সৈয়দ আব্দুল হাদীর ‘জীবনের গান’, জন্মদিনে যে পাঠ জরুরি
বাংলা গানের আলাপে বাংলাদেশ পর্বের ইতিহাস এবং এই সময়ের নির্মাতাদের নিবিড় পাঠের প্রয়াস খুব অনুমতিভাবেই গরহাজির। এই বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতেও যাঁরা সাঁকো গড়ে দিয়েছেন পূর্ব যুগের সঙ্গে বর্তমানের, কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা গানের স্বর্ণযুগের সমান্তরালে স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা গানের একটা স্বকীয় ভিত্তি গড়ে দিয়ে জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে আজও সমূহ ভালোবাসা কুড়াচ্ছেন, সেই সংক্ষিপ্ততম তালিকায় অগ্রণী নাম সৈয়দ আব্দুল হাদী।
অজস্র জনপ্রিয় গানের শিল্পী পরিচয়ের আড়ালে তাঁর সুরকার সত্তা, সফল সংগঠক পরিচয়, পেশাদারি জীবনের সাফল্যের ফিরিস্তি সচরাচর আলাপে আসে না। প্রথমা থেকে প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘জীবনের গান’ (২০২২) তুলে ধরে তাঁর ব্যক্তিজীবনের সমান্তরালে বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনের বিবর্তনের এক জরুরি বয়ান। ‘আমি ভাগ্যবান, ৭৮ ঘূর্ণির গ্রামোফোন রেকর্ড থেকে এক্সটেন্ডেড প্লে, লং প্লে, ক্যাসেট সিডি—সব মাধ্যমেই কাজ করেছি, বর্তমান ইন্টারনেট মাধ্যমেও কাজ করছি।’
ছয় দশকের সংগীতজীবনে শুধু মাধ্যমের বৈচিত্র্যেই ঋদ্ধ নয়, বরং চলচ্চিত্র, বেতার, টেলিভিশনে নজরুলসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত, লোকসংগীত ও আধুনিক বাংলা গানের স্বচ্ছন্দ যাতায়াতের মাঝে শুরুর দিকে উর্দু গানেও সুরের মাধুর্য ছড়িয়েছেন। দৃশ্যত আপাত–অনায়াসলব্ধ এ সাফল্যের কার্যকারণ বলা চলে নিবিড় পাঠ করা হয়নি, তাঁর বিস্তৃত সাংগীতিক শিল্পকৃতির অনেক কিছুই সংরক্ষিত নেই। এই চর্চাটুকুই ঠিকঠাকভাবে আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শুরু হয়নি। ‘জীবনের গান’ গ্রন্থটি এই অনালোকিত, অনালোচিত ইতিহাস পাঠের প্রস্তাবনা এবং জরুরি রসদও বটে।
এই বইয়ে সৈয়দ আব্দুল হাদী অকপটে বলে যান সংগীতে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা ব্যতিরেকেই চলে এসেছিলেন গানের জগতে, কিন্তু পরবর্তী জীবনে যখনই যেভাবে সুযোগ পেয়েছেন শেখার সুযোগটুকু কাজে লাগাতে সচেষ্ট ছিলেন ষোলো আনা।
আকৈশোর প্রাচ্য, পাশ্চাত্যের ধ্রুপদিসহ বিচিত্র সংগীতের মুগ্ধ শ্রোতা একসময় নিজেই হয়ে উঠেছেন এক মুগ্ধকর! রাগাশ্রয়ী গানেও আস্থাভাজন হয়ে উঠেছিলেন সুরকার, সংগীতায়োজকদের আর তার নমুনা তো শ্রোতাদের হাতে রইলই। তবে শুধু গায়নকৌশল আর কণ্ঠশৈলী দিয়েই কি এমন কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন তিনি? ‘জীবনের গান’ প্রচ্ছন্নভাবে জানাচ্ছে সেই উত্তর।
জন্মস্থান ও শৈশব, কৈশোর জীবনে আগরতলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং স্বল্প সময়ের সিলেটে অবস্থানের সূত্রে প্রকৃতি ও মানুষের সঙ্গে যে অসামান্য বন্ধন গড়ে উঠেছিল, বাউন্ডুলে, অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মনটি সতত সজীব রয়েছে আজীবন, সেটা পিরামিডের দেশ হোক আর কিলিমানজারোর পাদদেশ যেখানেই হোক না কেন। এই রোমাঞ্চকর অভিযাত্রী গানের ভুবনেও প্রায় সমরূপভাবে রবীন্দ্র-নজরুলসংগীতের ভুবনে পা রেখেও অনায়াসে নতুন দিনের, নতুন মেজাজের গানের কান্ডারি হয়ে উঠেছেন, আবার এই জনপদের মরমি সুরটিকেও ভোলেননি, রাগসংগীতের সুষমাটুকুও না।
