আত্ম-উন্নয়নমূলক বইয়ের ‘উন্নয়ন’ রহস্য

‘সেলফ হেল্প’ বা আত্ম-উন্নয়নমূলক বইয়ের বাজার এখন রমরমা। এ বইগুলোর জনপ্রিয়তার কারণ কী? বিশ্বে এ ধারার বইয়ের প্রবণতাগুলো কেমন? বাংলাদেশে এ ধরনের বইয়ের কী অবস্থা? সব মিলিয়ে সেলফ হেল্প বইয়ের আদ্যোপান্ত

বিখ্যাত আমেরিকান কমেডিয়ান জর্জ কার্লিন একবার বিশেষ ধরনের লোকের তালিকা বানিয়েছিলেন। তালিকার শিরোনাম ছিল—‘যাদের গুলি করে মেরে ফেলা উচিত!’ আর সেই তালিকার একদম ওপরের দিকে ছিল সেলফ হেল্প বইয়ের পাঠকেরা।

কার্লিনের কমিক যুক্তি এমন, ‘সেলফ হেল্প’ কথাটিই সেলফ ‘কন্ট্রাডিক্টরি’ বা স্ববিরোধী। যদি সেলফ হেল্পই হতো, তাহলে আরেকজনের আপনার জন্য বইটা লেখার প্রয়োজনই থাকত না।

সেলফ হেল্প কার্লিনের যতই অপছন্দের হোক না কেন, বর্তমানে অন্যতম পাঠকপ্রিয় জনরা বা ধারা এটি। বেস্টসেলার তালিকায় নিয়মিত শীর্ষ স্থান দখল করে থাকা আত্ম-উন্নয়নমূলক বা ‘সেলফ ইমপ্রুভমেন্ট’ বই, যা ‘সেলফ হেল্প’ নামে বেশি পরিচিত। বিভিন্ন স্টাইল ও ফরম্যাটে লেখা হলেও বইগুলোতে সাধারণত অনেক গল্প আর উদাহরণ থাকে। থাকে কিছু উপদেশ, পরামর্শ ও কর্মপন্থা। জীবনের অপ্রাপ্তি ও অনিশ্চয়তায় নির্দিষ্ট সমস্যার সমাধান কিংবা আত্ম-উন্নয়নের জন্য পাঠক এ ধরনের বই হাতে তুলে নেন। সেলফ হেল্প মূলত ‘অ্যাকশন’ বুক। ডেল কার্নেগি ১৯৩৬ সালের হাউ টু উইন ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স পিপল-এ হার্বাট স্পেন্সারকে উদ্ধৃত করে লেখেন, ‘শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য জ্ঞান নয়, পদক্ষেপ বা অ্যাকশন; এবং এই বই একটি অ্যাকশন বুক।’ লেখাটি বহির্বিশ্বে ও বাংলাদেশের প্রকাশনাজগতে সেলফ হেল্পের প্রবণতা ও হালচাল নিয়ে।

ইতিহাসের প্রথম সেলফ হেল্প বই

মানবসভ্যতার অধিকাংশ বিষয়ের আদি উৎস পাওয়া যায় সভ্যতার আঁতুড়ঘরখ্যাত মিসরীয় সভ্যতায়। সেলফ হেল্পের ক্ষেত্রেও এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেনি। সেলফ হেল্পের আদি পূর্বসূরি, উপদেশমূলক একধরনের সাহিত্যকে প্রাচীন মিসরীয়রা বলত ‘সেবাইত’। সেবাইতের অর্থ ‘শিক্ষা’। চীনা জেনারেল ও দার্শনিক সান ঝুর আর্ট অব ওয়ার কিংবা রোমান সম্রাট মার্কাস আউরেলিয়াসের মেডিটেশনসকেও বিস্তৃত অর্থে সেলফ হেল্পের পূর্বসূরি বলা যায়।

তবে সেলফ হেল্প হিসেবে পরিচয় দিয়ে প্রথম বইটি প্রকাশিত হয় ১৮৫৯ সালে। সেলফ হেল্প নামের বইটির রচয়িতা স্কটিশ লেখক স্যামুয়েল স্মাইলস। খোদ লেখককে চমকে দিয়ে সেলফ হেল্প বইটি এমনই বেস্টসেলার হয় যে ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ডের ঘরে ঘরে এ বইয়ের একটি করে কপি থাকত। ইতিহাসের বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবন থেকে নেওয়া শিক্ষাগুলো ছিল বইটির বিষয়বস্তু। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সফল হওয়ার প্রেরণাদায়ক কিছু গল্পের এই সংকলনের জনপ্রিয়তা এমনই ছিল যে তখন একমাত্র বাইবেল ছাড়া সমস্ত বইয়ের চেয়ে বেশি বিক্রীত বই হওয়ার রেকর্ড গড়ে। তার পর থেকে প্রত্যেক প্রজন্মের জন্যই এই জনরায় বেস্টসেলার ছিল: হাউ টু লিভ অন টোয়েন্টি ফোর আওয়ার্স আ ডে (১৯০৮), থিংক অ্যান্ড গ্রো রিচ (১৯৩৭), ডোন্ট সোয়েট দ্য স্মল স্টাফ (১৯৯৭)।

