রফিকুন নবীর ছড়ার বইটি যে কারণে আকর্ষণীয়

রফিকুন নবী
ছবি : প্রথম আলো

রফিকুন নবী বিংশ শতকের সেই ষাটের দশকেই তাঁর শিল্পকর্মের জন্য সুখ্যাতির চূড়া স্পর্শ করেছিলেন। শিল্পসম্মত চিত্রকর্ম ও কাটু‌র্ন আঁকাআঁকির ক্ষেত্রে তখন তিনি অদ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। সবচেয়ে অবাক করার ব্যাপার হলো, সে সময় মাঝেমধ্যে তিনি ছড়াও লিখতেন। মনে আছে, আমাদের সেই তরুণ বয়সে আমরা যখন চলমান সামরিক শাসনবিরোধী ঘটনার প্রেক্ষাপটে দুহাতে ছড়া লিখছি, সংকলন প্রকাশ করছি, তখন তিনি সেসব সংকলনভুক্ত ছড়ার ছবি ও প্রচ্ছদপট যেমন আঁকতেন, তেমনি নিজেও ছড়া লিখে তাতে অন্তভু‌র্ক্ত করার জন্য আমাদের হাতে তুলে দিতেন। কাজটি শিল্পী রফিকুন নবীর মতো তখন আরও কেউ কেউ করেছেন, কিন্তু ছড়ার সঙ্গে সংগতি রেখে ব্যঙ্গ-রসাত্মক অলংকরণ করার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। আর তাঁর ছড়া লেখার হাতটিও দারণ।

এ কথাও ভোলার নয় যে উনসত্তরের সেই উত্তাল দিনগুলোতে আমরা যেসব সংকলন প্রকাশ করেছিলাম, সেগুলো থেকে প্রায়ই বাছাই করে কিছু ছড়া পাঠ করতেন ‘আকাশবাণী’ থেকে দেবদুলাল বন্দ্যোপধ্যায়। আমরা শোনার অবকাশ পেতাম না। অন্য যাঁরা শুনতেন, তাঁরা আমাদের প্রশংসায় এতটাই উদ্বেল হতেন যে আনন্দানুভূতিতে উদ্দীপিত হতাম আমরাও। এ রকমভাবে দেবদুলাল বন্দ্যাোপাধ্যায় একবার নয়, তিন-তিনবার রফিকুন নবীর ছড়া পাঠ করেছিলেন। জানি না, সে কথা নবী ভাইয়ের মনে আছে কি না! তবে তাঁর ছোট ভাই ছড়াকার-শিশুসাহিত্যিক সফিকুন নবীর মনে আছে।

আমাদের সেই প্রিয়তম মানুষ দেশখ্যাত চিত্রশিল্পী ও কাটু‌র্নিস্ট রফিকুন নবীর ছড়ার বই ‘ভূত ভাইরাস ও অন্যান্য ছড়া’ যখন হাতে পাই এবং একনিশ্বাসে পড়ে যখন শেষ করি, তখন যে অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। জার্নিম্যান বুকস বইটি প্রকাশ করে শুধু এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বই পালন করেনি, শিল্পী রফিকুন নবীর ভিন্ন এক পরিচয়, অর্থাৎ অনবদ্য ছড়াকার হিসেবে তাঁর পরিচয়টি তুলে ধরে পাঠক হিসেবে শুধু ব্যক্তিগতভাবে আমার নয়, শিশু-কিশোরসহ সব বয়সী পাঠকেরও ধন্যবাদার্হ হয়েছে।

আবেগের প্রাবল্যে ওপরের কথাগুলো বললেও তার যথার্থ প্রমাণ আমরা পাব, যখন এই বইয়ের ৪৫টি ছড়ার ভেতর থেকে কিছু ছড়ার উদ্ধৃতি তুলে ধরা হবে। বইয়ের শিরোনাম দেখে চমকে উঠলেও প্রতিটি ছড়ার পাঠ শেষে পাঠকেরা অনাবিল আনন্দের স্রোতে ভাসতে থাকবেন। চিন্তারও খোরাক পাবেন। যেমন বইয়ের প্রথম ছড়া ‘সবার জানা আছে’র পুরোটাই তুলে ধরছি, যেখানে তিনি বলছেন, ‘ভূত নাই ধারে কাছে!/ তারা নাকি মায়া/ সেই কোনো কায়া/ অশরীরী তাই/ ছায়া-টায়া নাই।/ জানি সবটাই/ তবু ভয় পাই।/ মনগড়া ভূতে/ পারে নাকো ছুঁতে/ তবু মজা হয়/ পেলে ভূতে ভয়।/ সেই মজাতেই/ এই ভূত-ছড়া/ ভূতে পাওয়াতেই/ ছড়া হবে পড়া।’