সাধারণ শ্রোতা অত বাছবিচার করে খাতাপত্র নিয়ে শোনেন না হয়তো, কিন্তু এই বৈচিত্র্যই তাঁকে সর্বস্তরের শ্রোতার কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছে নিঃসন্দেহে। সংগীতেই কাঠামোগত শিক্ষণে অতটা সময় দেনটি হয়তো, তবে আদ্যোপান্ত শিল্পীমনকে ঋদ্ধ ও শাণিত করে তোলার প্রস্তুতিটুকু তাঁর আদ্যোপান্ত শিল্পীজীবনে জড়িয়ে আছে।
‘জীবনের গান’ তাই শুধুই নিজের কথা নয় বরং নিজের সময়ের এমনকি পূর্বতন সংগীতকারকের প্রতিও অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা নিবেদনের অঞ্জলিতে সুবাসিত। আগরতলার গল্প বলতে গিয়ে তাই শচীনকর্তার কথাই বলেন বেশি, বাংলাদেশের সংগীতে অসামান্য ব্যক্তিত্ব আব্দুল আহাদের কীর্তি, মাহাত্ম্য তাই আলাপে আসে বারবার। বন্ধু, সহকর্মী, সহশিল্পী, শিক্ষক এমন নানান পরিচয়ের গুণীজনদের নিয়ে অল্প কথায় বিস্তর চিন্তার খোরাক জুগিয়ে গেছেন পাতায় পাতায়। সেখানে মজার কাহিনি আছে, বেদনার বয়ানও আছে, বিশ্বদরবারে নিজের দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার গৌরবময় অনেক অজানা আখ্যানও আছে।
তবে এসব ছাপিয়ে তাঁর আশ্চর্য ভ্রামণিক মন সর্বত্র মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। পরিবেশ এবং প্রতিবেশের প্রতি তাঁর সযত্ন, সহমর্মী মনের পরিচয় দেখে কখনো মনে হবে যে তিনি একজন পরিবেশবাদী। ভ্রমণের বর্ণনায় তাই প্রতিবেশ সংরক্ষণে নিজের মতামতটুকু নিঃসংকোচে জানিয়ে গেছেন সর্বত্র। এই সজীব মনটিই তার শিল্পসত্তাকে কখনোই মরে যেতে দেয়নি।
উপরন্তু সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে, নিবিষ্ট পাঠক হিসেবে তাঁর একাগ্রতাও শিল্পী হিসেবে তাঁর ভিত মজবুত করেছে, তা বলাই বাহুল্য। মান্না দে, লতা মঙ্গেশকর, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সতীনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ কিংবদন্তি শিল্পীর পদচারণে মুখর গত শতকের পঞ্চাশ দশকের সমান্তরালে বাংলা গানের নতুন কেন্দ্র নির্মাণ, নতুন ধারার বিকাশ ঘটানো এবং তারই ধারাবাহিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশের সংগীতজগতের বিনির্মাণ মোটেও সহজ কাজ ছিল না।
আজকের কোটি ভিউ কালচার, অবাধ গণমাধ্যমের সাংগীতিক উন্মাদনায় দাঁড়িয়ে এই বিবর্তন পাঠ করাটাও দুরূহ বৈকি, তবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নিশ্চয়ই। সৈয়দ আব্দুল হাদী এই দুই যুগের সাক্ষী ও পালাবদলের অন্যতম সৈনিক। বাংলা গানের গতিপথ বুঝতে তাই শুরু করতে হবে একটু পেছন থেকেই। বাংলা গানের শ্রোতা তৈরি, বাজার তৈরি, পেশাদার সংগীতশিল্পী তৈরি, শিল্পীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামেও তাঁর ও তাঁর সহযোদ্ধা, অগ্রণীদের কীর্তি পাঠ করা জরুরি এবং তা ভবিষ্যৎ নির্মাণের স্বার্থেই জরুরি। বাংলা গানের ইতিহাস পরম্পরারই ইতিহাস, এটা ভুলে যাওয়া আত্মঘাতী ব্যাপার। তিনি আলাউদ্দিন আলীর সুরের যেমন অনুরক্ত, তেমনি আইয়ুব বাচ্চুর প্রতিও অনুরক্ত, যদিও দুজন দুই ঘরানার!
সংগীতের বিচিত্র ভুবনের প্রতি সতৃষ্ণ দৃষ্টি না থাকলে ছয় দশকের এ গল্প আর দাঁড়াত না নিশ্চয়ই। বাংলাদেশের গানের জগতের সাম্প্রতিকালের প্রতিনিধিদের বোধ করি এই পাঠটুকু নেওয়া জরুরি। প্রতিভার স্ফুরণ চারপাশে কিন্তু স্মার্ট দুনিয়ার বাইরের দিকে নজর দেওয়ার অবসর সম্ভবত অনেক কম সবার, ফলে গানের আয় ফুরায় দ্রুত অথচ ‘চক্ষের নজর এমনি কইরা একদিন খইয়া যাবে’, ‘একবার যদি কেউ ভালোবাসত’, ‘চলে যায় যদি কেউ বাঁধন ছিঁড়ে কাঁদিস কেন মন’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো আর কত দিন বল সইব’, ‘আছেন আমার মোক্তার, আছেন আমার ব্যারিস্টার’, ‘যে মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে’ কিংবা ‘চোখ বুঝিলে দুনিয়া আন্ধার’ প্রভৃতি গান কবেই পার করেছে দশকের সীমা–পরিসীমা!
ঢাকার বাইরে বিভিন্ন সিনেমা হলে গানের অনুষ্ঠান আয়োজন আজ কষ্টকল্পনা হয়তো। পেশাদার জীবনে অধ্যাপনা, টেলিভিশনে চাকরির পর পাবলিক লাইব্রেরির দায়িত্ব পালনকালে এটাকে যথার্থ অর্থেই পাবলিক করে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর যে অবদান, এটা বোধ করি অনেকেরই অজানা।
‘জীবনের গান’জুড়ে এমনই অজস্র কথার মোড়কে বাংলাদেশের গানের জগতের কীর্তিমান মানুষদের ইতিহাসের টুকরো বয়ান ছড়ানো। সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা গানের স্বকীয় পরিচয় নির্মাণের যে সংগ্রাম এবং তার অগ্রসৈনিকদের কীর্তি নিবিড় পাঠ দাবি করে।
একবার লাহোর থেকে করাচি ফেরার পথে ট্রেনে প্রচণ্ড ভিড়। সামান্য আলাপে আশপাশের যাত্রীরা ‘আরে ভাই, হামারে সাথ এক সৈয়দ হ্যায়’ বলে শশব্যস্ত হয়ে আসন করে দিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর শিল্পী পরিচয় পেয়ে ঢের উচ্ছ্বাস নিয়ে একজন প্রশ্ন করেছেন, ‘আপ কেয়া আব্দুল আলীম অওর ফেরদৌসী বেগম কো পেহচানতে?’ এই দৃশ্যের বিশদ ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন নিশ্চয়ই। সৈয়দ আব্দুল হাদী নিজেই ইতিহাস হয়ে বাংলা গানের জগতে স্থায়ী আসন পেয়ে গেছেন কবেই, আমাদের কাজ বরং সেই ইতিহাস ঢুঁরে আগামীর পথরেখা বিনির্মাণ।
১৯৪০ সালে আজকে দিনে জন্মগ্রহণ করা এই মহান শিল্পীর ‘জীবনের গান’ পাঠই হোক তবে এবারের জন্মদিনের অঞ্জলি। হে নূতন, দেখা দিক আরবার...
জীবনের গান
সৈয়দ আব্দুল হাদী
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০২২, প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, ২০০ পৃষ্ঠা, দাম: ৪৫০ টাকা।
জীবনের গান বইটি পাওয়া যাচ্ছে prothoma.com-এ