মহাকবি আলাওল লিখেছেন, ‘গুরু মুহম্মদে করি ভক্তি, স্থানে স্থানে প্রকাশিত নিজ মনোউক্তি’। ‘যদ্যপি আমার গুরু’ বইটির বৈশিষ্ট্য আহমদ ছফা নিজেই শনাক্ত করেছেন আলাওলের লেখা এই পঙ্ক্তি দিয়ে। ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে বইটি প্রকাশের আগে দৈনিক বাংলা বাজার পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে দীর্ঘ চার মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল এই লেখা। অনেকেই সেই সময়ে লেখাটির প্রশংসা করেছিলেন। অনেকেই বলেছিলেন, অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের জবানিতে লেখা কথাগুলো আহমদ ছফা নিজে বানিয়ে বানিয়ে লিখেছেন। অবশ্য মুখবন্ধে লেখক দাবি করেছেন, ‘আমার শিক্ষক অধ্যাপক রাজ্জাকের অনন্য ব্যক্তিত্বের মহিমা আমি যেভাবে অনুভব করেছি, অন্তত তার কিছুটা উত্তাপ দশজনের কাছে প্রকাশ করি।’
‘যদ্যপি আমার গুরু’ বই হিসেবে প্রকাশের সময় অধ্যাপক রাজ্জাক বেঁচে ছিলেন। ১৯৯৯ সালের ২৮ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৭০ সাল থেকে নিয়মিত অধ্যাপক রাজ্জাকের কাছে যাওয়া-আসা করতেন আহমদ ছফা। তাঁর ভাষায়, তাঁর কাছে অধ্যাপক রাজ্জাক ‘একদিনের জন্যও পুরানো হয়ে যাননি’। অধ্যাপক রাজ্জাকের বহুমাত্রিক দিক পাঠকের কাছে উন্মোচন করেছেন লেখক। সমালোচক-পণ্ডিতেরা এমনটাই মনে করেন।
অধ্যাপক রাজ্জাকের সংস্পর্শে এসে মানুষ হিসেবে চিন্তার কাঠামো-দেখার ভঙ্গি বদলে গিয়েছে—এ কথা নিঃসংকোচেই বলেছেন লেখক। অধ্যাপক রাজ্জাককে পিএইচডির সুপারভাইজার হিসেবে চেয়েছিলেন ছফা। এই অনুরোধ থেকেই শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের ইতি টেনে শুরু হয় গুরু-শিষ্যের জ্ঞানজগতের সম্বন্ধ। যদিও বইটিতে ছফা উল্লেখ করেছেন, প্রচলিত নিয়ম ভেঙে সুযোগ দেওয়ার পরও তাঁর পক্ষে পিএইচডি করা সম্ভব হয়নি। পিএইডি শেষ করতে না পারার কারণ হিসেবে তিনি অধ্যাপক রাজ্জাককেই দায়ী করেছেন।
ছফা নিজেই স্বীকার করে নিয়ে বলেছেন, ‘দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা নির্মাণে, নিষ্কাম জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে, প্রচলিত জনমত উপেক্ষা করে নিজের বিশ্বাসের প্রতি স্থিত থাকার ব্যাপারে প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকের মতো আমাকে অন্য কোনো জীবিত বা মৃত মানুষ অতটা প্রভাবিত করতে পারেনি। প্রফেসর রাজ্জাকের সান্নিধ্যে আসতে পারার কারণে আমার ভাবনার পরিমণ্ডল বিস্তৃততর হয়েছে, মানসজীবন ঋদ্ধ এবং সমৃদ্ধতরো হয়েছে।’
পিএইডি করার প্রাক্–প্রস্তুতি হিসেবে অধ্যাপক রাজ্জাক একের পর এক বই পড়তে দিচ্ছেন ছফাকে। স্বগতোক্তির মতো ছফা লিখছেন, ‘...এতসব প্রয়োজনীয় বিষয় আমি জানতে পারছি, থিসিস লেখার কাজে নষ্ট করার সময় কই?’ স্বীকার করেছেন স্পষ্ট করে, ‘দৃশ্যত অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে অধিক মনোসংযোগ করার কারণে আমি ভেতরে ভেতরে অনেকখানিই বদলে গিয়েছিলাম।’ সাহিত্যিক ও সমাজবিজ্ঞানী যুগলবন্দীর এই অভ্যাস গড়ে দিয়েছিলেন অধ্যাপক রাজ্জাক।
