স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয়ের প্রত্যক্ষ বয়ান

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

শতাব্দীকাল ধরে বাংলার মুক্তিসংগ্রামের প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছে। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ থেকে শুরু করে গত শতকে পাকিস্তান আন্দোলন, অতঃপর ১৯৭১ সালে এ মাতৃকায় চূড়ান্ত বিজয়ের নিশান ওড়ে। পাকিস্তান আন্দোলনে এদেশবাসী একাত্ম হয়েছিল দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শোষণের হাত থেকে মুক্তির অন্বেষায়। ১৯৪৭ সালে সেই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হলেও অল্প সময়ের মধ্যেই দেশবাসী অনুধাবন করে ব্রিটিশ উপনিবেশের পরিবর্তে এবার তারা পশ্চিম পাকিস্তানের নতুন উপনিবেশে পরিণত হয়েছে। যার ফলে সদ্য স্বাধীন এ ভূখণ্ডে ক্রমে পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন নানা রূপে দানা বাঁধতে শুরু করে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া সেই আন্দোলন ষাটের দশকে গণ–আন্দোলনে রূপ নেয়। গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের রাজনীতির দুর্বোধ্য পাঠ কামরুদ্দীন আহমদ তাঁর ইতিহাস গ্রন্থ ‘স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অতঃপর’–এর মধ্য দিয়ে সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন। লেখকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও তাঁর কাজের পরিধি এ গ্রন্থের বয়ানকে সত্য ও গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।

কামরুদ্দীন আহমদ গত শতকের চল্লিশের দশকে, প্রাক্–স্বাধীনতা পর্বে সক্রিয়ভাবে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার সাক্ষ্য দিয়েছেন আলোচ্য গ্রন্থটিতে।

কামরুদ্দীন আহমদ এ দেশের সর্বজনস্বীকৃত ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাসপ্রণেতাদের একজন। তিনি একাধারে সাহিত্যিক, রাজনীতিক, আইনজ্ঞ, শ্রমিকনেতা ও কূটনীতিক হওয়ার কারণে তাঁর ইতিহাস বর্ণনা আর সব ঐতিহাসিকের মতো নয়। ক্ষেত্রবিশেষে এ বয়ান বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার। গত শতকের চল্লিশের দশকে, প্রাক্–স্বাধীনতা পর্বে, তিনি সক্রিয়ভাবে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার সাক্ষ্য দিয়েছেন আলোচ্য গ্রন্থটিতে।

স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অতঃপর
কামরুদ্দীন আহমদ

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ২০২৪
প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরীর চিত্রকর্ম অবলম্বনে মাসুক হেলাল
পৃষ্ঠা: ২৫৬; মূল্য: ৫৭৫ টাকা

বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে ক্লিক করুন

১৯৫৮ সালে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে এ দেশের রাজনীতিতে এক করুণ অধ্যায়ের সূচনা হয়। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের আমলে এ দেশে প্রভূত উন্নতি, বিশেষ করে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধিত হলেও গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়ে। কামরুদ্দীন আহমদ এই বইয়ে আইয়ুব খানের পুরো শাসনকাল বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর সুনিপুণ লেখনীর মধ্য দিয়ে। স্বাধীনতা–পরবর্তী বাংলাদেশের ঘটনাবলি তিনি পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে। বঙ্গবন্ধুর বিতর্কিত বাকশাল গঠনের বিষয়টিও উঠে এসেছে তাঁর বর্ণনে।

গত শতকের শুরু থেকে বাংলার অভ্যুদয়ের যে পটভূমি রচিত হয়েছে, তার পরিচিতি পর্ব দিয়ে গ্রন্থটির সূচনা। এরপর ক্রমে বাংলার রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের রূপরেখা মূর্ত হয়ে ওঠে। পাকিস্তান আমলে রাজনৈতিক অস্থিরতাকে তিনি তুলে ধরেছেন অত্যন্ত দৃঢ়চিত্তে। ব্যক্তিজীবনে পররাষ্ট্র দপ্তরে কাজ করার সুবাদে তিনি ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান–ভারত যুদ্ধ ও তৎকালীন পূর্ববঙ্গে সেই যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া নিবিড়ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর লেখায়। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট রচিত হওয়ার সন্ধিক্ষণকে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনকে তুলে এনেছেন একজন দক্ষ পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিকোণ থেকে।

কামরুদ্দীন আহমদ এই বইয়ে আইয়ুব খানের পুরো শাসনকাল বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর সুনিপুণ লেখনীর মধ্য দিয়ে। স্বাধীনতা–পরবর্তী বাংলাদেশের ঘটনাবলি ও বঙ্গবন্ধুর বিতর্কিত বাকশাল গঠনের বিষয়টিও উঠে এসেছে তাঁর বর্ণনে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের চূড়ান্ত বিজয়কাল এবং স্বাধীন বাংলাদেশে শেখ মুজিবের প্রত্যাবর্তন তিনি তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় তুলে ধরেছেন। সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিল, সেই ষড়যন্ত্রের বর্ণনা বইটির একটি অনন্য বিশেষত্ব। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের রাজনীতিতে আবির্ভাব পর্বের মধ্য দিয়ে ‘স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অতঃপর’ গ্রন্থটির যবনিকা টানা হয়।

মুখবন্ধে লেখক দাবি করেছেন তিনি পেশাগত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নন, দীর্ঘদিন রাজনীতি ও কিছুদিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে কিছুটা বাতিকগ্রস্ত হয়েই এ ধরনের বিশ্লেষণে হাত দিয়েছেন। তবে গ্রন্থটি পাঠ শেষে লেখকের এ দাবিকে নিছক বিনয় বলেই মনে হয়। তাঁর ক্ষুরধার বিশ্লেষণ আর বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণে বইটি বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অনবদ্য দলিলে পরিণত হয়েছে।