকলার অ্যাভাঁগার্দ শিল্পী। কিবরিয়া আজীবন বিমূর্ততার ধ্যানে কাজ করে গেছেন। অন্যদিকে আমিনুল আমৃত্যু ছিলেন নিরীক্ষাপ্রবণ। বোধ হয়, কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ বলে এ বিষয়টি শিল্পতাত্ত্বিকেরা কৌশলে এড়িয়ে যান। শিল্পের রাজনীতিও নিষ্কণ্টক নয়। এখানে অনেক পেরেশানি, দহন ও রক্তক্ষরণের দাগ লেগে আছে। এ লেখার মূল প্রসঙ্গ কিবরিয়া বিধায় যৌক্তিকতার নিরিখে এখন সেদিকে ফোকাস করছি।

মোহাম্মদ কিবরিয়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গ জেলার বীরভূমে ১৯২৯ সালের ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। এই বীরভূমের মাটিতেই তিনি বেড়ে ওঠেন। তাঁর বাবা মোহাম্মদ রফিক ও মা সায়েরা বেগম। বড় ভাই মোহাম্মদ আরিফ। খুব অল্প বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। তাঁর পিতার একটি ছোট প্রেস ছিল। পিতার মৃত্যুর পর বড় ভাই আরিফ সেটির দায়িত্ব নেন।

ছেলেবেলায় স্কুলে পড়ার সময়ই চিত্রাঙ্কনে কিবরিয়ার হাতেখড়ি হয়। সেই সময় বীরভূমে প্রতিবছর কৃষি মেলা হতো। ওই মেলা ঘিরে কিবরিয়ার কৈশোরের একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা রয়েছে। সেটি হলো, বীরভূম জেলা স্কুলের শিক্ষার্থীরা প্রতিবছর কৃষি মেলার চিত্র প্রদর্শনীতে ছোট আকারের কাজ নিয়ে হাজির হতো। কিবরিয়াও বেশ কয়েকবার এ মেলায় অংশ নেন। একবার, মৃত্যুর মাস ছয়েক আগে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এলেন ওই মেলায়। বলাই বাহুল্য, তাঁর আগমণে কৃষি মেলাটি অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠল। কিবরিয়া তখন ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণির ছাত্র রবীন্দ্রনাথের সৌম্য শান্ত অবয়ব চাক্ষুষ করেন তিনি। সেদিনের এই ঠাকুর-দর্শন কিশোর কিবরিয়ার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। এর প্রভাব তাঁর সারা জীবনের কাজ ও জীবনযাপনে বিশেষভাবে প্রতিভাত হয়েছে।

স্কুলজীবনে শিল্পচর্চার অভিজ্ঞতা পরবর্তীকালে কিবরিয়ার শিল্পীজীবনে দারুণভাবে ভূমিকা রাখে। বীরভূম জেলা স্কুলে হাতে লেখা একটি ম্যাগাজিন প্রকাশিত হতো। সেই ম্যাগাজিনে চিত্রাঙ্কন করতেন কিবরিয়া। স্কুলের শিক্ষকেরা ছবি আঁকার জন্য তাঁকে সব সময় অনুপ্রেরণা দিতেন। আদতে তখন থেকেই ছবি আঁকার প্রতি প্রবল অনুরাগ তৈরি হয় তাঁর।

মোহাম্মদ কিবরিয়ার আঁকা একটি বিমূর্ত ছবি
মোহাম্মদ কিবরিয়ার আঁকা একটি বিমূর্ত ছবি

বীরভূম জেলা স্কুলের পাঠ শেষ করে কিবরিয়া ১৯৪৫ সালে ভর্তি হন কলকাতা আর্ট স্কুলে (কলেজ অব আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটস)। তাঁকে অনুপ্রেরণা দেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক ওয়াজেদ আলী চৌধুরী। তিনি অনেকটা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কিবরিয়ার পরিবারের সঙ্গে আলাপ করেন। যে কারণে কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হতে তাঁর তেমন কোনো অসুবিধা হয়নি। আর্ট স্কুল থেকে ১৯৫০ সালে পেইন্টিংয়ে স্নাতক পাস করেন কিবরিয়া। তারপর ১৯৫১ সালের শেষের দিকে কলকাতা থেকে তিনি চলে এলেন ঢাকায়। ঢাকায় এসে নওয়াবপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে যোগ দিলেন ড্রয়িং-শিক্ষক হিসেবে।

এদিকে ১৯৪৮ সালে শিল্পী জয়নুল আবেদিন তাঁর কয়েকজন সতীর্থের সহায়তায় ঢাকায় আর্ট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন এবং অধ্যক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। জয়নুল কিছুদিনের জন্য লন্ডন গেলে কিবরিয়া আর্ট ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতার সুযোগ পান। কিন্তু জয়নুল ফিরে এলে তিনি পুনরায় ফিরে যান নওয়াবপুর স্কুলে। তবে ১৯৫৪ সালে কিবরিয়া স্থায়ীভাবে আর্ট ইনস্টিটিউটে (বর্তমান চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) যোগ দেন। ১৯৮৭ সালে তিনি চারুকলা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন।

