যে বইয়ে লেখা আছে বাংলাদেশের উন্নয়ন–ইতিহাস

‘সফিকুল হক চৌধুরী স্মারকগ্রন্থ’–এর প্রচ্ছদ

বাংলাদেশের এনজিও সেক্টরে মো. সফিকুল হক চৌধুরী একটি স্মরণীয় নাম। স্বাধীনতার উত্তরকালে যে কজন মানুষ এনজিও প্রতিষ্ঠা করে দারিদ্র্য নিরসন ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কল্যাণে কাজ করতে এগিয়ে এসেছিলেন, তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম। সফিকুল হক চৌধুরী ১৯৭৮ সালে ক্ষুদ্র পরিসরে মানিকগঞ্জের এক নিভৃত গ্রামে ‘আশা’ প্রতিষ্ঠা করেন। বিগত কয়েক দশকে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, দুর্যোগে সহায়তা, ক্ষুদ্রঋণ, নারীর ক্ষমতায়নসহ জনসচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে লাখ লাখ মানুষকে সেবা দিয়ে আশা দেশে ও বিদেশে বিপুল খ্যাতির অধিকারী হয়।

২০২১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি আশার প্রতিষ্ঠাতা সফিকুল হক চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর জীবন ও কর্মের ওপর একটি স্মারকগ্রন্থ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থটিতে দেশ-বিদেশের বরেণ্য ও খ্যাতিমান ব্যক্তিরা সফিকুল হক চৌধুরী সম্পর্কে তাঁদের নির্মোহ মত ব্যক্ত করেছেন। স্মারকগ্রন্থটি প্রকাশ করেছে স্বনামধন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান প্রথমা প্রকাশন।

গ্রন্থটিতে লিখেছেন: গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ও ড. আতিউর রহমান, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব এম আবদুল আজিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. ডালেম চন্দ্র বর্মণ, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির ইভিসি মো. ফসিউল্লাহ, পিকেএসএফের ডিএমডি ফজলুল কাদের, ব্র্যাকের সাবেক কর্মকর্তা শিব নারায়ণ কৈরী, সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরী, অজয় দাশগুপ্ত ও বিভূরঞ্জন সরকার, সিডিএফের নির্বাহী পরিচালক মো. আব্দুল আউয়াল প্রমুখ। এ ছাড়া ব্রিটিশ উন্নয়নবিশেষজ্ঞ মি. স্টুয়ার্ট রাদারফোর্ড, ডাচ উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারী মি. ডার্ক ব্রাউয়ার, ফিলিপাইনের কার্ড ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. জেমি এরিস্টটল বি আলিপের লেখা বইটিতে স্থান পেয়েছে।

সফিকুল হক চৌধুরী স্মারকগ্রন্থ
সম্পাদক:
মো. এনামুল হক, মোহাম্মদ আজীম হোসেন ও হাবিবুর রহমান
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, ২৮৬ পৃষ্ঠা, দাম: ৭০০ টাকা।

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর লেখায় বলেছেন, ‘বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আশার প্রতিষ্ঠাতা মো. সফিকুল হক চৌধুরী আকস্মিকভাবেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। ক্ষুদ্রঋণের জগতে তিনি আকস্মিকভাবেই প্রবেশ করেছিলেন। এ ব্যাপারে তাঁর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি ছিল না। কিন্তু এসবকে তিনি কোনো বাধা হিসেবে গ্রহণ করেননি। যে কাজের জন্য তিনি মনস্থির করেছিলেন, সে কাজে তিনি দৃঢ়ভাবে এগিয়ে গেছেন। সীমাহীন সাহসই ছিল তাঁর মূল শক্তি। দেরিতে যোগ দিলেও আশাকে তিনি দেশের সবচেয়ে অগ্রগামী দুটি প্রতিষ্ঠানের কাতারে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন।’