১৯৭২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন আহমদ ছফা। ফুলার রোডে ব্রিটিশ কাউন্সিলের বাঁ দিকে ‘চোঙ্গাঅলা’ দোতালা বাড়িতে থাকতেন অধ্যাপক রাজ্জাক। আহমদ ছফা যখন ‘যদ্যপি আমার গুরু’ ধারাবাহিকভাবে লিখছেন, ততদিনে এই বাড়িটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। ১৯৭২ সালের আগে থেকেই আহমদ ছফার চারটি বই প্রকাশিত হয়েছে। ‘যদ্যপি আমার গুরু’ বইতে ছফা বইগুলোর নাম লেখেননি।
বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে জানা যায়, ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয় আহমদ ছফার প্রথম উপন্যাস ‘সূর্য তুমি সাথী’। ১৯৭১ সালের জুলাইয়ে প্রকাশিত হয় প্রবন্ধের বই ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’। অধ্যাপক রাজ্জাক চেয়েছিলেন আহমদ ছফার বইগুলো পড়তে। যদিও কোন বইগুলো অধ্যাপক রাজ্জাক পড়েছিলেন এ তথ্য জানা যায় না। তবে ছফার দেওয়া চারটি বই তিনি পড়েছেন। ছফাকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘হবস তাঁর লেভিয়াথান বইতে তিনটা শব্দ “ন্যাস্টি”, “ব্রুটিস” এবং “শর্ট” যেভাবে যে অর্থে ব্যবহার করেছেন, তার বদলে বেবাক ডিকশনারি খুঁইজ্যাও আপনে কোনো শব্দ পাইবেন না। যখন গদ্য লিখবেন এই কথাটি সবসময় মনে রাখবেন।’ আহমদ ছফা লজ্জা পেলেন অধ্যাপক রাজ্জাকের এ কথা শুনে। বুঝলেন দীর্ঘ আবেগসর্বস্ব বাক্য সম্পর্কে অধ্যাপক রাজ্জাক বলেছেন। রাজ্জাক-ছফা সম্পর্কের একপর্যায়ে গুরু রাজ্জাক শিষ্য ছফাকে ভাবিয়ে তুলেছিলেন ‘বেঙ্গলের মুসলিম জনগোষ্ঠী’র বিভাজন নিয়ে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করার পর রোমের প্লিবিয়ান এবং পেট্রিসিয়ানদের নতুন একটা বিভাজন রেখার সৃষ্টি হয়েছিল। এই ধরনের একটা প্রায় অলঙ্ঘনীয় বিভাজন-রেখা বেঙ্গলের মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যেও ক্রিয়াশীল রয়েছে।’
এ কথা সূত্রে ছফা দেখতে পেলেন, অধ্যাপক রাজ্জাক রোমের প্লিবিয়ান খ্রিস্টানদের দোলাচল মনোবৃত্তিটা বাঙালি মুসলমানের মনে কাজ করে যাচ্ছে। এই বিষয়ে আহমদ ছফা লিখলেন ‘বাঙালি মুসলমানের মন’। মাসিক সমকালে লেখাটি প্রকাশের পর সেই সময় চারদিকে এ লেখা নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা হয়েছিল। অধ্যাপক রাজ্জাক বললেন, ‘উনিশ শ তিরিশ সালের দিকে প্রকাশিত শরৎচন্দ্রের বর্তমান “হিন্দু মুসলমান সমস্যা”র পর এত প্রভোক্যাটিভ রচনা আমি বাংলা ভাষায় আর পড়ি নাই।’ শরৎচন্দ্রের এই লেখাকে ছফার মনে হয়েছে সাম্প্রদায়িক রচনা। এমন লেখা যে শরৎচন্দ্র লিখতে পারেন সেটি বিশ্বাস করতেও তাঁর কষ্ট হয়েছে। কিন্তু অধ্যাপক রাজ্জাক কোন অর্থে ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ লেখাটি প্রভোক্যাটিভ বলেছেন সেটি জানার চেষ্টা ছফা করেননি।
