জানা ইতিহাসের অজানা অধ্যায়

সেদিন ছিল খুকুর জন্মদিন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, খুকুর পঞ্চম জন্মদিন। খুকু সারা দিন অপেক্ষা করে বসে ছিল তার শিক্ষিকা মা স্কুল শেষে বাসায় ফেরার পথে সুন্দর একটা কেক আর দারুণ সব উপহার নিয়ে বাসায় ফিরবেন, কিন্তু বিকেলেই খবর আসে, খুকুর মা জেলে!

কল্যাণী/মমতাজ

হাসনাত আবদুল হাই

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০২৪, প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, ১২৮ পৃষ্ঠা, দাম: ৩৩০ টাকা।

বইটি পাওয়া যাচ্ছে

prothoma.com এবং মানসম্মত বইয়ের দোকানে।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন জোরদার হচ্ছিল, ছাত্র–জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করছেন, সেই আন্দোলনের হাওয়া এসে লেগেছে নারায়ণগঞ্জেও। খুকুর মা নারায়ণগঞ্জ মর্গান গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মমতাজ বেগমও তাঁর ছাত্রীদের নিয়ে নারায়ণগঞ্জে ভাষার জন্য লড়াইয়ে যোগ দেন। মমতাজ বেগমের আসল নাম কল্যাণী, কলকাতা হাইকোর্টের দুঁদে বিচারপতি রায়বাহাদুর মহিমচন্দ্রের একমাত্র কন্যা কল্যাণী ভালোবেসে বিয়ে করেন ফরিদপুরের মান্নাফকে, বিয়ের সময় ধর্মান্তরিত হয়ে নাম বদলে হন মমতাজ বেগম। কল্যাণী ওরফে মমতাজের ছোটবেলা কেটেছে মামা প্রমথনাথ বিশী, মামার বন্ধু ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, দীনেশচন্দ্র সেন, ডা. বিধানচন্দ্র রায়—এসব কিংবদন্তি মানুষের আদর ও সাহচর্যে। কল্যাণীর মামা প্রমথনাথ তখন গবেষণা করছেন বাংলা গদ্যের বিকাশ নিয়ে আর শহীদুল্লাহ কাকুর গবেষণার বিষয় বাংলা ভাষার উদ্ভব। এই বিখ্যাত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে থেকে থেকে, তাঁদের আলোচনা শুনতে শুনতে নিজের ভাষার প্রতি কল্যাণীর তৈরি হয় গভীর অনুরাগ। আর তাই ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর স্বামীর সঙ্গে পূর্ব বাংলায় এসে থিতু হলেও ফেব্রুয়ারির সেই দিনে ভাষার জন্য লড়াইয়ের ডাকে চুপ করে বসে থাকতে পারেননি কল্যাণী। নিজের ছাত্রী আর পাশের জুট মিলের শ্রমিকদের সঙ্গে নিয়ে অসমসাহসিকতায় নেমে পড়েন রাজপথে।

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে প্রায় সবার অলক্ষ্যে থেকে যাওয়া এই মমতাজ বেগমের আত্মত্যাগ ও সাহসিকতার ইতিহাসকেই আমাদের সামনে তুলে নিয়ে এসেছেন দেশের প্রবীণ কথাসাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাই, তাঁর কল্যাণী/মমতাজ নামের এই ডকু-ফিকশনধর্মী উপন্যাসে।

কল্যাণীর পাশাপাশি এই উপন্যাসে সপ্রাণ হয়ে উঠেছে ইতিহাসের কিছু বাস্তব চরিত্রও। যেমন জেলখানায় কল্যাণীর সঙ্গে দেখা হয় তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্রের। দুই অসমসাহসী নারী একে অপরের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন ভীষণ। স্বদেশ ও মাতৃভাষা যে প্রাণের চেয়েও মূল্যবান, এ সময় সেই উপলব্ধি হয় কল্যাণীর। আর তাই জেল থেকে ছাড়া পেয়েও স্বামী আর সন্তানকে এক পাশে রেখে বেছে নেন শিক্ষকতা ও রাজনীতিকে।

একদিন সেই কলকাতা থেকে বাংলাদেশে এসেও দেশকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলেন কল্যাণী। বাংলা ভাষার জন্য লড়াইয়ে নেমে আর সংসারে ফেরা হলো না তাঁর, দৈনন্দিনতার হাতে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা মান্নাফ বা পরিবারেই কেউ বোঝেননি বৃহত্তর জীবনের কাছে মমতাজ/কল্যাণীর দায়বদ্ধতাগুলো।

এমন আত্মত্যাগী যে নারী; মৃত্যুর পর পরিবারের প্রায় অগোচরেই বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয় তাঁকে। ইতিহাসের এক অজানা অধ্যায় হয়ে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যান মমতাজ বেগম। আমাদের ইতিহাসের এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়েও মমতাজ বেগমের ঠাঁই হয়নি পুস্তকের পাতায়; সালাম, বরকত, রফিক কিংবা জব্বারের সঙ্গে একই সুরে গাওয়া হয় না মমতাজ বেগমের নাম। জাতি হিসেবে আমাদের এই আত্মগ্লানি থেকে মুক্তি দিতেই হাসনাত আবদুল হাই অত্যন্ত সুনিপুণ দক্ষতায় ও আন্তরিক পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে মমতাজ বেগমের জীবনের নানা দিককে আমাদের সামনে এনে হাজির করেছেন।

জীবনীভিত্তিক উপন্যাস রচনায় হাসনাত আবদুল হাই দারুণ দক্ষ। এর আগে নভেরা, এস এম সুলতান প্রমুখ ব্যক্তিত্বকে নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন তিনি এবং সেগুলো সুবিদিতও হয়েছে। তাঁর এই নতুন কল্যাণী/মমতাজ তার ব্যতিক্রম নয়। তবে অন্যান্য উপন্যাসের চেয়ে এই উপন্যাসের পার্থক্য হলো, নভেরা বা সুলতান সম্পর্কে যেমন অনেক তথ্য পাওয়া যায়, সেই তুলনায় মমতাজ বেগম নিয়ে তথ্য তেমন একটা নেই। ফলে উপন্যাসের পটভূমি রচনা করতে গিয়ে ঔপন্যাসিককে ইতিহাসের রশির ওপর দিয়ে হেঁটেই কল্পনার সব জানালা খুলে দিতে হয়েছে। বলা যেতে পারে, ইতিহাসের সঙ্গে মিলিয়ে–মিশিয়ে লেখকের কল্পনার এই অপূর্ব ব্যবহারের কারণেই সফল হয়েছে কল্যাণী/মমতাজ

মমতাজ বেগম আমাদের গর্ব। তাঁর জীবন আমাদের গৌরবময় ইতিহাসের এক অনন্য দলিল, তাঁকে জানার মধ্য দিয়েই তাঁর সীমাহীন আত্মত্যাগের প্রতি খানিকটা হলেও সম্মান জানানো হবে। হাসনাত আবদুল হাইকে ধন্যবাদ, বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া এমন এক লড়াকু নারীকে নিয়ে উপন্যাস লেখার জন্য। জানা ইতিহাসের এক অজানা অধ্যায়কে নতুনভাবে তুলে আনার জন্য।