নোবেলজয়ী কথাশিল্পী নাগিব মাহফুজের দ্য কায়রো ট্রিলজি কেবল বড় এক আখ্যানই নয়, এর মধ্যে রয়েছে মিসরের সমাজে শতাব্দী ধরে ঠেকিয়ে রাখা পরিবর্তনের আগমনী বার্তাও। নতুন এই বিভাগে এবার থাকল বিশ্বসাহিত্যের এই কালজয়ী বইয়ের বৃত্তান্ত
প্রথমেই একটা আক্ষেপ দিয়ে শুরু করি। নাগিব মাহফুজ আরবি ভাষার লেখক। আমি আমাদের ধর্মগ্রন্থের ভাষা আরবি পড়তে জানি, কিন্তু বুঝতে পারি না। তাই আমাকে বইটির ইংরেজি অনুবাদের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। দ্য কায়রো ট্রিলজি নামের বইটিতে তিনটি উপন্যাস আছে—বায়েন আল কাসরাইন (প্যালেস ওয়াক), কাসর আল-চাওক (প্যালেস অব ডিজায়ার) ও আল সুককারিয়া (সুগার স্ট্রিট)। তিনটি উপন্যাসের নামই কায়রোর আল-জামালিয়া জেলার রাস্তার প্রকৃত নাম। এটি ১ হাজার ৩০০ পৃষ্ঠার একটি ঢাউস বই। বইটির পাণ্ডুলিপি নিয়ে লেখক গেলে প্রকাশক সাইদ আল-সাহার বইটিকে ‘দুর্যোগ’ বলে প্রকাশে অস্বীকৃতি জানান। কেননা, এটা প্রকাশ করতে ও পাঠকের কিনতে বিপুল ব্যয় হবে। পরে মাসিক সাহিত্য পত্রিকা আল-রিসালাহ আল-জাদিদায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হলে উপন্যাসগুলো আলোড়ন তোলে এবং পরবর্তীকালে বই হিসেবে প্রকাশিত হয়। যখন বইটি কিনেছি, তখন ভেবেছিলাম, এটি শেষ করতে পারব তো? একবার যখন পড়তে শুরু করেছি, আঠার মতো বইয়ের সঙ্গে লেপটে যাই। সরকারি কাজের ফাঁকে ফাঁকে, অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে প্রায় এক মাসে বইটি পড়ে শেষ করি।
আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো নাগিব মাহফুজও আরবি ভাষায় লেখকদের মধ্যে সাহিত্যে একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী লেখক। আমার মতে, আরও কয়েকজন আরবি ভাষার লেখক নোবেল পুরস্কার পাওয়ার উপযুক্ত ছিলেন, যার মধ্যে কাহলিল জিবরান অন্যতম।
তিন পুরুষের আখ্যান এই তিন উপন্যাস। তিনটি উপন্যাসেরই প্রধান চরিত্র স্বৈরাচারী গৃহপতি আল-সাইয়িদ আহমদ আবদ আল জাওয়াদ। সে পরিবারকে কঠিন শাসনে রেখে গোপনে নিজের আত্মভোগ চরিতার্থ করে। প্রথম উপন্যাস প্যালেস ওয়াক–এ তার পরিবারের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে। আমাদের নজর কাড়েন ভদ্র ও মার্জিত, কিন্তু ‘নিপীড়িত’ স্ত্রী আমিনা। আরও দেখা মেলে তাদের দুই নিভৃতচারী কন্যা আয়েশা ও খাদিজা এবং তিন পুত্রসন্তানের সঙ্গে, যার মধ্যে রয়েছে আদর্শবাদী ও বিষাদময় ফাহমি, চরিত্রহীন ভোগবাদী ইয়াসিন এবং আত্মানুসন্ধানী বুদ্ধিজীবী কামাল।