কিবরিয়ার কলকাতার শিল্পশিক্ষার পর্বটিও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ভালো শিক্ষকের কাছে শিক্ষালাভ ও তাঁদের সাহচর্য তাঁর মনন ও মেধায় স্থায়ী ছাপ ফেলেছিল। তৎকালীন কলকাতা আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ ছিলেন রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।

আর জয়নুল আবেদিন ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় শিক্ষক। আরও ছিলেন আনোয়ারুল হক, মণিভূষণ দাশগুপ্ত। শিক্ষক বসন্ত গাঙ্গুলি, যিনি কিবরিয়াকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছেন। শিল্পের প্রকরণ ব্যবহার ও সৃজনশীলতা বিষয়ে এই বসন্ত গাঙ্গুলি প্রশিক্ষণ দিয়েছেন কিবরিয়াকে। খুবই দক্ষ শিল্পী ছিলেন বসন্ত গাঙ্গুলি। বিবিধ শিল্প প্রকরণ—রং, প্যাস্টেল, কাঠকয়লা—মুনশিয়ানার সঙ্গে ব্যবহার করতে পারতেন তিনি। আবার ছবির ভেতরেও যে একটি কাঠামো থাকে, যার সঙ্গে উপরিতলের থাকে একটি দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক, সেটি তিনি চমৎকারভাবে চিহ্নিত করতে পারতেন। ছবির কম্পোজিশনে কোথায় কোন দৃষ্টিক্ষেত্র এবং তা কীভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারে, তা-ও বিশদভাবে জানতেন বসন্ত গাঙ্গুলি। কিবরিয়ার মধ্যে তিনি ক্রমে ক্রমে এসব শৈল্পিক গুণ উজ্জীবিত করতে পেরেছেন। তাঁর কাছেই কিবরিয়া জ্ঞাত হন, প্রতিটি ছবির একটি কেন্দ্রবিন্দু বা ফোকাল পয়েন্ট থাকে। ছবির কাঠামো বা জগৎকে সেই বিন্দুর চারদিকে সাজাতে হয়। এই সাজানোটি যে সব সময় একটি পূর্বপরিকল্পনা থেকে করতে হয়, তা নয়, বরং ছবি আঁকার সময় (অথবা ছাপাই ছবিতে রেখার সূক্ষ ও জটিল প্রয়োগের সময়) একটি স্বতঃস্ফূর্ততা থেকে, একটি অনিবার্যতা থেকে সেই ছবির ফর্মগুলো যেন একটি কেন্দ্রাভিমুখ বিন্যাসে রচিত হয়ে যায়। এই কেন্দ্রটি নান্দনিক অনুভূতির, আবেগের, সৃজন কল্পনার অথবা বুদ্ধিবৃত্তিক। কিবরিয়ার ছবিতে (আধা বিমূর্ত, আধা অবয়বধর্মী অথবা বিমূর্ত) এই কেন্দ্রিকতার বিষয়টি একটা গতিশীলতা সৃষ্টি করে। এমনকি যে ছবিতে অবয়বটি শনাক্তযোগ্য, সেখানেও এমনই অনুভব করা যায়। তাঁর ছবিতে স্পেসের প্রকাশ মনোমুগ্ধকর ও শক্তিমান।

জাপানের শিল্পশিক্ষার পর্বটিও কিবরিয়ার শিল্পীজীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাঁর নিজস্ব চিত্রভাষা নির্মাণ ও এর চূড়ান্ত বিকাশের ক্ষেত্রে এই পর্ব প্রণিধানযোগ্য। ঢাকা থেকে ১৯৫৯ সালে বৃত্তি নিয়ে জাপানের টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ফাইন আর্টস অ্যান্ড মিউজিক থেকে পেইন্টিং ও গ্রাফিকসে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেন কিবরিয়া। পরবর্তীকালে এই শিল্পীর চিত্রকলা ও ছাপচিত্রের কাজে জাপানি শিল্পশিক্ষার প্রভাব ও উৎকর্ষ বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

মোহাম্মদ কিবরিয়ার প্রথম দিকের একটি ছবি ‘পূর্ণিমা’
মোহাম্মদ কিবরিয়ার প্রথম দিকের একটি ছবি ‘পূর্ণিমা’