১৪ বিলিয়ন ডলারের সেলফ হেল্প ইন্ডাস্ট্রি বর্তমানে আর ‘স্মল স্টাফ’ নেই। এমনিতে মানুষ সেলফ হেল্প পড়ে আসছে স্যামুয়েল স্মাইলসের বই প্রকাশের অনেককাল আগে থেকে; তবে ভিন্ন নামে। যদিও অধিকাংশ ধর্মগ্রন্থ, ধর্মাবতার ও ধর্মবেত্তাদের জীবনী, উপদেশমালা, প্রাচীন মহাকাব্য বা পৌরাণিক গ্রন্থ হাজার বছর ধরে মানুষকে পথনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা দিয়ে আসছে। বিস্তৃত অর্থে এই গ্রন্থগুলোকে সেলফ হেল্প বলাই যায়। এই লেখায় অবশ্য বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি, থ্রিলার কিংবা হররের মতো একটি লিটারেরি জনরা (সাহিত্যধারা) হিসেবে সেলফ হেল্পকে ধরে নিচ্ছি।

সেলফ হেল্প বইয়ের বাজার ও বৈশ্বিক প্রবণতা

সেলফ হেল্প বইয়ের বাজার বৈচিত্র্যময়। নানা মত ও পথের, মতাদর্শের বই সেলফ হেল্প ইন্ডাস্ট্রিতে থাকলেও মোটাদাগে তিন ধরনের বইয়ের বিক্রি সর্বাধিক।

প্রথমত, ধর্মীয় চর্চাকেন্দ্রিক বা আধ্যাত্মিক বিষয়ে পরামর্শের বই। বইগুলোর প্রধান বিষয়বস্তু ব্যক্তির দুশ্চিন্তা ও নানা ধরনের সমস্যা সমাধানে কীভাবে নির্দিষ্ট ধর্মীয় আচার-ব্যবহার কিংবা ধর্মগ্রন্থের শিক্ষা সহায়তা করতে পারে। বইগুলোর লেখকেরা সাধারণত ওই ধর্মীয় বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বা ‘মেন্টর’ হিসেবে লিখে থাকেন। ধর্মীয় বইয়ের বাইরে আধ্যাত্মিক নানা শিক্ষা, যোগ, ধ্যান, মাইন্ডফুলনেস ইত্যাদি বইও জনপ্রিয়। বাংলায় এ ধারার সাম্প্রতিক বই কোয়ান্টাম মেথডখ্যাত মহাজাতকের শুদ্ধাচার

দ্বিতীয় ঘরানার সেলফ হেল্প মূলত আত্মজৈবনিক বা স্মৃতিকথার বই। এতে লেখক তাঁর অতীতের ব্যক্তিগত সংগ্রামের গল্প আর বর্তমানের ‘দারুণ’ অবস্থা পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করে নেন। ফলে এখানে আপনি পাবেন এমন বই, যেখানে লেখক হয়তো বিষণ্নতায় ভুগছিলেন, কীভাবে সেটি তিনি কাটিয়ে উঠেছেন, আছে সেই বয়ান। পেতে পারেন একজন ‘সিঙ্গেল মাদার’ কীভাবে জীবনসংগ্রাম করে টিকে থেকেছেন; দেউলিয়া ব্যক্তির আবার অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হওয়ার গল্প ইত্যাদি। অবশ্য এ ধরনের বইগুলোর পরোক্ষে দাবি হলো, আপনি যদি বইটি পড়ে সেই অভিজ্ঞতার আলোকে কাজ করেন, তবে একই ধরনের সাফল্যমণ্ডিত জীবন আপনারও হবে।

তৃতীয়ত, আরেক ধরনের বইয়ের কাটতি এই মুহূর্তে তুঙ্গে। এই বইগুলোতে পাঠক বলা হয়, সমাজের বস্তাপচা ব্যবস্থায় আপনি ‘আনফিট’, মানিয়ে নিতে পারছেন না? দুশ্চিন্তা নেই। মানিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনও নেই। দরকার নেই সমাজকে পাত্তা দেওয়ার; বরং যে জীবন আপনি চান সেই জীবন যাপন করুন। নিজের ভালো লাগাকে গুরুত্ব দিন।

ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী পশ্চিমের সমাজে পাঠকদের এই বার্তা স্পর্শ করে বলেই ইঙ্গিত দেয় বইগুলোর বিক্রি। অনেকগুলো বইয়ে একটা বার্তা ঘুরেফিরে পাওয়া যাচ্ছে: প্রত্যেকেই সামাজিক চাপে নিজেকে মুখোশ পরে হাজির করছে। পৃথিবী আরও সুন্দর ও সুখের হতো যদি সবাই এই অভিনয় আর মুখোশ ফেলে নিজের ভালো লাগাকে, নিজের প্রকৃত রূপকে গ্রহণ করত শিখত। বইগুলোতে ‘অথেনটিক’, ‘রিয়েল ইউ’ ইত্যাদি শব্দ বেশি দেখা যায়।

স্ল্যাংবহুল সেলফ হেল্প

ওপরের তিন ধরনের বই নিয়মিতভাবে পাঠকপ্রিয়তা পাচ্ছে। তবে ছয়-সাত বছর ধরে নতুন মেজাজের একধরনের বই আলোড়ন তুলছে। সোজাসাপ্টা শিরোনামের মেগা হিটস (হাউ টু উইন ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স পিপল), রোমান্টিক (দ্য রোড লেস ট্রাভেলড বাই, দ্য সিক্রেট), অথবা লিস্টিকলস (দ্য ফোর অ্যাগ্রিমেন্ট, সেভেন হ্যাবিটস অব হাইলি সাকসেসফুল পিপল) ইত্যাদি যুগের পর যুগ বিক্রি করে প্রকাশকদের পুরোনো জিনিসই নতুন বোতলে হাজির করার মতো হালের একটি কার্যকরী পদ্ধতি হচ্ছে শিরোনামে ‘ফাক’ আর ‘শিট’ লিখে দেওয়া।

২০১৫ সালে ফ*ক ফিলিংস নামের বই দিয়ে শুরু। এর পর থেকে সিনেমার ব্লকবাস্টার মুভির মতো যেন শুরু হয়েছে ‘ফ*কিং ফ্র্যাঞ্চাইজি’। মার্ক ম্যানসনের বিস্ফোরক হিট সাটল আর্ট অব নট গিভিং আ ফাক এখন পর্যন্ত এই জনরার গত দশকের সর্বাধিক বিক্রীত সেলফ হেল্প বই, যেখানে ‘ফাক’ শব্দটি আছে প্রায় ২০০ বার! ব্লগার ও লাইফকোচ ম্যানসন প্রথম আলোচনায় আসেন একটি ভাইরাল ব্লগপোস্ট (‘আই ইউজড টু বি আ মিজারেবল ফাক’)-এর মাধ্যমে, যিনি নিজেকে ‘দ্য অ্যাংরি থেরাপিস্ট’ বলেন। ম্য্যানসনের পরবর্তী বইয়ের নাম এভরিথিং ইজ ফাকড!

ফ*ক ফিলিংস-এর লেখক সারাহ বেনেট, যিনি নিজের পরিচয় দেন বেস্টসেলিং অ্যান্টিগুরু হিসেবে, তাঁর পরবর্তী সেলফ হেল্প বইয়ে (ফাক লাভ) পাঠকদের পরামর্শ দিচ্ছেন: স্টপ ডুয়িং দ্যাট শিট!

কোটি কোটি কপি বিক্রি হওয়া এই সোয়েরি সেলফ হেল্পের বাজারে মন্দার কোনো লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না। আর এখন প্রতি সপ্তাহে স্ল্যাংপ্রধান এই সেলফ হেল্প বই প্রকাশিত হচ্ছে।

