‘অভিযুক্ত’ উপন্যাসের আসল ঘটনাটা কী

ড.শাহজাহানের কাহিনি মোটাদাগে মানুষের দেহজ মনস্তত্ত্বের কাহিনি, যা দেবযানীর অভিযোগপত্রে স্থান পায়নি। কেউ অভিযুক্ত হলেই তাঁকে অপরাধী সাব্যস্ত করা যায় না। সে জন্য দরকার উপযুক্ত প্রমাণ।

ড. শাহজাহানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের প্রমাণ লোপাট করে দিয়ে ঔপন্যাসিক পাঠকের ওপরই ছেড়ে দিয়েছেন বাকি সব সিদ্ধান্ত। তবে তিনি কাহিনির জাল গুটিয়েছেন এক অভিনব উপায়ে। বিশ্বজিৎ চৌধুরীর উপন্যাস অভিযুক্ত প্রসঙ্গে বলা হলো ওপরের কথাগুলো।

এ উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ যে কয়টি চরিত্র, প্রত্যেকেই পরস্পরের সঙ্গে জোরালোভাবে জড়িত, তা বলার উপায় নেই। তবে সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় চরিত্র নিগার সুলতানা। নিগার সুলতানা চরিত্রের মধ্যেই বোনা হয়েছে ঘটনার বীজ।

অভিযুক্ত

বিশ্বজিৎ চৌধুরী

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২৪, প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, ১২৮ পৃষ্ঠা, দাম: ৩৪০ টাকা।

বইটি পাওয়া যাচ্ছে

prothoma.com এবং মানসম্মত বইয়ের দোকানে।

বিশ্বজিৎ চৌধুরীর গদ্য ব্যক্তিগতভাবে আমাকে চুম্বক-আকর্ষণে টানে। এ কথার সূত্র ধরে বলা যায়, চুম্বকের দুই মেরু হলেও অভিযুক্ত উপন্যাসটির মেরু ত্রিবিধ। স্বল্প বিস্তারের তিন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র প্রফেসর করিম, ড. হাস্নাহেনা আর হোসনে আরা ওরফে লাকী।

ঔপন্যাসিক এই তিনজনকে দিয়েই ড. শাহজাহানের সামনে একটি প্রশ্নের পেন্ডুলাম দুলিয়েছেন ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে—আসল ঘটনাটা কী?

ড. শাহজাহানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগটি কি আদৌ যৌন নিপীড়নের?

এই জায়গাতে আমরা চার নারী চরিত্রের চার রকম প্রতিক্রিয়া দেখতে পাই।

প্রথমে আসা যাক নিগার সুলতানার কথায়।

ড. শাহজাহানের সঙ্গে এই বিদেশিনীর আকস্মিক সম্পর্কচ্যুতির ঘটনাটির মূলে তাঁর গর্ভপাত, যা শাহজাহানের সিদ্ধান্তেই ঘটেছিল। আমরা দেখি, কাহিনির এই অংশে প্রকাশ চরিত্রের আবির্ভাব ঘটে।

সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ বিবেচনায় নিগার-প্রকাশ সম্পর্কটি একটি অসম সম্পর্ক। অথচ নিগার তাকেই বেছে নিল। নিগারের শক্ত ব্যক্তিত্ব এ বিবরণে প্রকটিত হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এরপর সময়ের অনুক্রমে তাসলিমা ওরফে লিমা প্রাসঙ্গিক। তার করুণ পরিণতির জন্য যতটা দায়ী তার বন্ধ্যত্ব, তার চেয়ে খানিক বেশি দায়ী বোধ করি একটা চাপা অভিমান। আর এ অভিমান উস্কে দিয়েছে কাহিনির ভিকটিম দেবযানী।

যে প্রকারের অক্ষমতা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসের মালার মধ্যে দেখা যায়, বৃহৎ দৃষ্টিকোণ থেকে তর্কসাপেক্ষভাবে আলোচ্য উপন্যাসের তাসলিমাও অনুরূপভাবে অক্ষম। দৃশ্যত মালা ছিল স্বামীসেবায় অক্ষম, আর তাসলিমা অক্ষম সন্তান উৎপাদনে। সে বিবেচনায় কুবের-কপিলার ঘনিষ্ঠতাকে মনে রেখেই গ্রথিত করা যায় শাহজাহান-দেবযানীর ঘনিষ্ঠতাকে। দেবযানী তাহলে কী কারণে আওয়াজ তুলল শেষমেশ?