শুরুর দিকে কিবরিয়ার অ্যাকাডেমিক শিল্পচর্চায় জলরং ও তেলরঙের ব্যবহার ছিল ভারতীয় ঘরানার। তখন ভারতীয় ঐতিহ্য ও রীতি অনুযায়ী ঘন ও অস্বচ্ছ জলরং ব্যবহার করা হতো। এখানে বলা দরকার, তুলনামূলকভাবে তেলরঙের চিত্রতলে অধিকতর গভীরতা আনা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে টেক্সচার ও যথাযথ রং ব্যবহারের মাধ্যমে ক্যানভাসে মাত্রা ও পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করা যায়। ফলে অ্যাকাডেমিক চর্চায় রং ও অন্যান্য প্রকরণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় শিল্পের অনুসরণ ভারতেও জনপ্রিয়তা পায় এবং বিস্তার লাভ করে। কিবরিয়া অ্যাকাডেমিক বা বাস্তবানুগ কাজ যেমন করেছেন, তেমনি ইমপ্রেশনিজমের শৈলীও গ্রহণ করেছেন ক্যানভাসকে একপ্রকার নির্ভার ও প্রাণবন্ত করার প্রচেষ্টায়। আলো ও নিসর্গের প্রতি ইমপ্রেশনিস্টদের প্রবল অনুরাগ আর্ট স্কুলের শিক্ষার্থীদের প্রকৃতিমুখী করতে প্রণোদনা জুগিয়েছে।

সেই বাস্তবতায় কিবরিয়ার নিরীক্ষার শুরুও ইমপ্রেশনিজমের ছায়াতলে। তারপর এর মধ্য দিয়ে ফর্ম ও স্পেস খুঁজেছেন তিনি। ক্রমে কিউবিজম ও এক্সপ্রেশনিজম পথ ধরে অ্যাবস্ট্রাক এক্সপ্রেশনিজমে জগতে প্রবেশ করেন এই শিল্পী। যাকে আমরা বাংলায় বিমূর্তবাদ বলছি। এখানে তিনি রং, ফর্ম আর স্পেস নিয়ে খেলেছেন বিস্তর। নিঃসঙ্গতা ও নীরবতার অবয়ব খুঁজেছেন। এই অনুসন্ধান তাঁর আজীবনই ছিল। চিত্রকর্মকে আত্মপ্রকাশের মায়াময় আশ্রয় হিসেবে দেখেছেন কিবরিয়া। প্রকৃতির অন্তর্গত জীবনকে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন ক্যানভাসে। এ ছাড়া দুনিয়ার প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার যথোপযুক্ত মাধ্যম হিসেবেও একে গুরুত্ব দিয়েছেন।

নিজের চিত্রকর্ম সম্পর্কে কিবরিয়ার অনুভব এমন: তাঁর ছবি শুধু একটি চিন্তা অথবা অনুভূতিকেই প্রকাশ করবে, তা নয়, বরং ছবিতে ব্যক্তির নিগূঢ় মানসিক অবস্থারও প্রতিফলন থাকবে। ছবির পেছনে চেতন-অবচেতনের একটি ভাবনা বা গল্প থাকে। অচেতনের নানা ইঙ্গিত থাকে। সেগুলোর ব্যাখ্যা না হলেও অন্তত প্রকাশ থাকা দরকার।
এই অবচেতনের বিষয়টিই কিবরিয়ার ছবির জন্য জরুরি। বলা যায়, এটিই তাঁর আরাধনা। এক্সপ্রেশনিজমের ছবি ফিগারধর্মী অথবা বিমূর্ত যেমনই হোক, তাতে ব্যক্তির মনোজগতের টানাপোড়েন, সংক্ষুব্ধতা, হতাশা ইত্যাদির প্রকাশ ঘটায়। নির্বস্তুক ছবিতে এসবের প্রকাশ কঠিন এবং দুরূহ। কিবরিয়া সেই কঠিন কাজটি নিঃসন্দেহে সফলভাবে করেছেন।

তাঁর ছবিতে মানসিক প্রশান্তি ও দৃষ্টিসুখ ছাড়াও একটি দার্শনিক ও অস্তিত্বসূচক ইঙ্গিত আছে। তাঁর শুরুর দিকের কাজ, যেমন ‘চন্দ্রাহত ঘোড়া’ বা ‘গোরস্তানে নৃত্য’ ইত্যাদি চিত্রকর্মে একটি পরিব্যাপ্ত বিষণ্নতাবোধ ছিল। পরাবাস্তব বিষাদের দ্যোতনা ছিল। ওই বিষণ্নতা বা মেলানকোলিয়া তাঁর সমগ্রশিল্পের মূল সুর। কিবরিয়ার নীল রং, স্পেসের গভীর শূন্যতা, মায়াময় জমিন—সবকিছুতে একটি সূক্ষ অপ্রাপ্তিবোধের প্রকাশ আছে। অনুপস্থিতির অনুভূতিও আছে।

বীরভূম ছেড়ে ঢাকায় আসা কিবরিয়ার নিঃসঙ্গতাবোধ আমৃত্যুই কার্যকর ছিল। ঢাকাতে তিনি প্রতিষ্ঠা পেলেও জন্মস্থানের মাটির প্রতি তাঁর নাড়িছেঁড়া টান কোনো দিনও মুছে যায়নি। বস্তুত এই পারাপারের কষ্ট থেকেই শিল্পী কিবরিয়ার জন্ম।

আজ তাঁর মৃত্যুদিন। স্যারের স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।