নারীর গোপন জীবনের আখ্যান

অনেক সময় আমরা চারপাশের এমন সব ঘটনার মুখোমুখি হই, যা আমাদের মনে বিস্ময়কর চিহ্ন রেখে যায়। আমরা অবাক হই। অবিশ্বাস্য লাগে। অথচ এসবের মাঝেই বেঁচে থাকতে হয় আমাদের। আন্দালিব রাশদীর সিক্রেটস উপন্যাসটি পড়তে পড়তে এই সত্যটি বারবার সামনে চলে আসে।

ছয়টি আলাদা গল্প নিয়ে এই উপন্যাস। কিন্তু প্রতিটি গল্পই পরস্পরের সঙ্গে গেঁথে আছে। এই গাঁথুনির মূলে রয়েছে গল্পের কথক— ময়না। উপন্যাস শুরু হয়েছে স্মৃতিকথার ঢংয়ে, ময়নার বয়ানে, টাইটানিকের কাহিনীর মধ্য দিয়ে।

এতিমখানায় বেড়ে ওঠা ময়না জীবনের চড়াই উৎরাই পেড়িয়ে কর্মজীবন শুরু করে কাজের বুয়া হিসেবে। সেখান থেকে নিজের চেষ্টায় একটি বৃদ্ধাশ্রমের কেয়ারটেকার হয় সে। শেহেরজাদ’স লজ বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা পাঁচ নারীর একান্ত নিজস্ব গোপন গল্পগুলোই অধিকার করে আছে পুরো উপন্যাস। একদিকে পুরো বইতে খুঁজে পাই ভাগ্যবিড়ম্বিত ময়নার কাহিনী। অপরদিকে জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে পাঁচ নারী আমাদের নিয়ে যায় তাঁদের স্মৃতির পথরেখায়। সেই পথের বাঁকে বাঁকে উন্মোচিত হতে থাকে তাঁদের নিজ নিজ সময়, চারপাশের বাস্তবতা, অন্ধকার জগত, আর নিজেদের একান্ত কিছু না বলা, গোপন ঘটনা।

এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য যৌনতাকে ঘিরে আমাদের সামাজিক ট্যাবু এবং স্বীকারোক্তি । কখনো সেটা ২৬ বছর ধরে দৈহিক সম্পর্ক বঞ্চিত এক শিক্ষকের মধ্য দিয়ে, কখনো মার্গারিটার এসকর্ট জীবনের কাহিনীতে, কখনো স্ত্রী থাকা সত্বেও শায়েস্তা খানমকে বিয়ে করতে চাওয়া রাজনৈতিক নেতার কর্মকাণ্ডে, আবার কখনো বাদশাহ খানের বিবাহবহির্ভূত দৈহিক সম্পর্ককে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। সহজ স্বাভাবিক ব্যাপারগুলো মানুষের লালসা আর সমাজের অসঙ্গতির কারণে কতটা কদর্য রূপ নিতে পারে, সেই উপলব্ধির মুখোমুখি হয় পাঠক উপন্যাসের প্রতিটি গল্প। দেখতে পায় কিভাবে সম্পদের লোভ মানুষকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। নিজের মেয়ে গুলবাহারকে বিক্রী করে সংসার চালানো হোক, আর সম্পদ কিংবা নিরাপত্তার লোভে নিজের মেয়েকে অবৈধ সন্তান দাবি করে ব্ল্যাকমেইল করা হোক, লোভের এইসব চিত্রগুলো ভীষণভাবেই ফুটে উঠেছে বইজুড়ে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মেয়েদের কোন দৃষ্টিতে দেখে, কিভাবে তাদের পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে, অসুস্থ রাজনৈতিক বলয়ে ধনিক শ্রেণি কিভাবে অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করে, কেবল দৈহিক গঠনের জন্য কিভাবে মানুষকে নিগ্রহের শিকার হতে হয়— সবকিছুই খুঁজে পাওয়া যায় টুকরো টুকরো গল্পগুলোতে। প্রতিটি গল্প যেন এক কলুষিত অন্ধকার সমাজের চিত্র তুলে ধরে।

পাঁচজন নারীর গল্পগুলো স্থান, কাল ও বিষয়ের দিক থেকে একেবারেই আলাদা হলেও আমাদের সমাজে নারীর সামগ্রিক যে বাস্তবতা, সেই বাস্তবতায় দাঁড়ালে তাদের মাঝে মিল খুঁজে পাওয়া যায় নানাভাবে। বইয়ের গল্পগুলোতে উঠে আসা নানা ঘটনা ও চরিত্র চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমাদের চারপাশের অসঙ্গতিগুলো। একটা মেয়ে যত মেধাবীই হোক না কেন, বিয়ে না হলে যে তাকে সবাই বোঝা মনে করে, এই বাস্তবতা আমরা খুঁজে পাই যখন ফয়জুন্নেসা খানম তার ক্লাসের সহপাঠীদের সাথে কথা বলেন। আবার একই কাহিনীতে দেখি কিভাবে একেবারে ত্যাজ্য হয়ে যাওয়া একজন মানুষও কেবল পড়ালেখা করে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

আন্দালিব রাশদীর ঝরঝরে গদ্য আর অভিনব গল্প বলার ধরন এই উপন্যাসের শক্তির জায়গা। এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা যায়। প্রাসঙ্গিকভাবে উপন্যাসে উঠে আসা  সাহিত্য, সিনেমা ও ইতিহাসের চমৎকার রেফারেন্সগুলো বইটিকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। টাইটানিক থেকে শেক্সপিয়ার, ভার্জিনিয়া উলফ থেকে শুরু করে মহাকাশ—সবই জায়গা করে নিয়েছে তাঁর গল্পের ঝুড়িতে।

তবে  কখনো কখনো এই উপন্যাসে উঠে আসা জীবনের টানাপোড়েন দেখে পাঠক অপ্রস্তুত ও ব্যথিত হয়ে পড়বেন, আবার কখনো মানুষকে নতুনভাবে দেখতে শিখবেন। বিশেষ করে নারীর চোখ দিয়ে সমাজকে দেখতে চাইলে, সিক্রেটস আপনাকে না চাইতেই অনেক কিছু শিখিয়ে দেবে। বইটির শুরুতে বলা টাইটানিকের সেই বিখ্যাত ডায়লগ দিয়েই বইটি শেষ হয়েছে—

“A woman’s heart is a deep ocean of secrets.”

না বলা হাজারো কথা আর কোটি কোটি অজানার ভিড়ে, সিক্রেটস যেন সেই বিশাল মহাসমুদ্রের এক বিন্দু শিশিরের স্পর্শ মাত্র। আর সেটুকুই হয়তো পাঠকের প্রকৃত প্রাপ্তি।

আন্দালিব রাশদী

প্রকাশক : প্রথমা প্রকাশন

প্রচ্ছদ : নির্ঝর নৈঃশব্দ; মূল্য : ২৫০ টাকা

পৃষ্ঠা : ৮০; প্রকাশ : জানুয়ারি ২০২৫