একটা সিনেমার দল খাঁচায় বন্দী এক ট্রাক কাক নিয়ে শুটিং করতে আসে আখাউড়ায়। অক্টোবরের হিমেল হাওয়া বয়ে নিয়ে আসা শীতেও টানা ঝুমবৃষ্টিতে শুটিং থেমে থাকে। সিনেমার ডিরেক্টর সুমন, অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর তরুণ, ক্যামেরাম্যান শিপন আর তাদের সঙ্গে আছে রহস্যময় এক ব্যক্তি সুলতান শেখ, যে কিনা পশুপাখির কথা বোঝে।

সুলতান শেখ জানায়, আখাউড়ায় আছে স্বর্গ থেকে আসা এক সুখপাখি, যাকে একবার দেখলে জীবনে আর কোনো দুঃখ থাকে না। আখাউড়ায় এসে সিনেমার দলের পরিচয় হয় বাবলু নামের এক কিশোরের সঙ্গে, তার বুকভর্তি স্বপ্ন, সে-ও সিনেমার দলের সঙ্গে কাজ করতে চায়, যেকোনো একটা কাজের অছিলায় হলেও সে পালাতে চায় বাড়ি ছেড়ে, আখাউড়া ছেড়ে।

তবে শুধু কি বাবলু? সুমন, তরুণ কিংবা সুলতান শেখ—উপন্যাসের সব চরিত্রই কি আদতে কোথাও পালাতে চায়?

বৃষ্টিতে শুটিং থেমে থাকায় ফ্ল্যাশব্যাকে চলতে থাকে নানা ঘটনা। আখাউড়ার এক নির্জন পদ্মবিলের ধারে অক্টোবরের এই অদ্ভুত বৃষ্টি সবাইকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় তাদের অতীতে। কিশোর বাবলুর মতো ঘর ছেড়ে পালাতে না চাইলেও সুমনও প্রায়ই পালায়। পালিয়ে অদ্ভুত এক দ্বীপে চলে যায় সে, যেখানে দিপা বসে থাকে তার জন্য।

আর তরুণ! মাত্র ১১ বছর বয়সে নিজের শৈশব আর কৈশোরকে বাস্তবতার কাছে বন্ধক দিয়ে সেই থেকে পালিয়েই তো বেড়াচ্ছে সে! কিন্তু বাস্তবতা এই যুবকের সঙ্গে প্রতারণা করে, আখাউড়ার নির্জন গ্রামে শুটিংয়ে এসে তরুণকে দাঁড়াতে হয় অতীতের এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। এখন কী করবে তরুণ? আবারও পালাবে?

স্বপ্ন, প্রেম, একাকিত্ব, হতাশা, ব্যর্থতা, রহস্য—সবকিছু নিয়ে কতকগুলো মানুষের জীবনযাপনের এক দারুণ আখ্যান আলভী আহমেদের উপন্যাস লোনলি অক্টোবর। উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রই আমাদের চেনা। অথবা এমনও হতে পারে, পড়তে পড়তে পাঠকেরা নিজেরাই একসময় উপন্যাসটির চরিত্র হয়ে উঠছেন! গোটা উপাখ্যানে পাঠককে এমন অনুভূতি দিতে পেরেছেন লেখক। এখানেই তাঁর সফলতা।

লোনলি অক্টোবর-এর পরতে পরতে আছে মেটাফর। মেটাফর ব্যবহারে উপন্যাসটির লেখক আলভী বেশ সিদ্ধহস্ত। সেই হিসেবে লোনলি অক্টোবরকে নতুন ধরনের উপন্যাসই বলা চলে। সুলতান শেখের সুখপাখি বা সিনেমার শেষ দৃশ্য পুরোটাই যেন আস্ত এক মেটাফর! সত্যিকারের সুখপাখি কি কেউ কখনো দেখতে পায়? স্বর্গের সেই সুখপাখি খুঁজতে গেলেই যেমন পালিয়ে যায়, তেমনই আমাদের জীবন—সুমন কিংবা তরুণেরও—ভয়ংকর নিঃসঙ্গতায় কিংবা মৃত্যুর খুব কাছে বসে কয়েক পেগ জিন বা হুইস্কি সাঁটিয়ে স্বপ্নে দিপাকে খুঁজতে গেলে দিপারাও পালিয়ে যায়। হয়তো আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই এমন একটা সুখপাখি থাকে, যাকে প্রতিনিয়ত খুঁজে ফিরি আমরা।

অতীত মানবজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পরম প্রিয় সঙ্গী। তাকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের জীবন, অতীত নামের মৃত লাশকে পেছনে ফেলে পালাতে চাইলে কাক-শকুনে ছিঁড়েখুঁড়ে খাবে ‘অতীত’ নামক সেই দেহকে। উপন্যাসে বিধৃত সিনেমার শেষ দৃশ্য কি তাই বোঝাতে চায়? এটা অবশ্যই পাঠকের বিবেচনা। লেখক এতে পাঠকের সামনে বাস্তবতা আর বিভ্রমের এক বিস্ময়কর জগৎ সৃষ্টি করে দিয়েছেন।

বইয়ের ভাষা ভীষণ সাবলীল, এক নিশ্বাসে পাঠককে নিয়ে যাবে বইয়ের শুরু থেকে শেষ পৃষ্ঠায়। এখানে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার থাকলেও তা দুর্বোধ্য নয়, বাবলু নামের কিশোরটির মনস্তত্ত্ব বোঝাতে এ ভাষার ব্যবহারের কোনো বিকল্প ছিল না। সব মিলিয়ে লোনলি অক্টোবর স্বপ্ন ও বাস্তবতার এক ঘোরলাগা আখ্যান।