স্ল্যাংপ্রধান এই বইগুলো আপনার চোখে যদি কিছুটা অন্য রকম ঠেকে, আপনি তবে ভুল নন। এই শ্রেণির বইয়ের প্রধান ক্রেতা মূলত যুবসমাজ। পশ্চিমের কলেজপড়ুয়ারা এ ধরনের সেলফ হেল্প বইয়ের ৮০ শতাংশ ক্রেতা। বইগুলোর ভাষা তরুণদের বাগ্‌ভঙ্গিকে অনুসরণ করে। ছোট ছোট, চমকপ্রদ বাক্য, উইটি অ্যানেকডোটস (গল্প) ও প্রচুর স্ল্যাংসহযোগে বইগুলো লেখা হয়। বাংলাদেশে সবকিছুতে বিধিনিষেধ বেশি থাকায় সেলফ হেল্প এখনো এই প্রবণতাবহুল হয়ে ওঠেনি। কিন্তু তরুণদের উদ্দেশ করে তারুণ্যের ভাষাতেই প্যারাময় লাইফের প্যারাসিটামল, হাবলুদের জন্য প্রোগ্রামিং, ভাইরে আপুরে, ভাল্লাগে না কিংবা বিভিন্ন ‘হ্যাকস’ নামযুক্ত বই লেখা হচ্ছে; যা পাঠকপ্রিয়।

সেলফ হেল্পের প্যারাডক্স

সেলফ হেল্প বই কি আসলেই ‘হেল্প’ করে?

উত্তরটি অবিসংবাদিত নয়। অবশ্য প্রকাশনার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৮১ শতাংশ সেলফ হেল্প বইয়ের ক্রেতা ‘রিপিট বায়ার’, যা ইশারা দেয় বইগুলো সম্ভবত যথেষ্ট হেল্প করছে না। কিছু জরিপে দেখা গেছে, সেলফ হেল্পের ক্রেতাদের একটি বড় অংশ প্রথম ২০ পৃষ্ঠার বেশি পড়ে না, যদি পড়ে থাকেও আরকি। অবশ্য একই জরিপ অনুযায়ী, সেলফ হেল্প বই কিনলেই নাকি ক্রেতারা ভালো বোধ করেন! যাঁরা পড়েন তাঁরাও একের পর এক সেলফ হেল্প কিনতেই থাকেন। হয়ে ওঠেন সেলফ হেল্প জাংকি। সত্যি বলতে, আমরা ফোমো বা ফিয়ার অব মিসিং আউট দিয়ে যতটা চালিত হই এবং নিজেদের বিশেষজ্ঞ হিসেবে জাহির করতে যতটা আগ্রহী, সে তুলনায় বাস্তবিক পরিবর্তনে আগ্রহ আমাদের কম।

যেন আমরা চূড়ান্ত কোনো শিক্ষা, কৌশল বা ‘সাটোরি’ মুহূর্তের অপেক্ষারত, যা হুট করে আমাদের জীবনকে বদলে ফেলবে। ফলে আমরা সন্তুষ্টির বদলে আরও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। মজার বিষয় হলো, সেলফ হেল্প ইন্ডাস্ট্রির এই সমস্যার কথা লেখকদের অজানা নয় এবং এই সমস্যাকে পুঁজি করেই বা সমস্যা থেকে থেকে মুক্তি পাওয়ার টোটকা নিয়ে আবার আরেক শ্রেণির সেলফ হেল্প বই লেখা হচ্ছে, যার নাম অ্যান্টিসেলফ হেল্প বা অ্যান্টি-ইমপ্রুভমেন্ট বুকস। এ ধরনের বেস্টসেলার কিছু বই হলো স্ট্যান্ড ফার্ম: রেজিস্টিং দ্য সেলফ ইমপ্রুভমেন্ট ক্রেইজ, লাইফ চেঞ্জিং ম্যাজিক অব নট গিভিং আ ফাক, আর্ট অব ফেইলউর: অ্যান্টিসেলফ হেল্প গাইড ইত্যাদি।

একুশ শতকের সর্বাধিক বিক্রীত ইতিহাস রচয়িতা নোয়াহ ইউভাল হারারির শেষ বইয়ের নাম যখন টোয়েন্টি ওয়ান লেসনস ফর টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি, তখন বুঝতে হবে বইয়ের বাজারে খেলার নিয়ম বদলাচ্ছে। দিন দিন সেলফ হেল্প ইন্ডাস্ট্রি আরও বড় হচ্ছে। নানা ধরনের ভয়, দুশ্চিন্তা ও অনিরাপত্তা, অর্থাৎ আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক জলবায়ুর সঙ্গে সেলফ হেল্পের বিক্রির সম্পর্ক আছে। যেমন করোনা মহামারির সময় ডিস্টোপিয়ান ফিকশন আর সেলফ হেল্প বইয়ের বিক্রি বেড়ে গেছে। আমাদের আশা, আগামী দিনে হয়তো বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক মানের মৌলিক সেলফ হেল্প বই রচিত হবে।