ট্রিলজির দ্বিতীয় উপন্যাস প্যালেস অব ডিজায়ার–এ সাইয়িদ আহমদের বিদ্রোহী সন্তানেরা ১৯২০–এর দশকে বিকাশমান আধুনিকতা ও দেশি–বিদেশি টালমাটাল ঘটনাপ্রবাহের সুযোগ নিয়ে অর্গল খুলে বেরিয়ে আসার সংগ্রামে লিপ্ত হয়। সর্বশেষ উপন্যাস সুগার স্ট্রিট–এ এসে নাগিবের মায়াবী বুননে মিসরের বিবর্তনের প্রতিচ্ছবি হয়ে তা নাটকীয় পরমক্ষণে উপস্থিত হয়—জাওয়াদের এক দৌহিত্র কমিউনিস্ট, অন্য একজন মৌলবাদী মুসলিম, আরেকজন দৌহিত্রী প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের প্রেমিকায় পরিণত হয়।
একটি পরিবারের জীবনসংগ্রামের পটভূমিতে রচিত হলেও আমরা উপন্যাসগুলোতে দু–দুটি বিশ্বযুদ্ধের টালমাটাল পটভূমিতে মিসরের সমাজে শতাব্দী ধরে ঠেকিয়ে রাখা পরিবর্তনের আগমনী বার্তা পাই। শ্বাসরুদ্ধকর নাটকীয়তা, গভীর অন্তর্দৃষ্টি, অনিন্দ্যসুন্দর বয়ান ও ভূমি থেকে উৎসারিত কৌতুকরসবোধসম্পন্ন দ্য কায়রো ট্রিলজি নিঃসন্দেহে নাগিব মাহফুজের মহাগ্রন্থ বা ‘ম্যাগনাম অপুস’।
জাওয়াদের পরিবারের সঙ্গে মিলিত হওয়ার পর এবার আসুন তাদের বাড়ি ঘুরে আসি। ত্রিতল বাড়ির ওপরতলায় পরিবারপ্রধান জাওয়াদের নিবাস। দ্বিতীয় বা মাঝের তলায় মা ও পুরুষসন্তানেরা থাকে। অন্য নারীরা নিচতলায়। হেঁশেল ও রুটি বানানোর ঘরটি বাড়ির আঙিনায়। বইতে রুটির খামির প্রস্তুত করা, বানানো, সেঁকা ও নানাবিধ খাবার প্রস্তুতের বিস্তারিত বিবরণ আছে বাড়ির কর্মচঞ্চল ও প্রাণবন্ত দিকটি তুলে ধরার জন্য। হেঁশেলে মা আমিনাই সর্বেসর্বা, তিনি অন্য নারীদের নিয়ে এখানে কর্মযজ্ঞের নেতৃত্ব দেন। প্রাতরাশ প্রস্তুতের পর তিনি একটি পিতলের ট্রেতে করে তা ওপরতলার খাবারঘরে নিয়ে যান। শুধু তা–ই নয়, সবার খাবারের তদারকও করেন। উচ্চমধ্যবিত্ত এ পরিবারের খাবারের মধ্যে থাকে ডিম, ভাজা বাদামি মটরশুঁটি, পনির, আচারের লেবু ও গরম–গরম গোল সেঁকা রুটি। নিচু খাবার টেবিলের পাশেই কুশন দেওয়া আছে। কেবল জাওয়াদ ও তার পুত্রসন্তানেরাই একসঙ্গে খাবার খেতে পারে এবং এটাই তাদের একসঙ্গে খাওয়ার একমাত্র সময়। প্রথমে পরিবারের কর্তা জাওয়াদ, তারপর জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী ইয়াসিন, ফাহমি এবং সবশেষে কামাল খাবার গ্রহণ করে। মা আমিনা একসঙ্গে খাবার না খেলেও পানির পাত্র হাতে যেকোনো আদেশ পালনে তৎপর থাকে। নিচের তলার সর্বেসর্বা মা ওপরের তলায় এসে নির্বাক প্রান্তিক অস্তিত্বে পরিণত হয়। এরপরও তার অবস্থান একটা উচ্চ সোপানে, যা বাড়ির আর কোনো নারীর নেই। জাওয়াদ খাবার শেষ করে উঠে যাওয়ার পর আমিনা একটি কাপে তার জন্য মধু ও দুগ্ধমিশ্রিত তিনটি কাঁচা ডিম নিয়ে যায়, যা খেলে জাওয়াদের ক্ষুধা বৃদ্ধি পায় এবং কামোত্তেজনা বাড়ে।