সালেহউদ্দিন আহমেদ তাঁর নিবন্ধে লিখেছেন, ‘সফিক চৌধুরী দেশে-বিদেশে আশার কার্যক্রমের মাধ্যমে একটি দক্ষ ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মী বাহিনী গড়ে তুলেছেন। সময়ের সঙ্গে নতুন নতুন চিন্তা এবং এর প্রতিফলন তিনি করেছেন বিভিন্ন কাজে।’

আতিউর রহমান লিখেছেন, ‘সফিকুল হক চৌধুরী বাংলাদেশের গ্রামীণ উন্নয়নে সহজ সমাধানের সামাজিক উদ্যোক্তা হিসেবে দীর্ঘদিন মানুষের মনে বেঁচে থাকবেন। তাঁর প্রচেষ্টায় আশা একটি সহজ ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।’

জাফরুল্লাহ চৌধুরী লিখেছেন, ‘সফিকুল হক চৌধুরী বিদেশনির্ভরতা পছন্দ করতেন না। এ দর্শন থেকেই তিনি সুব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আশাকে স্ব-অর্থায়িত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন।’

বাংলাদেশের এনজিও খাত নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছে। বিশেষত, ক্ষুদ্রঋণ সেক্টর দেশের প্রায় তিন কোটি মানুষকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে আনতে সক্ষম হয়েছে। ফলে ব্যাংকিং সেবার বাইরে থাকা বিশাল জনগোষ্ঠী ঋণসেবা গ্রহণের সুযোগ যেমন পাচ্ছে, তেমনিভাবে তা কাজে লাগিয়ে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি ও গরিবি হটানোর পথ খুঁজে পেয়েছে, যা দেশের সার্বিক উন্নয়ন অভিযাত্রাকে ত্বরান্বিত করছে।

এম আবদুল আজিজ লিখেছেন, ‘কর্মজীবনের শুরুতে দারিদ্র্যমুক্ত ও উন্নত সমাজ গঠনের যে স্বপ্ন তিনি দেখতেন, তা বাস্তবায়নের উপযুক্ত সংস্থা হিসেবে আজীবন সাধনায় তিলে তিলে আশাকে গড়ে তুলেছেন।’

আব্দুল আউয়াল তাঁর লেখা প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সফিকুল হক চৌধুরী অতিপরিচিত নাম ছিলেন। তাঁর সহায়তা ও দূতিয়ালিতে আমি অস্ট্রেলিয়ার ব্রিজবেনভিত্তিক নেটওয়ার্ক “The Banking with the Poor (BWTA)”-এর প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলাম।’

ক্ষুদ্রঋণ ও বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিয়ে ভিনদেশের মানুষও উঁচু ধারণা পোষণ করতেন। তাঁদের একজন খ্যাতিমান ব্রিটিশ ক্ষুদ্র অর্থায়ন-বিশেষজ্ঞ মি. স্টুয়ার্ট রাদারফোর্ড। তিনি লিখেছেন, ‘The qualities of Shafiq that impressed me most were his honesty and his openness. Md. Shafiqual Haque Choudhury who was included in many outstanding figures in his generation, and he was the best.’

বাংলাদেশের এনজিও খাত নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছে। বিশেষত, ক্ষুদ্রঋণ সেক্টর দেশের প্রায় তিন কোটি মানুষকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে আনতে সক্ষম হয়েছে। ফলে ব্যাংকিং সেবার বাইরে থাকা বিশাল জনগোষ্ঠী ঋণসেবা গ্রহণের সুযোগ যেমন পাচ্ছে, তেমনিভাবে তা কাজে লাগিয়ে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি ও গরিবি হটানোর পথ খুঁজে পেয়েছে, যা দেশের সার্বিক উন্নয়ন অভিযাত্রাকে ত্বরান্বিত করছে।

লেখকেরা গ্রন্থটির মাধ্যমে বাংলাদেশে এনজিও খাতের অনেক অজানা বিষয় তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। দেশের এনজিও খাতের বিগত কয়েক দশকের ইতিহাস গ্রন্থটিতে জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে।