ভাষা আন্দোলনের সূচনা পর্বের অজানা অধ্যায়

ঢাকায় জিন্না
গ্রাফিকস: প্রথম আলো

ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতিসত্তার জাগরণকাল। যার পথ ধরে অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়েছে এই ভূখণ্ডের মানুষ। প্রতিষ্ঠা করেছে ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ। ইতিহাস–গবেষকেরা ভাষা আন্দোলনকে দুটি পর্বে ভাগ করে থাকেন। ১৯৪৮ সালের প্রথম পর্বে ছিল সভা-সমাবেশ, স্মারকলিপি, ধর্মঘট-হরতাল। আর ১৯৫২ সালের দ্বিতীয় বা চূড়ান্ত পর্ব ছিল রক্তের বিনিময়ে ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠা। ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বের এক আলোচিত চরিত্র মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, কায়েদে আজম বা মহান নেতা জিন্নাহ সম্পর্কে যৌক্তিক কারণেই যে কারও অনাগ্রহ থাকতে পারে; কিন্তু ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে তাঁকে উপেক্ষা করা কঠিন। এমনকি বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসেও জিন্নাহ ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। কারণ, ১০ দিনের জন্য পূর্ব বাংলায় এসে ঢাকার বুকে দাঁড়িয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিয়ে বাঙালি জাতির মর্মমূলে আঘাত করেছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল এক অভূতপূর্ব জাগরণযাত্রা।

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীন হলে ভারতবর্ষের ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনের কাছ থেকে গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব বুঝে নিয়েছিলেন জিন্নাহ। এটি একটি আলংকারিক পদ হলেও ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদায় তিনিই ছিলেন নতুন পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তি। জিন্নাহ ঢাকায় এসেছিলেন ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ। ২৯ মার্চ পর্যন্ত ১০ দিনের এই সফরে তাঁর সঙ্গী ছিলেন ছোট বোন ফাতেমা জিন্নাহ। এই ১০ দিনের মধ্যে দুই দিন জিন্নাহ ছিলেন চট্টগ্রামে।

পাকিস্তানের প্রধান নেতার এই ঘটনাবহুল ১০ দিন নিয়ে ইতিহাস–গবেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদের নতুন বই ঢাকায় জিন্না। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ, সরকারি নথি, রেডিওর রেকর্ডিং ও অনেক অমূল্য গ্রন্থ থেকে তথ্য সন্নিবেশিত করে ঘটনাবহুল এই ১০ দিনের একটি বিশ্লেষণমূলক ব্যবচ্ছেদ করেছেন লেখক। যাতে উঠে এসেছে ইতিহাসের অনেক অজানা অধ্যায়। যেগুলোর মধ্যে পাঠককে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করতে পারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তনে দেওয়া জিন্নাহর ভাষণ ও শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের বিষয়টি। এর আগে ভাষা আন্দোলনের এই অধ্যায় এত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে কেউ তুলে ধরেছেন বলে আমার জানা নেই।

লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে মুসলমানদের আলাদা পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বাঙালি জাতির অবদান অনস্বীকার্য। বলা যায়, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অনেক ক্ষেত্রে বাঙালিরাই সামনের সারিতে ছিলেন। যে কারণে পাকিস্তানের প্রধান ব্যক্তি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকা সফরকে ঘিরে গোটা পূর্ব পাকিস্তানে ছিল একধরনের উন্মাদনা, উৎসবের আমেজ। যদিও এর মাঝেই ভাষার প্রশ্ন নিয়ে ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তনে ঘটে যায় এক ঐতিহাসিক ঘটনা। ওই দিন জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে বিশেষ সমাবর্তনে এক অভিভাষণ দিয়েছিলেন। তাতে তিনি ভাষা আন্দোলনকে ভারতের উসকানি হিসেবে উল্লেখ করেন। এ ছাড়া এই আন্দোলনের পেছনে ভারতের ষড়যন্ত্র ও পাকিস্তানের মাটিতে সক্রিয় ‘পঞ্চম বাহিনী’ সম্পর্কে সতর্ক করেন জিন্নাহ।

এই সভাতেই জিন্নাহ আবারও ঘোষণা করেন ‘উর্দুই রাষ্ট্রভাষা হবে।...এই ভাষায় ইসলামি সংস্কৃতি ও মুসলিম ঐতিহ্য যত বেশি চর্চা হয়েছে, অন্য কোনো প্রাদেশিক ভাষায় সে রকম হয়নি। এই উর্দু ভাষা অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রের কথ্য ভাষার সমকক্ষ।’ কার্জন হল চত্বরে জিন্নাহর এই ঘোষণা ছাত্ররা বিনা চ্যালেঞ্জে মেনে নেননি। এই ঘোষণার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ হয়েছিল। এ সময় ‘নো নো’ বলে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী নাইমউদ্দীন আহমদ। তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক। ভাষার প্রশ্নে পাকিস্তানের প্রধান নেতার সামনে নাইমউদ্দীন আহমদের এই প্রতিবাদ নিয়ে গ্রন্থটিতে বিস্তারিত আলোচনা আছে। খুব সম্ভবত এর আগে এই ঘটনার এত বিস্তারিত বর্ণনা কোথাও প্রকাশিত হয়নি। এ গ্রন্থে এটি একটি বিশেষ সংযোজন। এ ছাড়া ভাষা ও ছাত্ররাজনীতি নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের নেতাদের সঙ্গে একটি বৈঠকের বিস্তারিত বর্ণনা আছে বইটিতে, যা ভাষা আন্দোলনের প্রতি আগ্রহী পাঠকদের চিন্তার খোরাক জোগাতে পারে।

ঢাকা থেকে আকাশপথে জিন্নাহ চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন ২৫ মার্চ। সেখানে দুদিনের কর্মব্যস্ত ঘটনার বর্ণনা আছে বইটিতে। সেখান থেকে ফিরে ২৮ মার্চ ঢাকায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা, বাংলার সাবেক প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হকের সঙ্গে বৈঠক করেন জিন্নাহ। বৈঠকটি সৌহার্দ্যপূর্ণ ছিল না। আজিজুল হক শাজাহানের বিবরণে জিন্নাহ-ফজলুল হকের বৈঠকের যে বর্ণনা এখানে উঠে এসেছে, তা এক অনন্য সংযোজন।

বইটির উপসংহারে ভাষা আন্দোলন, জিন্নাহর ভূমিকা ও উর্দু ভাষার পক্ষে তাঁর অনুরাগের একটি বিস্তারিত বিশ্লেষণ আছে। যা পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে।

তবে গ্রন্থটিতে কিছু জায়গায় এক তথ্য একাধিকবার আলোচিত হয়েছে, যা এড়ানো সম্ভব ছিল। বইটি পড়তে গিয়ে ‘কুইসলিং’, ‘পঞ্চম বাহিনী’সহ বেশ কয়েকটি শব্দের বিস্তারিত বিবরণ বা ফুটনোটের প্রয়োজন অনুভূত হয়েছে।

ঢাকায় জিন্না
মহিউদ্দিন আহমদ

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
প্রকাশ: জুলাই ২০২৫
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল
পৃষ্ঠা: ১৫৬, মূল্য: ৪২০ ৳