মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের কথাভাষ্য

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

কিছু ক্রান্তিকালীন সময় থাকে, যখন ডাক আসে ইতিহাসকে নতুন করে মনে করিয়ে দেওয়ার, প্রয়োজন হয় এমন কিছু শক্তিশালী দলিল, যা সময়ের চাহিদাকে মেটায়। ‘সমরে সংস্কৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ’ তেমনই একটি দালিলিক গ্রন্থ। এটি আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসের অনুচ্চারিত অনালোচিত অধ্যায়গুলোর দিকে আলো ফেলে, যেখানে বন্দুকের শব্দের পাশাপাশি মিছিলে স্লোগান হয়ে উঠেছিল কবিতা। কবিতা হয়ে উঠেছিল গান আর সব মিলে শিল্পের প্রতিরোধও প্রায় সমানতালের শক্তি নিয়ে কাজ করেছে অস্ত্র হাতে যাঁরা মুক্তিসংগ্রাম করছেন, তাঁদের প্রেরণা হয়ে।

মুক্তিযুদ্ধের ৫৪ বছর পর যেখানে মুক্তিযুদ্ধকে প্রায়ই কেবল সামরিক বীরত্বের বয়ানে দলীয় পরিচয়ে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়, সেখানে এই বইটি আমাদের দৃষ্টি ফেরায় এই দিকে যে মুক্তিযুদ্ধ ছিল একই সঙ্গে একটি সাংস্কৃতিক এবং জনযুদ্ধ। ‘সমরে সংস্কৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ’ সংকলনটির বড় বৈশিষ্ট্য এই যে এই বই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসবোধকে একমাত্রিক হতে দেয় না। দশটি শিল্প শাখার ২০ জন মানুষের আলাপের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বহুমাত্রিকতা তুলে ধরে। এই সাক্ষাৎকারদাতাদের ১০ জন কথা বলেছেন মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে আর তাদের পরের প্রজন্মের ১০ জন আলাপ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রবহমানতা নিয়ে। আইডিয়া হিসেবে যা অভিনব ও প্রয়োজনীয়।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন সাক্ষাৎকারভিত্তিক এ গবেষণা আয়োজনে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংস্কৃতি কীভাবে প্রতিরোধের ভাষা হয়ে উঠেছিল, তা দেখিয়েছেন। গ্রামবাংলার গীত, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান, মঞ্চনাটক, দেয়াললিখন কিংবা প্রচারগানের ভেতর দিয়ে কীভাবে গেরিলাযুদ্ধের প্রেরণা তৈরি হয়েছিল—এই বই তার দলিল।

গ্রন্থটিতে ৫২ থেকে ৭১ পর্যন্ত সময়ের সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য মেলে যে লড়াই–ই মূলত মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। গান, কবিতা, চলচ্চিত্র, চিত্রকলা, নাটক, আবৃত্তি—সব শিল্পশাখা মিলেই বাঙালি বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল। অস্ত্রের চেয়ে তাই অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছিল বাঙালির মাথা না নোয়ানোর সংস্কৃতি।

গ্রন্থটিতে সংকলিত হয়েছে প্রয়াত বরেণ্য ভাস্কর ও বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, স্বেচ্ছায় অন্তরালে থাকা শামীম শিকদার, মুক্তিযোদ্ধা চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ, শিল্পী শেখ আফজাল, আবৃত্তিশিল্পী ও সাংস্কৃতিক সংগঠক সৈয়দ হাসান ইমাম, প্রয়াত সংস্কৃতিজন হাসান আরিফ, গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার, স্বাধীন বাংলা বেতারের কণ্ঠযোদ্ধা রফিকুল আলম, শাহরিয়ার কবির, লুৎফর রহমান রিটন, কণ্ঠযোদ্ধা বুলবুল মহলানবীশ, উদীচীর সংগঠক সৈয়দা সঙ্গীতা ইমাম, নৃত্যশিল্পী মিনু হক ও ওয়ার্দা রিহাবের সাক্ষাৎকার। সবাই মিলে একটি প্রজন্মগত সংলাপ তৈরি করেছেন। এ ছাড়া সাক্ষাৎকার আছে মুক্তিযুদ্ধ–গবেষক আফসান চৌধুরী, কবি জাফর ওয়াজেদ, চলচ্চিত্রকার নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু ও তানভীর মোকাম্মেল, প্রয়াত সাংবাদিক হারুন হাবীব এবং সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজার।

সংকলনটির বড় বৈশিষ্ট্য এই যে এই বই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসবোধকে একমাত্রিক হতে দেয় না। দশটি শিল্প শাখার ২০ জন মানুষের আলাপের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বহুমাত্রিকতা তুলে ধরে

সমরে সংস্কৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ
শিমুল সালাহ্উদ্দিন

প্রকাশক: আগামী প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২৫
প্রচ্ছদ: সেলিম হোসেন সাজু
পৃষ্ঠা: ২৭২
মূল্য: ৯৯৭ টাকা

সাক্ষাৎকারগুলোর ভেতরে প্রবেশের ক্ষেত্রে গ্রহীতার কবিসত্তার এক প্রকট চাঞ্চল্যের উপস্থিতি লক্ষণীয়। তবে এই প্রবণতা সাক্ষাৎকারগুলোকে দূষণ করেনি, আবার একে মিথস্ক্রিয়াও বলা যায় না। বরং কিছু ক্ষেত্রে নতুন প্রকরণ মনে হয়েছে, যা আলাপচারিতাকে কাব্যিক ধাঁচে নিয়ে আসার প্রয়াসী।

আত্মবয়ানের নিপুণতায় সংকলক অনন্য সাহিত্যিক নৈপুণ্যে ইতিহাস ও শিল্পের মাঝে এক প্রাণবন্ত সেতুবন্ধ গড়ে তুলেছেন। তথ্যগত ইতিহাস পরিণত হয়েছে অনুভবে এবং স্মৃতি ছুঁয়ে গেছে গভীর চেতনায়।

ইন্টারভিউয়ার তাঁর অবস্থানকে কখনো আড়ালে সরিয়ে দেন, কখনো আবার বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্নের মধ্য দিয়ে উত্তরদাতাকে চিন্তার গভীর স্রোতে টেনে নিয়ে যান। এই আবহে পাঠক নিজেই যেন পরিণত হন নিরীক্ষকের চোখে, অনুভব করেন প্রশ্ন ও উত্তরের মধ্যকার সূক্ষ্ম প্রতিধ্বনি। লেখক এই বইয়ের মাধ্যমে আমাদের সামনে এমন এক ইতিহাস উপস্থাপন করেছেন, যা কাগজে লেখা হয়নি বরং হৃদয়ে ধারণ করা হয়েছে—গানে, নাটকে, ভাস্কর্যে, কণ্ঠে ও ক্যানভাসে। বইটি পাঠককে মুক্তিযুদ্ধের এক বিকল্প বয়ানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে, যেখানে প্রতিটি শিল্প ও শিল্পী হয়ে ওঠে সময়ের নির্ভরযোগ্য ভাষ্যকার।