ব্যক্তি ও বিদ্বৎসমাজের ইতিহাসধর্মী বই ‘যদ্যপি আমার গুরু’র বেশ অংশ জুড়ে আছেন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান এবং আহমদ ছফা সম্পর্কের নানা দিক। ছফার বিবেচনায় অধ্যাপক রাজ্জাক শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ছাড়া কাউকে স্বীকৃতি দিতে চান না। তবে ছফা মনে করতেন সুলতান একজন বিশ্বমাপের শিল্পী। যা সেই সময়ে স্বীকার করতে অনীহা ছিল সমাজে।
এমন প্রেক্ষাপটে আহমদ ছফা লিখলেন ‘বাংলার চিত্রঐতিহ্য এবং সুলতানের সাধনা’। ‘মূলভূমি’ সাময়িকীতে লেখাটি প্রকাশ ছাড়াও প্রবন্ধটি আলাদা পুস্তিকা হিসেবে প্রকাশিত হয়। অধ্যাপক রাজ্জাক পড়লেন সেই লেখা। পুস্তিকাটি নিয়ে সকাল সকাল হাজির হলেন ছফার ঘরে। ঘুম থেকে জাগিয়ে ছফাকে অধ্যাপক রাজ্জাক বললেন, ‘কামডা ভালা করছেন।’
এরপর বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিয়ে নাতিক্ষুদ্র একটি পুস্তিকা লিখলেন আহমদ ছফা। লেখার বক্তব্য নিয়ে ঢাকা-কলকাতায় পণ্ডিতদের মধ্যে উত্তপ্ত বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। ছফার আগ্রহ ছিল অধ্যাপক রাজ্জাকের এই বিষয়ে মতামত জানার। অধ্যাপক রাজ্জাককে বইটি দিতে গিয়ে ছফা দেখলেন, বইটি তিনি সংগ্রহ করে পড়েছেন। ছফা অপেক্ষায় ছিলেন তাঁর মতামত জানতে।
‘আমি থাকি ছোট ঘরে বড় মন লয়ে, নিজের দুঃখের অন্ন খাই সুখী হয়ে।’—এ কবিতাটি উদ্ধৃত করে অধ্যাপক রাজ্জাক বললেন, ‘বঙ্কিমের ব্যাপারে জিনিসটা অইব একেবারে উল্টা অর্থাৎ আমি থাকি বড় ঘরে ছোট মন লয়ে। হের উপরে আপনের সময় নষ্ট করার প্রয়োজন আছিল না। আপনের ত অঢেল ক্ষমতা, অপাত্রে নষ্ট করেন ক্যান? ইচ্ছা করলে অন্য কাম করবার পারেন।’
অন্য কাজ করেছিলেন আহমদ ছফা। জার্মান কবি গ্যেটের অমর কাব্যাখ্যান ফাউস্ট অনুবাদে মন দিয়েছিলেন তিনি। অধ্যাপক রাজ্জাক দেখে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন। বহু মানুষকে এই অনুবাদের কথা বলেছিলেন। বারবার তাগাদা দিয়েছেন কাজটি শেষ করতে। ১২ বছর ধরে পরিশ্রম করে আহমদ ছফা অনুবাদ কাজটি শেষ করেছিলেন।
বিনয় ঘোষ ‘বাংলার বিদ্বৎসমাজ’ বইতে জানাচ্ছেন যে, রুশদের প্রবর্তিত ‘ইন্টলিজেনসিয়া’র বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে তিনি ‘বিদ্বৎসমাজ’ গ্রহণ করেছেন। অধ্যাপক রাজ্জাক সবার মাঝে থেকেও আনুষ্ঠানিক হয়েও অনানুষ্ঠানিক বিদ্বৎসমাজ গড়ে তুলেছিলেন। আহমদ ছফার মতো আরও অনেককে করেছেন তৃষ্ণার্ত। সাগরের পুরো জল পান করেও এই তৃষ্ণা মিটবে না।
কার্ল ম্যানহাইম বলেছেন, ‘প্রত্যেক সমাজে নানাগোষ্ঠীভুক্ত এমন কিছু লোক থাকেন, যাঁদের কাজ হলো সেই সমাজের জীবনদর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গি রচনা করা এবং ব্যাখ্যা করা।’ অধ্যাপক রাজ্জাকের পরম্পরায় এই কাজটি করেছেন আহমদ ছফা। একটা জীবন দিয়েছেন অতৃপ্তিকে অতিক্রম করতে। অধ্যাপক রাজ্জাক এক বৈঠকে ছফাকে জানিয়েছিলেন, বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ কী চিন্তা করতে পারছেন না। বলেছিলেন, ‘সব থুইয়া আপনেগো দেশের কাম করা উচিত।’ হয়তো এভাবেই গুরুর চরণধূলিতে শিষ্যও তাঁর ঘর গড়ে তোলেন।