রফিকুন নবী যে পাক্কা ছড়াকার, তার প্রমাণ রেখেছেন তিনি ‘ভূতটা বেজায় তালকানা’ ছড়ার ভেতর দিয়ে। ছড়াটার অন্ত্যমিলগুলো যে কত নিখুঁত, তার প্রমাণ তুলে ধরতে ছড়াটির মাত্র প্রথম স্তবকটি তুলে ধরছি, ‘একটা ভূতের/ কাণ্ড শোন/ কিম্ভুত তার তার হালখানা/ ভূতুন ফিকির/ নেইকো কোনো/ অদ্ভুত আর তালকানা।’

রফিকুন নবীর ছড়ার বই ‘ভূত ভাইরাস ও অন্যান্য ছড়া’র প্রচ্ছদ

ভূত ভাইরাস ও অন্যান্য ছড়া

রফিকুন নবী

প্রকাশক: জার্নিম্যান বুকস, ঢাকা, প্রকাশকাল: ডিসেম্বর ২০২১, প্রচ্ছদ ও বই-নকশা: রফিকুন নবী, ৮৪ পৃষ্ঠা, দাম: ৮০০ টাকা।

 বইটি পাওয়া যাচ্ছে

prothoma.com এবং মানসম্মত বইয়ের দোকানে।

‘ভূত-ঝগড়া’ ছড়াটার কথা ভুলে যাব কেন? ছড়াটায় এত মজা লুকিয়ে আছে যে বলে শেষ করা যাবে না। শুরুতেই রফিকুন নবী যখন বলেন, ‘ভুট্টা ক্ষেতে/ মোট্টা ভূত/ সরষে ক্ষেতে চিকনা।/ মোটকা বলে/ পাতলাটাকে/ তোর চেহারা/ ঠিক না।’, তখন ছড়াটির বাদবাকি স্তবকগুলো পড়ার জন্য ব্যগ্র না হয়ে পারা যায় না। এই ছড়াটির অন্ত্যমিলের যে ম্যাজিক দেখান রফিকুন নবী, সেটা সত্যিই মনকে ভীষণ তৃপ্তি দেয়। যেমন ‘চিকনা’র সঙ্গে ‘ঠিক না’, ‘দিক না’র সঙ্গে ‘নিক না’ এবং শেষে ‘ঠিক না’ দিয়ে যেভাবে তিনি ছড়াটার সমাপ্তি টানেন, পাঠ শেষে মনটা সত্যিই ফুরফুরে হয়ে ওঠে।

আমরা যদি এ বইয়ের ‘ভূতে পাওয়া’ ছড়াটি মন দিয়ে পড়ি, তাহলে তার প্রতিটি চরণের ভেতর দিয়ে বর্তমান চলমান সমাজের যে ছবিগুলো ফুটে উঠতে দেখব, তাতে করে ছড়াকার রফিকুন নবীর গভীর সমাজসচেতনতাসম্পৃক্ত মন ও মানসটিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারব। এ সময় পাঠকের মনে হবে, রফিকুন নবী চিত্রশিল্পের পাশাপাশি ছড়াশিল্পেও আরেকটু মনোযোগ দিতেন, তাহলে আমরা তাঁর কাছ থেকে ছড়াসাহিত্যের এক অমূল্য ভান্ডার লাভ করতাম! সেই সঙ্গে পেতাম ছড়াসমেত তাঁর আঁকা ছবির সম্ভার। আশ্চর্য সুন্দর সুন্দর সব ছবি, যেমনটা করতেন বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক সুকুমার রায়।

কী যে মজার তাঁর হৃদয়কাড়া ছড়া ‘করোনা-২’। করোনা নিয়ে যত ছড়া আমি ব্যক্তিগতভাবে পড়েছি, তার মধ্যে রফিকুন নবীর এ ছড়াটি শ্রেষ্ঠতম। এর ধারেকাছে দাঁড়ানোর মতো কোনো ছড়া নেই। যেমন ‘মানবকুলের গর্বটাকে/ করতে ধূলিস্মাৎ/ সব্বাইকে করতে চাস/ ভীষণ কুপোকাত।/ ও করোনা ভাবছিস তুই/ করবি বাজিমাত!/ সময় এলে বুঝবি তখন/ মানুষের কী ধাত্।/ তাই বলছি সর—/ মানুষ মারা ছেড়ে এবার/ নিজেই বরং মর।’

 এ বইয়ের প্রতিটি ছড়া যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি আকর্ষণীয় রফিকুন নবীর আঁকা ছবিগুলো। তুলনাবিহীন তাঁর ছড়ার ছন্দ, অন্ত্যমিল, বিষয়বস্তু। একঘেঁয়েমির এতটুকু শিকার হওয়ার অবকাশ দেননি তিনি আমাদের।

এই ছড়ার বই সব বয়সী পাঠকের জন্য। রফিকুন নবী যেমন তাঁর বিশেষ কাটু‌র্নের জন্য দেশজুড়ে খ্যাত, এ বইও তাঁকে অনবদ্য ছড়াকারের আসনে আসীন করবে নিঃসন্দেহে।