জহির রায়হানের মৃত্যু ও জীবনের অনুসন্ধান

‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর আর মুক্তিসংগ্রামী সাহিত্যশিল্পী জহির রায়হান হত্যাকাণ্ড প্রায় সমান বয়সের।’ জহির রায়হান: অনুসন্ধান ও ভালোবাসা বইয়ের ভূমিকায় সম্পাদক মতিউর রহমান ‘হত্যাকাণ্ড’ শব্দটি সচেতনভাবে ব্যবহার করেছেন। এ দেশের চলচ্চিত্র আন্দোলনের চিরস্মরণীয় নাম জহির রায়হান, যিনি ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি অন্তর্হিত নন, বরং হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন। প্রথমে অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলফিকার আলী মাণিক ও পরে জহিরপুত্র অনল রায়হানের লেখায় সেই প্রমাণিত সত্যটি আলোয় এসেছে। বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য ও চুলচেরা বিশ্লেষণে এ বইয়ের প্রথম পর্বে তাঁরা সব রহস্যের আস্তরণ ভেঙেছেন। ‘পিতার অস্থির সন্ধানে’ শিরোনামে পিতৃহারা সন্তানের অশ্রুমথিত লেখাটি অনুসন্ধানের বাইরেও বেশি কিছু। ‘অনুসন্ধান’ শিরোনামের পর্বে কবি শামসুর রাহমান ও কথাসাহিত্যিক শাহরিয়ার কবিরের লেখা দুটি মূলত ওই লেখাগুলোর প্রতিক্রিয়া।

জহির রায়হানের সান্নিধ্যে আসা সমসাময়িক খ্যাতিমান লেখক-শিল্পী-চলচ্চিত্রকারদের স্মৃতিচারণামূলক লেখায় সাজানো হয়েছে দ্বিতীয় পর্ব ‘স্মরণ’। শুরুতেই ‘অপু-তপুকে’ লেখা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের পত্রপ্রবন্ধে পাওয়া যাবে বন্ধু ও কবির দৃষ্টিতে দেখা অন্য এক জহিরকে। কথাশিল্পী রাবেয়া খাতুনের স্মৃতিমূলক দীর্ঘ লেখাটি জহিরের প্রসঙ্গের পাশাপাশি প্রকাশ করেছে পঞ্চাশ দশকের সাহিত্যচর্চার বিষয়টি। অভিনেত্রী সুচন্দা বলেছেন জহিরের সঙ্গে তাঁর পরিচয়, প্রেম ও বিয়ের কথা। ১৯৭২ সালের জানুয়ারির কোনো এক দিন সকালে পিজি হাসপাতালের সিঁড়িতে জহির রায়হানের সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল মতিউর রহমানের। জহির তাঁকে বলেছিলেন, ‘কেমন আছেন, কথা আছে, আসবেন।’ আর দেখা হয়নি, কথাও নয়। বইয়ের সম্পাদক ভূমিকাতেই বলেছেন, এ বই জহির রায়হানের প্রতি তাঁর দায়মোচনের চেষ্টা।

‘চিঠি ও আলাপন’ পর্বে স্ত্রী সুমিতা দেবীকে লেখা জহিরের সুদীর্ঘ একটি চিঠি সংকলিত হয়েছে। রচনার অর্ধশতাব্দী পর চিঠিটি নাটকীয়ভাবে আবিষ্কার করেন অনল রায়হান। জহির রায়হানের ভাষ্যে, ‘এটা কোনো প্রেমপত্র নয়।...হতাশার আগুনে দগ্ধ একটি মানুষের করুণ আকুতিও নয়। এটা হলো দীর্ঘ এক বছর ধরে ঘটে যাওয়া একটি অসাধারণ বিয়োগান্ত নাটকের সাধারণ যবনিকাপতন।’ ব্যক্তিগত টানাপোড়েন, ক্ষরণ ও দ্বিধাদ্বন্দ্বকে ছাপিয়ে এ চিঠি সাহিত্যমূল্যের বিচারে হয়ে উঠেছে অনন্যসাধারণ।

জহির রায়হান: অনুসন্ধান ও ভালোবাসা

সম্পাদক: মতিউর রহমান

প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০২১, ১৯২ পৃষ্ঠা, দাম: ৩৫০ টাকা।

পাওয়া যাচ্ছে

prothoma.com এবং মানসম্মত বইয়ের দোকানগুলোতে।

অমর একুশের মানসসন্তান জহির রায়হানের নিজের বিভিন্ন স্বাদের চারটি লেখা—‘একুশের গল্প’, ‘সময়ের প্রয়োজনে’, ‘পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ’ এবং ‘অক্টোবর বিপ্লব ও সোভিয়েত চলচ্চিত্র’-এর সংকলন হলো পরবর্তী পর্বটি। এ চলচ্চিত্রকারের হত্যাকাণ্ডের পরের বছর গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদের উদ্যোগে সন্ধানী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় ‘জহির রায়হান স্মৃতিপুস্তিকা’। ‘পরিশিষ্ট’ পর্বটি সেই স্মৃতিপুস্তিকা থেকে নেওয়া সহোদর জাকারিয়া হাবিব, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, কবি ফজল শাহাবুদ্দীন ও চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবিরের চারটি স্মৃতিজড়িত লেখার সংকলন। মাঝখানে সংযোজিত প্রাসঙ্গিক আলোকচিত্রাবলি ও অলংকরণ বইটিকে আরও প্রামাণ্য করেছে।

একগুচ্ছ স্মৃতিচারণা ও মূল্যায়নে মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী এবং জহিরের ৫০তম শহীদ দিবসে প্রকাশিত এ বই উন্মোচন করেছে এক অজানা জহির রায়হানকে, যিনি সারা জীবন মানুষের মুক্তি আর স্বাধীনতার কথাই উচ্চারণ করে গেছেন। বইটি মূলত জহির রায়হানের জীবনপরিক্রমা এবং তাঁর মৃত্যুরহস্য উন্মোচনী প্রয়াস।