দেবযানীর গর্ভের সন্তানকেও পৃথিবীর আলো-হাওয়া দেখতে দেননি ড. শাহজাহান।

অপরাধবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ‘পৌনঃপুনিক অপরাধ’ বলে একটা বিষয় আছে। সেই বিষয় ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে অভিযুক্ত উদাহরণ হিসেবে আসার মতো উপন্যাস। সেখানে ড. শাহজাহান এবং তার বাস্তব প্রতিরূপ শিক্ষকেরা আলোচনায় উঠে আসবেন এক চরম বিব্রতকর গবেষণার উপাদান হিসেবে।

প্রসঙ্গত ড. শাহজাহানের দেহজ কল্পনার প্রবণতা নিগার সুলতানাকে আশ্রয় করেই পরবর্তী সময়ে ছড়িয়ে পড়েছে তাসলিমা আর দেবযানীর শয্যাসঙ্গ অবধি। এখানে যৌক্তিকভাবেই একটা প্রশ্ন ওঠে, হোসনে আরা ওরফে লাকী কেন নির্ভারভাবেই দেখা করতে গেল ড. শাহজাহানের বাসায়? সে যদি সমকামী না হয়ে থাকত, তবে কি এই ঝুঁকি নিতে পারত?

সমকামী মানুষের পক্ষে পিতৃত্ব-মাতৃত্বের প্রশ্ন অবান্তর। সে ক্ষেত্রে লাকী কেন শাহজাহানকে নির্জনতার মুখে ফেলে চলে গেল?

শুধুই অপরাধ, অভিযোগ, অভিযোগকারী কিংবা অভিযুক্তের নিগূঢ়ে উপন্যাসটিকে বেঁধে ফেলা হলে বোধ হয় খানিকটা একঘেয়ে ও ক্লিশে বিশ্লেষণ হয়ে যায়। সময়োপযোগী এ উপন্যাসে আরও কিছু জরুরি বিষয় রয়েছে।

লেখক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাজনীতির কালো দিক তুলে এনেছেন অত্যন্ত সাবলীলভাবে। অনুরূপ প্রসঙ্গ বড় ক্যানভাসে উপন্যাসে তুলে এনেছেন প্রথিতযশা লেখক ও চিন্তক আহমদ ছফা (গাভী বিত্তান্ত)।

বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে সমকামিতার চর্চাসংক্রান্ত কিছু সাম্প্রতিক ঘটনাকেও এখানে প্রাসঙ্গিক করা হয়েছে।

যৌন নির্যাতন এবং সংশ্লিষ্ট আরও অপরাধের অভিযোগ তোলা নারীরা প্রাতিষ্ঠানিক এবং সামাজিকভাবে ঠিক কেমন প্রতিক্রিয়ার শিকার হন, তার দিকেও অঙ্গুলিনির্দেশ করতে ভোলেননি লেখক।

অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগপর্যন্ত আইনের চোখে একটা মানুষ ‘অপরাধী’ নন, বরং ‘অভিযুক্ত’। কিন্তু সমাজের চোখে বুঝি সে ‘অপরাধী’রও এক কাঠি ওপরে—পাপিষ্ঠ। এটা যে সমাজের একটা বিবেচনা, সে বিষয়ে ইঙ্গিত রয়েছে উপন্যাসে।

লেখার শুরুতে বলেছিলাম দেহজ মনস্তত্ত্বের কাহিনি হলো অভিযুক্ত নামের উপন্যাসটি। কেমন করে?

সেটা শাহজাহান চরিত্রের মধ্যে অবগাহন করলেই পাঠক উপলব্ধি করতে পারবেন।