বাংলায় আত্ম-উন্নয়নমূলক বই

বাংলায় সেলফ হেল্প—যােক বলা যায় আত্ম-উন্নয়নমূলক বই—এসব বইয়ের বাজার মূলত অনুবাদনির্ভর। নীলক্ষেতে বা বাংলাবাজারে ঢুঁ মারলেই চোখে পড়ে এখনো সর্বাধিক বিক্রীত বই মূলত ডেল কার্নেগির প্রতিপত্তি ও বন্ধুলাভ কিংবা শিব খেরার তুমিও জিতবে। বর্তমানে না চললেও ডা. লুৎফর রহমানের উন্নত জীবন, মানবজীবন এবং অন্যান্য ‘জীবন’যুক্ত নামের বিভিন্ন বই একসময় পাঠকপ্রিয় ছিল। কিছু বই আছে যাদের বলা যায় ‘চোরাগোপ্তা’ মোটিভেশনাল বা সেলফ হেল্প বই। যেমন এ পি জে আবদুল কালামের (আত্মজীবনীর মোড়কে মোটিভেশনাল) কিংবা পাওলো কোয়েলহোর (উপন্যাসের মোড়কে মোটিভেশনাল) বই। তবে ইন্টারনেট ও বিশ্বায়নের ফলে ইংরেজি সেলফ হেল্প বেস্টসেলারগুলো অবশ্য নিয়মিতই দ্রুত বাংলায় অনূদিত হচ্ছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে সেলফ হেল্প বা মোটিভেশনাল বইয়ের নতুন একটা ধারা দেখা যাচ্ছে দেশে—মূলত সোশ্যাল মিডিয়া সেলিব্রিটি বা অনলাইন ইনফ্লুয়েন্সারদের বই। এ ধরনের বই যতটা না বিষয়বস্তুকেন্দ্রিক, তার চেয়ে অনেক বেশি রচয়িতাকেন্দ্রিক। এ ধারায় সেলিব্রিটি, বিখ্যাত ব্যক্তি বা বড় প্রতিষ্ঠানের বড়কর্তাদেরই এখন পর্যন্ত মোটিভেশনাল বই লিখতে দেখা যাচ্ছে। প্রকাশকেরা জানেন, অমুক সেলিব্রেটির দুই মিলিয়ন ফলোয়ার আছে। অতএব প্রচ্ছদে সেলিব্রিটির নামটি দিয়ে বাজারে ছাড়লে বই বিক্রি হবে। অর্থাৎ ইতিমধ্যে একটা বিশাল জনতা যেখানে হাজির আছে, অর্থাৎ বাজার আছে, সেখানে বইয়ের ক্রেতাও আছে।

ব্যবসায় শাস্ত্রের ‘৮০-২০’-এর নিয়ম অনুযায়ী, যেকোনো ক্যাটাগরির প্রোডাক্ট, সার্ভিস বা শিল্পকর্মের শতকরা ৮০ শতাংশ গারবেজ হবে। বোধ করি, সেলফ হেল্প ইন্ডাস্ট্রিতে গারবেজের অনুপাত কিছুটা বেশি হবে। বাংলাদেশে সেলফ হেল্প বইয়ের অবস্থা আরও শোচনীয়।

বাংলায় বিগত বছরগুলো একটাও আন্তর্জাতিক মানের মৌলিক সেলফ হেল্প বই প্রকাশিত হয়নি। অধিকাংশ সেলফ হেল্প বিদেশি বই বা ইন্টারনেট থেকে এদিক-সেদিক করে, প্যারাফ্রেজ করে, বাংলায় লেখা। মৌলিক চিন্তাভাবনা নেই। এসব দেখে মনে হয়েছে, বাংলায় ভালো মানের একমাত্র সেলফ হেল্প বই সিদ্দিকা কবীরের রান্না, খাদ্যপুষ্টি, যা আসলে রেসিপির বই।

ভালো আত্মজৈবনিক বা স্মৃতিকথামূলক বই অনেক সময় পরোক্ষে সেলফ হেল্পের কাজ করে। আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথার পরোক্ষে পাঠকের জন্য সেলফ হেল্প হয়ে উঠতে প্রয়োজন লেখকের নিজের ভুলত্রুটিকে নির্মোহভাবে দেখা এবং সততার সঙ্গে তা প্রকাশ করার সাহস। দুঃখের ব্যাপার, দু-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে বাংলায় এ ধরনের বই খুব বেশি চোখে পড়ে না। ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া দূর কি বাত, বাংলার সফল মানুষেরা জীবনে সেভাবে কোনো ভুলই করেন না—আমাদের বেশির ভাগ আত্মজৈবনিক বা স্মৃতিকথামূলক বই পড়লে এমনই মনে হয়।