শব্দগল্পের সিলসিলা

কবি-গবেষক-অধ্যাপক সুমন সাজ্জাদ প্রণীত শব্দরম্য কোনো ব্যাকরণের বই নয়, কেবল রম্য-রসিকতার বইও নয়। তবে রম্যের ছলে তিনি বাংলা ভাষার প্রচলিত অনেক শব্দের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তাৎপর্য উদ্​ঘাটন করেছেন, ব্যাখ্যাও করেছেন। এ ছাড়া বাংলাভাষী মানুষের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ হয়, এমন কিছু শব্দের ব্যবচ্ছেদ তিনি করেছেন ব্যাকরণের জটিল কলাকৌশলের পথে না গিয়ে। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এই ধরনের বেশ কিছু বই বাজারে রমরমা হলেও শব্দরম্য নানা কারণে বিশিষ্ট। একটি শব্দ বাক্যে ব্যবহারের ধরন, প্রকাশভঙ্গি, প্রয়োগের অবস্থান প্রভৃতি কারণে ক্ষণে ক্ষণে তার অর্থ ও রূপ বদলে নতুনতর কোনো তাৎপর্যে ব্যাপৃত হয়; শব্দের এই স্বাভাবিকতা যৌক্তিকভাবে অনুধাবন করতে বইটি বাংলা ভাষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।  

ইসমাইল সাদী

শব্দরম্য 

সুমন সাজ্জাদ

প্রকাশক: কথাপ্রকাশ, ঢাকা; প্রকাশকাল: জুলাই ২০২৩; প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা; ১৪৮ পৃষ্ঠা; দাম: ২৫০ টাকা।

বইগুলো পাওয়া যাচ্ছে: prothoma.com এবং মানসম্মত বইয়ের দোকানে

সুমন সাজ্জাদ মূলত শব্দ নিয়ে গল্প করেছেন; সময়ে সময়ে করেছেন রসিকতা। ব্যাকরণের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন সহজ-সাবলীলভাবে। প্রাঞ্জল ও হালকা চালের কথনরম্যে পাঠককে তিনি অনায়াসেই শব্দব্যঞ্জনার সঞ্জীবনী সুধার গভীরে নিয়ে গিয়ে সন্তরণ-সুখ পাইয়ে দেন। অবশ্য এর জন্য পাঠককে কিছুটা ‘ভাষাশিক্ষিত’ হতে হবে। অবশ্য তা না হলেও তেমন ক্ষতি নেই। কারণ, পাঠক একবার গ্রন্থভুক্ত শব্দগল্পগুলোর সঙ্গে একাত্ম হতে পারলে রসাস্বাদন থেকে বঞ্চিত হবেন না। যে ২৭টি শব্দগল্প নিয়ে রম্য করা হয়েছে, তার প্রতিটির ভাষিক ব্যবহার নিশ্চিত করে সেগুলো সম্পর্কে প্রচলিত-অপ্রচলিত গল্প যেমন তিনি ফেঁদেছেন, তেমনি গল্পগুলোতে জীবন ও সমাজ থেকে আহরিত বিচিত্র অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন স্যাটায়ার, উইট, শ্লেষ, রসিকতা, চপেটাঘাত প্রভৃতি বক্তব্য-কৌশলের মধ্য দিয়ে। তাতেও লেখক ক্ষান্ত হননি, অভিন্ন অর্থের আগ্রহোদ্দীপক শব্দগুলো অন্য ভাষায় কোন অবয়ব ও উচ্চারণে বিরাজমান, তা–ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিবেচনায় এনে পাঠককে তিনি পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।

শব্দ নিয়ে লেখকের রম্য করার উদ্দেশ্য পাঠককে শিক্ষিত করা নয়, বরং পাঠকের মনে পাঠের আনন্দানুভূতি জাগ্রত করাও। সুমনের বলার ধরন এতটাই স্পষ্ট ও অকপট যে তিনি ‘শুরু’তে বলেই ফেলেন, ‘আসলে শব্দই শক্তি, শব্দই সত্য, শব্দই ব্রহ্মাণ্ড, শব্দ দিয়েই জগতের ব্যাখ্যা, শব্দ দিয়েই জগতের নির্মাণ। শব্দের এই বিপুল বিশাল জগতে হাঁটতে হাঁটতে শব্দ নিয়ে কৌতূহল জেগেছে, প্রশ্ন তৈরি হয়েছে শব্দের উৎস নিয়ে; নানা পথ ধরে সেগুলোর মীমাংসা করতে চেয়েছি।’ এই মীমাংসা-প্রচেষ্টার হাত ধরেই তিনি গল্প করতে চেয়েছেন ‘চুল তার কবেকার’ শিরোনামে। আপাতভাবে খুব নিরীহ একটা শব্দগল্প হলেও আদতে ‘চুল’ মধ্যযুগ থেকে এ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় কতভাবে কত কবিতা-গানে ব্যবহৃত হয়েছে, তার বিশদ তো জানা যাবেই; পাশাপাশি সংস্কৃত, হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি, আরবি, ফারসি, জার্মান, ডাচ, লাতিন প্রভৃতি ভাষায় চুলের অর্থ ও তার রূপান্তর সম্পর্কে দৃষ্টান্তসহ সরসিক চিত্তে ওয়াকিবহাল হওয়া যাবে। গ্রন্থভুক্ত ‘রবি না হয় বুঝলাম, কিন্তু ঠাকুর?’, ‘প্রেম-পিরিতের পাঁচালি’, ‘কাম ও কামসূত্র’, ‘আমি তুমি সে’, ‘জিলাপির প্যাঁচ’, ‘মদন-সমাচার’, ‘শব্দের শব’ প্রভৃতি শব্দবন্ধ নিয়ে রচিত গল্পগুলোর বয়ান-দক্ষতার কারণে সুমন সাজ্জাদের মেধা-মনন-অনুশীলন এবং জ্ঞানের গভীরতার পরিচয় পাওয়া যায়। বইটি প্রণয়নে তিনি বেশ কিছু গ্রন্থের সহযোগিতা নিয়েছেন; সেসবের নাম উল্লেখও করেছেন। তবু গ্রন্থপাঠ শেষে সহায়ক গ্রন্থের একটি তালিকার জন্য মনটা উসখুস করে ওঠে।