সন্ধ্যার আগে কফি খাওয়ার সময়ের চিত্রটি কিন্তু ভিন্ন, এটা দোতালায় সম্পন্ন হয় এবং সবার জন্য উন্মুক্ত; এর আবহ মাতৃতান্ত্রিক গণতন্ত্রের। একই ঘরে আমরা প্রাতরাশকালে স্বৈরতন্ত্র ও সন্ধ্যায় গণতন্ত্র প্রত্যক্ষ করি। গৃহকর্তা জাওয়াদ অবশ্য এতে যোগ দেয় না। সে দোকানের কাজ শেষে নৈশ অভিসারে বেড়িয়ে পড়ে।
প্রতিটি উপন্যাসই একটি মৃত্যু ও একটি নবজাতক ভূমিষ্ঠ হওয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হয়। প্রথম উপন্যাস শেষ হয় পরিবারের মুক্তিযোদ্ধা সন্তান ফাহমির প্রতিবাদ মিছিলে শহীদ হওয়া এবং গৃহকর্তা জাওয়াদের নাতনি হওয়ার মধ্য দিয়ে। দ্বিতীয় উপন্যাসের শেষ দিকে আমরা পুত্র ইয়াসিনের স্ত্রী জানুবার প্রসববেদনা এবং সংবাদপত্র থেকে রাজনৈতিক নেতা সাদ জগ্লুলের মৃত্যুসংবাদ জানতে পারি। সর্বশেষ উপন্যাসে মা আমিনার মৃত্যু ও ইয়াসিনের নাতনির জন্ম হয়। এসব জন্ম ও মৃত্যু পালাবদল নির্দেশ করে—মিসরের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন এবং জাওয়াদ পরিবারের বিবর্তন। আমরা দেখি, স্বৈরাচারী গৃহকর্তা জাওয়াদ ক্রমে নিস্তেজ হয়ে বাড়ির নিচতলায় নেমে আসে এবং মা আমিনার দয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়। গৃহকর্তা ঘরের বাইরে দরগাহে যাওয়ার অপরাধে বাড়ি থেকে নির্বাসিত মা আমিনাকে ছেলেমেয়েদের চাপে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়। একদিকে বাবা জাওয়াদ ফিকে হতে থাকে, অন্যদিকে মা আমিনা মৃত্যুতেও মহিমান্বিত হয়।
বইটি পড়ার প্রায় সাত বছর পর আমি প্রথমবারের মতো কায়রো সফরে যাই। পুরোনো কায়রো দেখে মনে হয়, জায়গাগুলো তো সবই আমার চেনা—সেই পরিচিত রাস্তাঘাট, দোকানপাট, দালানকোঠা, খদ্দের, দোকানি এবং সদাইপত্র। এর কারণ হলো, বইটি পড়তে বসে পাঠক কেবল নাগিব মাহফুজের ট্রিলজি পাঠ করেন না, তিনি পাঠককে উড়াল দিয়ে নিয়ে যান ঘটনাস্থলে, পাত্রপাত্রীদের মধ্যে। সেখানে পাঠক ঘটনাপ্রবাহের সমান অংশীদার হন, উপন্যাসের চরিত্রদের সঙ্গে উৎফুল্ল ও বিষাদগ্রস্ত হন, মিছিলে, পানশালায়, এমনকি পতিতালয়েও উঁকি মারে। নাগিব মাহফুজকে আমার চিত্রকর বা ছবি আঁকিয়ে মনে হয়েছে। কেবল তিনি রংতুলির বিশাল ক্যানভাসের বদলে শব্দরাজির অনন্য পসরা সাজিয়েছেন, যা আমাদের একাধারে বিমুগ্ধ, তাড়িত ও আলোড়িত করে।
বইটির বহুল পাঠের জন্য এর সুখপাঠ্য বাংলা অনুবাদ হওয়া জরুরি। সম্প্রতি মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকার দস্তয়েভস্কি সংখ্যা বের হয়েছে। পত্রিকার বর্তমান সম্পাদক পরবর্তীকালে নাগিব মাহফুজ সংখ্যার কথা ভাবতে পারেন। প্রাচ্য রহস্যবাদের এমন বিশ্বস্ত কারিগর আর দ্বিতীয়টি নেই।