ইতিহাসের কাব্যিক স্পন্দন

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

ঐতিহাসিক রণজিৎ গুহের মতে, ইতিহাস কেবল ঘটনার ধারাবিবরণী নয়, বরং এক নৈতিক জ্ঞানকাণ্ড—যেখানে রাষ্ট্রপোষিত বয়ানের অন্তরালে হারিয়ে যাওয়া স্বরগুলোকেই শোনা জরুরি। আধুনিক ইতিহাসচর্চার এই নৈতিক অভিযাত্রায় গুহের উত্তরসূরিরা তাই দলিল ও দস্তাবেজের বাইরে কান পাতেন সাহিত্যের দিকে, বিশেষত লোকসাহিত্যের স্পন্দনে। ইতিহাসের ন্যায়ের অন্বেষণ এখানেই নতুনভাবে অর্থ খুঁজে পায়। সেমন্তী ঘোষও একসময় খানিকটা বিপরীত স্বরে বলেছিলেন, ‘ইতিহাস ছেড়ে দিয়ে কবিতা পড়ো’—যেন ইতিহাসের সত্য কবিতার নৈতিক আবেশেই ধরা দেয়। এই সূত্রেই দ্বাদশ শতকের সংস্কৃত কাব্য ‘রামচরিত’ নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। সন্ধ্যাকর নন্দীর এই কাব্য মূলত একাদশ শতকের শেষভাগে পাল রাজা দ্বিতীয় মহীপালের শাসনের বিরুদ্ধে বরেন্দ্র অঞ্চলে সংঘটিত কৈবর্ত বিদ্রোহের কাব্যিক দলিল। আদি মধ্যযুগীয় বাংলার ইতিহাসের অনন্য এই উৎস চৌধুরী মুফাদ আহমদের অনুবাদে নতুন জীবন পেয়েছে। তাঁর অনুবাদ কেবল ভাষান্তর নয়; এটি ইতিহাস ও কাব্যের সংলগ্ন এক সহৃদয় পাঠ। মুফাদ আহমদ পাঠককে আহ্বান জানান—ইতিহাসের গভীরে প্রবেশ করো কাব্যরসের সহচর হয়ে; কারণ অতীতকে অনুভব করা মানেই নৈতিকতার নতুন আবিষ্কার।

‘রামচরিত’ একটি অনন্য দ্ব্যর্থবোধক সংস্কৃত কাব্য। কবি সন্ধ্যাকর নন্দী এ-কাব্যে শব্দের শিল্পকে ইতিহাসের সঙ্গে একীভূত করেছেন। মূল গ্রন্থে রয়েছে ২১৫টি শ্লোক ও ‘কবি প্রশস্তি’ নামে ২০ শ্লোকের একটি পরিশিষ্ট। তবে বৌদ্ধ অনুলিপিকার শীলচন্দ্র ২২০ শ্লোকের উল্লেখ করেছেন। সমগ্র কাব্যটি গঠিত হয়েছে অসামান্য শ্লেষ অলংকারে। প্রতিটি শ্লোক একই সঙ্গে দুই অর্থ বহন করে। একদিকে তা রামায়ণের পৌরাণিক বয়ান, অন্যদিকে বাংলার পাল বংশীয় রাজা রামপালের ঐতিহাসিক কাহিনি। প্রাপ্ত দুটি পাণ্ডুলিপির একটিতে সংযোজিত টীকা অংশের সাহায্যে এই দ্ব্যর্থক অর্থ অনুধাবন সম্ভব হয়েছে। পরবর্তী সর্গগুলোর কিছু কিছু অংশের ব্যাখ্যা হারিয়ে যাওয়ায় কাব্যটির দ্বিতীয় অর্থ পুনর্গঠন বর্তমান সময়ে বেশ জটিল।

ইতিহাস কেবল ঘটনার ধারাবিবরণী নয়, বরং এক নৈতিক জ্ঞানকাণ্ড—যেখানে রাষ্ট্রপোষিত বয়ানের অন্তরালে হারিয়ে যাওয়া স্বরগুলোকেই শোনা জরুরি। আধুনিক ইতিহাসচর্চার এই নৈতিক অভিযাত্রায় গুহের উত্তরসূরিরা তাই দলিল ও দস্তাবেজের বাইরে কান পাতেন সাহিত্যের দিকে, বিশেষত লোকসাহিত্যের স্পন্দনে।

রামচরিত
সন্ধ্যাকর নন্দী

অনুবাদ: চৌধুরী মুফাদ আহমদ
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২৫
প্রচ্ছদ: আনিসুজ্জামান সোহেল
পৃষ্ঠা: ১১৫
মূল্য: ৩৫০ টাকা

বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে ক্লিক করুন

নন্দী কাব্যের প্রথম দশ শ্লোকে সংক্ষেপে পালবংশের পূর্ব ইতিহাস তুলে ধরেছেন; তারপর মূল আলোচনায় প্রবেশ করেছেন রামপালের কাহিনিকে কেন্দ্র করে। তিনি রামায়ণের রামের ঘটনাকে রামপালের ঘটনার সঙ্গে মিলিয়ে এক অভিনব রূপক রচনা করেছেন—যেখানে কৈবর্ত প্রধান দিব্যর বরেন্দ্র জয় রাবণের সীতা অপহরণের প্রতীক; আর রাম কর্তৃক সীতা উদ্ধারের কাহিনি রূপান্তরিত হয়েছে রামপালের বরেন্দ্র পুনর্দখলের ইতিহাসে। অনুবাদক খুবই ঝরঝরে অনুবাদে তা পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন। কাব্যটির তৃতীয় পরিচ্ছেদে দেখা যায়:

‘৩.১ ক. যিনি কোনো মানুষের গর্ভে জন্মাননি, যিনি তাঁর ভবিষ্যৎ সন্তানদের জননী, দীর্ঘদিন রাক্ষসভূমিতে বাস করেও যিনি পবিত্র ছিলেন—অগ্নিদেবের নিকট থেকে সেই প্রিয়তমা পত্নী সীতাকে লাভ করে রামচন্দ্র তাঁকে গ্রহণ করলেন ও কাছে টেনে নিলেন।

৩.১ খ. শত্রুর সম্পত্তি করায়ত্ত করার পর সদাচারী রামপাল, যুদ্ধ করে দীর্ঘদিন পর অধিকার করা তাঁর প্রিয় ভূমি ও তাঁর প্রজাদের জন্মভূমি বরেন্দ্রীর সুরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।’

অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তনের পর যখন রাম সীতার সতীত্ব বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন, তখন অপমান ও বেদনায় বিদ্ধ সীতা নিজের পবিত্রতার প্রমাণ দিতে চিতার অগ্নিতে প্রবেশ করেন। সেই অগ্নিকুণ্ড থেকেই অগ্নিদেব সীতাকে কোলে করে তুলে এনে রামের হাতে সমর্পণ করে বলেন, ‘এই তোমার বৈদেহী; বাক্য, মন, বুদ্ধি কিংবা চক্ষু—কোনো পথেই তিনি কখনো সততা থেকে বিচ্যুত হননি। তাঁকে গ্রহণ করো।’ অনুবাদকের এ রকম মর্মস্পর্শী অনুবাদ পাঠককে এমন কঠিন কাব্যের গভীর রস উপভোগে নিঃসন্দেহে স্বাচ্ছন্দ্য ও আনন্দ দেবে।

ঐতিহাসিকদের কাছে ‘রামচরিত’ বিশেষ মূল্যবান। কারণ এটি দ্বিতীয় মহীপালের সময়ের বরেন্দ্র বিদ্রোহ এবং রামপালের পুনর্দখল অভিযান সম্পর্কে একমাত্র প্রায় সমসাময়িক দলিল। খানিকটা অতিরঞ্জন সত্ত্বেও, এই কাব্য ইতিহাস, সাহিত্য ও ভূগোল তিন ক্ষেত্রেই মধ্যযুগীয় বাংলার এক অমূল্য সম্পদ।

গ্রন্থের শেষ দুটি সর্গে মদনপালের শাসন পর্যন্ত পাল রাজাদের ইতিহাস বর্ণনা করে নন্দী ‘কবিপ্রশস্তি’ অংশে নিজেকে কলিযুগের বাল্মীকি হিসেবে ঘোষণা করেছেন এবং তাঁর কাব্যের প্রকৃতি ও রচনাশৈলী ব্যাখ্যা করেছেন। ঐতিহাসিকদের কাছে ‘রামচরিত’ বিশেষ মূল্যবান। কারণ এটি দ্বিতীয় মহীপালের সময়ের বরেন্দ্র বিদ্রোহ এবং রামপালের পুনর্দখল অভিযান সম্পর্কে একমাত্র প্রায় সমসাময়িক দলিল। কাব্যে রামপালের চরিত্রের প্রতি কবির প্রশস্তিমূলক পক্ষপাত স্পষ্ট। ইতিহাস পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি অপরিহার্য হলেও, তৃতীয় সর্গের প্রথম দিকের আঠারোটি শ্লোক বরেন্দ্র অঞ্চলের ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক বিবরণে অমূল্য। এই অংশে গঙ্গা ও করতোয়ার মাঝের ভূখণ্ডের প্রকৃতি, প্রাসাদ, উদ্যান, ধর্মকেন্দ্র, নগর (বিশেষত রামাবতী) এবং প্রতিষ্ঠানাদি, বিশেষ করে জগদ্দল মহাবিহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। খানিকটা অতিরঞ্জন সত্ত্বেও, এই কাব্য ইতিহাস, সাহিত্য ও ভূগোল তিন ক্ষেত্রেই মধ্যযুগীয় বাংলার এক অমূল্য সম্পদ।

সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত’ শুধু প্রাচীন কাব্য নয়, বরং ইতিহাস, নৈতিকতা ও নন্দনের এক আন্তঃসম্পর্কিত দলিল। এখানে রামায়ণের পৌরাণিক কাহিনি ও পাল যুগের রাজনৈতিক বাস্তবতা একে অপরের প্রতিফলন হয়ে ওঠে। সন্ধ্যাকর নন্দী একদিকে যেমন কাব্যের মাধ্যমে রাজশক্তির গৌরবগাথা রচনা করেছেন; তেমনি এখানে ইতিহাসের অন্তরালে থাকা সামাজিক স্পন্দনও সূক্ষ্মভাবে প্রকাশ পেয়েছে। চৌধুরী মুফাদ আহমদের অনুবাদ সেই দ্ব্যর্থবোধক শিল্পভাষাকে নতুন প্রজন্মের পাঠকের কাছে জীবন্ত করে তোলে। পাঠকের জন্য ‘রামচরিত’ পাঠ অতীতকে নৈতিক ও বোধনমূলকভাবে অনুধাবনের এক গভীর ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে।