যে বইয়ে আছে পূর্ববঙ্গের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস
‘আপাত আত্মত্যাগের এক বিশেষ দলিল।’ বইটির ভূমিকায় এমন লিখেছেন এম এম আকাশ। এটি একটি নির্মম বাক্য। নির্মম, কিন্তু সত্য। ভারতবর্ষের মানুষের মুক্তিসংগ্রামে কমিউনিস্টদের অবদান আর আত্মত্যাগের ইতিহাস প্রকৃত অর্থেই প্রবাদের মতো। কিন্তু সেই অনুপাতে তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক অর্জন কম। প্রয়াস ও অর্জনের মধ্যকার এ ফারাক বাংলা ভূখণ্ডের মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করেছে।
বর্তমান আমাদের অতীতের মধ্য দিয়েই সৃষ্টি হয়। তাই বর্তমানকে বুঝতে চাওয়া মানে অতীতকে বোঝা। একটি জনগোষ্ঠীর ইতিহাসের চড়াই-উতরাই থাকে। কোনো ভাবনা বা মতাদর্শ একসময় প্রভাব বিস্তার করে। পরে সেটাই হয়তো হয়ে যায় প্রান্তিক। এই বিবর্তনের মধ্যে লুকিয়ে থাকে সমাজের ইতিহাস। পূর্ববঙ্গের কমিউনিস্ট পার্টি: গোড়ার কথা (১৯৪৭-১৯৬৭) বইটি সেই ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে সামনে নিয়ে এসেছে।
১৯২০ সালে অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়। বিশ্বজুড়ে এ আন্দোলন মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ধারণ করেছিল। বিশ্বজুড়ে উপনিবেশব্যবস্থা শেষ হওয়া, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাদের অবস্থান ছিল এক নতুন সংযোজন। সারা উপমহাদেশে যখন হিন্দু, মুসলমান ইত্যাদি সম্প্রদায়ের সংঘাতকে একমাত্র সত্য বলে একে অপরকে মারা হয়, তখন কমিউনিস্টরা বলেন খেটে খাওয়া মানুষের মুক্তির কথা। এমন এক প্রস্তাব কেন বারবার মানুষের কাছে গিয়ে ফিরে এসেছে? সমাজ সেই নতুন সত্যকে বোঝার জন্য হয়তো প্রস্তুত ছিল না। হয়তো কমিউনিস্টরা সেই সত্যকে মানুষের সামনে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে কিছু ভুল পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে তাই এই প্রশ্ন আসে, একসময়ে এত প্রভাবশালী বাম আন্দোলন কেন এত ভাগে বিভক্ত হলো? সেই মতভেদের শিকড় ছিল কোথায়? এই বিভাজনের ইতিহাসের কিছু আদি বিবরণ এ বইয়ে পাওয়া যাবে। সেই সময়ে বিশ্বজুড়ে কমিউনিস্ট আন্দোলন দ্বিধাবিভক্ত হয়েছিল। এক দিকে চীন পন্থা, আরেক দিকে রুশ পন্থা। পূর্ব বাংলার কমিউনিস্টরা নিজ দেশের মানুষের চাওয়া-পাওয়াকে প্রাধান্য কম দিয়ে গুরুত্ব দিলেন তথাকথিত আন্তর্জাতিকতাকে—হয় রাশিয়া, নয় তো চীনের ইশারায় চললেন তাঁরা।
এসব প্রসঙ্গ মাথায় রেখে বইটির মূল প্রস্তাবনা শুরু হয় ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকে। দেশভাগের পর ধর্মের নামে তৈরি হলো জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র। সেই ট্র্যাজেডি সত্ত্বেও একদল বিপ্লবী কমিউনিস্ট মানুষের ভালোবাসায় মাটি কামড়ে রয়ে গেলেন পূর্ববঙ্গে। তাঁদের ‘ভারতের চর’, ‘পঞ্চম বাহিনী’ ইত্যাদি বলে জেলে পোরা হলো, হত্যা করা হলো। তাঁরা আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকতে বাধ্য হলেন। নিজেদের নাম পালটে ছদ্মবেশে মানুষকে সংগঠিত করলেন। এই বঙ্গে গড়ে তুললেন মানুষের সর্বাঙ্গীণ মুক্তি চাওয়া এক প্রজন্ম। এ প্রজন্ম কোনো না কোনোভাবে পূর্ববঙ্গের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে অনস্বীকার্য ভূমিকা রেখেছিল। তাদের জীবনের মর্মস্পর্শী কাহিনি কি শুধুই প্রত্যক্ষ সফলতা আর ব্যর্থতা দিয়ে মাপা যাবে?
বইটিতে রয়েছে স্মৃতিকথা ও সাক্ষাৎকার। পূর্ববঙ্গের সেই আত্মগোপন করে থাকা বিপ্লবীদের সন্তানদের ‘ডেন’জীবনের স্মৃতি। চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে সমাজ পরিবর্তনের ব্রতে যাঁরা যুক্ত ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে এখানে উঠে এসেছে সেই সময়ের একটি প্রাণবন্ত উপাখ্যান।
বইটি একই সঙ্গে এই বাংলার সেই সময়ের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাপঞ্জির বিবর্তনের দলিল। এর বড় অংশজুড়ে আছে বাংলা ভাগ, বিভাজনের পর পূর্ববঙ্গ আর ঢাকা, ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৬৭ পার হয়ে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাওয়া পূর্ব বাংলার আন্দোলনের ইতিহাস কমিউনিস্ট পার্টির দৃষ্টিতে। বলা দরকার, এই সময়জুড়ে আন্দোলনগুলোতে কমিউনিস্ট পার্টি ছিল সামনের সারিতে।
একসময় মানুষের জীবনের সংগ্রাম আর তাঁদের ভালো থাকা ছিল রাজনৈতিক আন্দোলনের মূল গতিমুখ। এখন এটা অনেক সংকীর্ণ। সেই আগের সময়কে বইয়ে সেই অর্থেই বলা হয়েছে ‘ভালো সময়’। এই ভালো সময় কোনো দল বা মতাদর্শের নয়, সমাজ আর মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে পরিণত করার সংগ্রামের। সেই অর্থে এখন খারাপ সময়। তাই ভালো আর খারাপের তুলনামূলক বিচার বর্তমানের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। অন্তত এই একটি প্রসঙ্গ বইটিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার জন্য যথেষ্ট।
পূর্ববঙ্গের কমিউনিস্ট পার্টি: গোড়ার কথা (১৯৪৭-১৯৬৭)
গৌতম রায়
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২৩, প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, ২১৫ পৃষ্ঠা, দাম: ৬৫০ টাকা।
পূর্ববঙ্গের কমিউনিস্ট পার্টি: গোড়ার কথা (১৯৪৭-১৯৬৭) বইটি পাওয়া যাচ্ছে