আলোকচিত্রপুরাণের অন্দর কথা

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

প্রখ্যাত আলোকচিত্রশিল্পী সাহাদাত পারভেজের আলোকচিত্রপুরাণ বইয়ে সংকলিত হয়েছে বাংলায় ফটোগ্রাফির আদি প্রবন্ধসমূহ। উনিশ শতকের আশির দশক থেকে বিশ শতকের চল্লিশের দশক পর্যন্ত প্রকাশিত বিস্তর প্রবন্ধ থেকে সম্পাদক তাঁর অভিজ্ঞ বিবেচনায় ছেঁকে তুলেছেন প্রসিদ্ধ আখ্যানসমূহকে।

আলোকচিত্রপুরাণ গ্রন্থের সূচনা সমৃদ্ধ একটি ভূমিকা দিয়ে, সম্পাদক ‘নব জাগরণের স্বর্ণসময় ও বাংলায় ফটোগ্রাফিচর্চা’ শিরোনামে তা উপস্থাপন করেছেন। ভারতীয় উপমহাদেশকে মূল বিন্দুতে রেখে বৈশ্বিক ফটোগ্রাফি চর্চার কথা উপস্থাপন করে তুলনামূলক ও গবেষণাধর্মী আলোচনা লিখেছেন সাহাদাত পারভেজ।

বাংলায় ফটোগ্রাফিচর্চা বর্তমানে যতটা সুলভ, সে বিষয়ে বাংলা ভাষায় সূক্ষ্ম তথ্য প্রদানকারী গ্রন্থ ততটাই দুর্লভ। এ বিবেচনায় সাহাদাত পারভেজ নিঃসন্দেহে প্রশংসার কাজ করেছেন। তাঁর সংগৃহীত ভারতীয় উপমহাদেশের ২৬ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির আলোকচিত্রবিষয়ক প্রবন্ধ গ্রন্থভুক্ত হয়েছে। ক্যামেরার আলোকে শব্দে উপস্থাপনযোগ্য এমন তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থ সত্যিই দুর্লভ। বাংলা ভাষার লেখকসহ বিভিন্ন পেশাজীবীদের শৌখিনতার রহস্য উন্মোচিত হয়েছে আলোকচিত্রপুরাণ গ্রন্থে। এই গ্রন্থের সূচিপত্রে উল্লেখিত সেই সব বিশিষ্ট লেখকের নাম আগ্রহের উদ্রেক ঘটায়।

ভারতীয় উপমহাদেশকে মূল বিন্দুতে রেখে বৈশ্বিক ফটোগ্রাফি চর্চার কথা উপস্থাপন করে তুলনামূলক ও গবেষণাধর্মী আলোচনা লিখেছেন সাহাদাত পারভেজ। তাঁর সংগৃহীত ভারতীয় উপমহাদেশের ২৬ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির আলোকচিত্রবিষয়ক প্রবন্ধ গ্রন্থভুক্ত হয়েছে।

আলোকচিত্রপুরাণ
সাহাদাত পারভেজ

[সংগ্রহ-গবেষণা-ভূমিকা-সম্পাদনা]
প্রকাশক: কথাপ্রকাশ
প্রচ্ছদ: আনিসুজ্জামান সোহেল
প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২৫
মূল্য: ৭০০, পৃষ্ঠা: ৩৬৮

ফরাসি দেশে আবিষ্কৃত ক্যামেরা যখন বাঙালির কাছে বিজ্ঞানের আগ্রহোদ্দীপক উপকরণ হিসেবে পৌঁছায়, তখন সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্যরা শখের বশে এর চর্চা শুরু করেন। জোসেফ নিসেফোর নিপেস ও লুই ডাগুয়েরের সম্মিলিত ফটোগ্রাফি চর্চা বাংলার উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীদের অনুপ্রাণিত করে। নতুনকে জানা ও প্রয়োগের নেশায় শুরু হয় চর্চার আরেক অধ্যায়; আর সেই চর্চার প্রথম প্রকাশমাধ্যম ছিল কলকাতার জোড়াসাঁকো থেকে প্রকাশিত অমৃতলাল বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত একটি পত্রিকা শিল্পপুষ্পাঞ্জলি। এরপর ফটোগ্রাফি চর্চা প্রবেশ করে ঠাকুর বাড়িতে। ফলে সাধনা পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর। উল্লেখ্য, তাঁর মা জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ছিলেন তখনকার দিনের নামকরা আলোকচিত্রশিল্পী। বাংলার অন্যতম বিজ্ঞানসাধক রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীও জড়িয়ে পড়েন নতুন এই শিল্পকর্মে। সে সময়ের আলোকচিত্রজগতের সব খোঁজখবর ছিল তাঁর নখদর্পণে।

পূর্ববঙ্গের বংশোদ্ভূত চিত্রকর ও আলোকচিত্রী আদীশ্বর ঘটক রচিত ফটোগ্রাফি শিক্ষা বাংলা ভাষায় মুদ্রিত ফটোগ্রাফিবিষয়ক প্রথম গ্রন্থ। এরপর মন্মথনাথ চক্রবর্তী, আনন্দকিশোর ঘোষ, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, ঠাকুর মহিমচন্দ্র দেববর্মা, ড. সতীশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, অধ্যাপক চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকুমার রায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, নরেন্দ্র দেব, পরিমল গোস্বামী, পরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত প্রমুখ প্রতিভাধর ব্যক্তিদের লেখায় বিকশিত হয় ফটোগ্রাফি চর্চা। আর এসব গুরুত্বপূর্ণ লেখা সম্পাদক আহরণ করেন ১৮৮৫ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পর্যায়ের বাংলা সাময়িকপত্রসমূহ ঘেঁটে।

আলোকচিত্রপুরাণ গ্রন্থের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ‘সময়’। বাংলার নবজাগরণের সুবর্ণ সময়ে ফটোগ্রাফি কীভাবে শিল্প হয়ে ওঠে, সেসব কথা বর্ণিত হয়েছে এ গ্রন্থে। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কালে শুধু নিজ সাধনা নয়, সেই সঙ্গে আলোকচিত্রশিল্পের পূর্বসূরিদের কথা লিখতে গিয়েও চোখ ভিজে যায় সম্পাদকের।

সাহাদাত পারভেজ আলোকচিত্রপুরাণ গ্রন্থের আলোকচিত্রসমূহ সংগ্রহ ও সম্মিলনে পরিশ্রম করেছেন ধ্যানীর ভূমিকায়। সেই সব আলোকচিত্রের সঠিক পরিচয় চিহ্নিতকরণে কখনো কখনো দ্বিধান্বিতও হয়েছেন তিনি। সম্পাদক বলেছেন, আর্য্যকুমারের তোলা ছবির এক নারীর অবয়বে কোনো নাম ছিল না। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির নারী ভেবে নিজ কন্যাদ্বয় সহযোগে বিস্তর অনুসন্ধানের পর জানতে পারেন, সেটা আর্য্যকুমারের স্ত্রী কবি লীলা দেবীর ছবি। এই আবিষ্কার-উচ্ছ্বাস প্রকাশে সম্পাদক বলেন, ‘১১২ বছর আগে তোলা একটি ছবির ভেতরের মানুষের পরিচয় উদ্ধার করতে পারার মধ্যে যে স্বর্গীয় আনন্দ অনুভূত হয়, তা আপনাদের সঙ্গে বিনিময় করতে পেরে ভীষণ আনন্দ বোধ করছি।’ আবার আনন্দকিশোর ঘোষের মুখাবয়বের কোনো ছবিই সম্পাদক খুঁজে পাননি। শিল্পপুষ্পাঞ্জলি সংগ্রহে অপেক্ষা করেছেন চার বছর।

আলোকচিত্রপুরাণ গ্রন্থের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ‘সময়’। বাংলার নবজাগরণের সুবর্ণ সময়ে ফটোগ্রাফি কীভাবে শিল্প হয়ে ওঠে, সেসব কথা বর্ণিত হয়েছে এ গ্রন্থে। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কালে শুধু নিজ সাধনা নয়, সেই সঙ্গে আলোকচিত্রশিল্পের পূর্বসূরিদের কথা লিখতে গিয়েও চোখ ভিজে যায় সম্পাদকের। তিনি বিনয়ের সঙ্গে স্বীকার করেছেন, এই গ্রন্থ লেখার সময় বিভিন্ন নথি, পত্রিকার প্রতিলিপি, আলোকচিত্র, আখ্যাপত্র নির্দ্বিধায় ব্যবহার করেছেন।

‘আত্মাকে খনন করে হৃদয়ের সঙ্গে বোঝাপড়া’য় সাহাদাত পারভেজ উপস্থাপন করেছেন বাংলার ফটোগ্রাফিশিল্পের আঁতুড়ঘরস্বরূপ গ্রন্থ আলোকচিত্রপুরাণকে। এতে ইতিহাসের ধারাবাহিকতা অনুযায়ী প্রকাশ সালের ক্রম বিন্যস্ত রয়েছে। প্রবন্ধকারদের সময়ের ভাষা অবিকৃত রেখেছেন সম্পাদক। এ গ্রন্থের প্রথমে বিজ্ঞানকেন্দ্রিক ও শিল্পকেন্দ্রিক প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে। গ্রন্থজুড়ে ৭৮টি দুর্লভ আলোকচিত্র, একটি পেইন্টিং, দুটি পেনসিল স্কেচ, আটটি অ্যাখ্যাপত্রের প্রতিলিপি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এগুলো নিঃসন্দেহে পাঠকের চিন্তাচক্ষুর উন্মীলন ঘটাবে।

ফটোগ্রাফিচর্চার নেশা ও পেশা তো বটেই, সেই সঙ্গে ইতিহাসের আকর থেকে এ বিষয়ে জ্ঞান অর্জনে আলোকচিত্রপুরাণ পাঠের বিকল্প মেলা ভার! ছবি তোলা ও দেখা যাঁদের হৃদয়ে পুলক সঞ্চার করে, তাঁদের জন্য এ গ্রন্থ অবশ্যপাঠ্য। কীভাবে ফটোগ্রাফিচর্চার ধারা সুচারুরূপে সংযোজন করতে হয়, সে সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা লাভ করা সম্ভব এ গ্রন্থ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে।