রহস্যঘেরা এক উপন্যাস

একটি খুন আর তার পাশাপাশি বয়ে চলা প্রেমের চোরাস্রোত। দুটোই ধরতে গেলে অলীক। কিন্তু পাঠকের বাস্তবতায় দুটোই অবশ্যম্ভাবী। কোনোটিকেই এড়ানো সম্ভব হয় না। আসলে খুন আর প্রেম, পাপ আর পুণ্য—এসব বৈপরীত্য নিয়েই তো মানুষের জীবন।

বিশ্বজিৎ চৌধুরীর থ্রিলারধর্মী উপন্যাস খুন ও আনন্দকুসুম। নামের মধ্যেই বৈপরীত্যের চমক। উপন্যাসের শুরুটা হয়েছে একটা খুন দিয়ে। পরপর দুটি গুলির শব্দ শুনে ওয়াশরুমে কেঁপে ওঠে নায়িকা রাফিয়া। সাতপাঁচ না ভেবে গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে সে। এরপর ঘটে যায় অপ্রত্যাশিত রোমাঞ্চকর একটি ঘটনা। সেই ঘটনার সূত্র ধরে এক শিল্পপতির হাতে ধর্ষিতা রাফিয়া আর রিহ্যাব সেন্টারে বন্দী থাকা শিবলির মধ্যে গড়ে ওঠে অনির্বচনীয় প্রেম। যদিও অন্য দশটা প্রেমের চেয়ে এ প্রেম আলাদা, তবুও শিবলি ও রাফিয়া নিজেদের সীমাবদ্ধতা ভুলে পরস্পরের প্রেমেই পড়েছিল।

পাড়ার একটি খুনকে ঘিরে গড়ে ওঠা এ রকম একটি শ্বাসরুদ্ধকর কাহিনিই উপন্যাসটির মূল আকর্ষণ। তবে এ কাহিনিটিকে এগিয়ে নিতে লেখক চরিত্রগুলোকে বেছে নিয়েছেন আমাদের চারপাশ থেকে। রাফিয়া যেন আমাদের চেনা কেউ, যে চাকরির জন্য হন্য হয়ে ঘুরে শেষ পর্যন্ত নিজের সম্ভ্রম হারায়। চাকরি চাইতে নাটক-সিনেমার মতো সোজা বসের রুমে ঢুকে পড়েছিল সে। কিন্তু তার খেসারত যে সম্ভ্রম দিয়ে দিতে হবে, একবারও সেটি তার মাথায় আসেনি। তারপর কাহিনি অনেক দূর এগিয়েছে।

খুন ও আনন্দকুসুম

বিশ্বজিৎ চৌধুরী

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা; প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২২, প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, ১১১ পৃষ্ঠা, দাম: ২৬০ টাকা।

বইটি পাওয়া যাচ্ছে

prothoma.com এবং মানসম্মত বইয়ের দোকানে।

এ পরিস্থিতিতে মেয়েরা যা করে, সেটিই করতে চেয়েছে রাফিয়া। তবে আত্মহত্যা ও পলায়ন—দুটোতেই বাধ সেধেছে তার ছোট ভাই আলমগীর। আলমগীর আমাদের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের যথার্থ প্রতিনিধি। বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাওয়া চাকরিটা করতে সে বেশ উৎসাহী। অতি দ্রুত পোশাক পাল্টে, আদবকেতা পাল্টে নিজেকে সে তুলে ধরতে চায় উচ্চবিত্তের কাতারে। কিন্তু একসময় মধ্যবিত্ত তরুণের বিবেক ও নৈতিক মূল্যবোধ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তার ভেতরে। ফলে মালিকিন সুলতানা রাজিয়া তাকে নিয়ে যখন বিকৃত লালসায় মাততে চেয়েছে, তখন সে টাকার তাড়না তুচ্ছ করে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সুলতানা রাজিয়া চরিত্রটি আমাদের মধ্যে করুণাই উৎপন্ন করে—সব থেকেও সে চরমভাবে নিঃস্ব! ধর্ষক হিসেবে স্বামীর বিচার হয়েছে জেনেও সচ্ছল জীবনের লোভে স্বামীকে ত্যাগ করতে পারেনি সে।

এ উপন্যাসের শেখ আহমদ চরিত্রটি গৌণ হলেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, উপন্যাসের পরিণতিতে তার বড় ভূমিকা রয়েছে। উপন্যাসে তার পরিচয় রিহ্যাব সেন্টারের দারোয়ান হলেও তার রয়েছে এক ব্যথাতুর অতীত।

শেখ আহমদের সহায়তায়ই খুন ও আনন্দকুসুম উপন্যাসের নায়ক হয়ে উঠেছে হাজী মঞ্জিলের ছোট ছেলে শিবলি, বড় ভাইয়ের ষড়যন্ত্রে যে কিনা এখন রিহ্যাব সেন্টারের অধিবাসী। কিন্তু রিহ্যাব সেন্টারে বন্দী থাকলেও পাঠকের উৎকণ্ঠা চরমে পৌঁছায় যখন রাতের অন্ধকারে শিবলিকে দেখা যায় পাড়ার আনাচকানাচে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শিবলির আচরণ একেবারেই নায়কোচিত।

সেই যে শুরুতে রাফিয়াকে পেছন থেকে জাপটে ধরে বলেছিল, ‘চিৎকার কইরেন না প্লিজ, আপনার কোনো ক্ষতি করব না।’ হ্যঁা, শিবলি রাফিয়ার ক্ষতি করেনি, তবে মাফলার জড়ানো মুখের যতটুক দেখা যায়, ততটুকু দেখে ও বলিষ্ঠ হাতের বেষ্টনীবদ্ধ হয়ে রাফিয়া শিবলিতেই মজেছে। শিবলিও মেয়েটির টানে একপর্যায়ে ছুটে এসেছে তার ঘরে। আসলে এ উপন্যাসের গড়নটিই এমন যে প্রতিটি মুহূর্তেই পাঠক উৎকণ্ঠিত হবেন পরবর্তী সময়ে কী ঘটছে, তা জানার জন্য। খুন ও আনন্দকুসুম-এর শেষে আরও একটি খুনের ঘটনা ঘটে। কে খুন হয়? জানতে হলে পড়তে হবে উপন্যাসটি।

রহস্যঘেরা কাহিনি, জীবন্ত সব চরিত্র, চেনা মানুষের ভাষা আর নগরজীবনের পরিবেশ—সব মিলিয়ে বিশ্বজিৎ চৌধুরীর উপন্যাসটি অতি সহজেই পাঠকহৃদয়কে স্পর্শ করবে।