যে বই পড়লে জানা যাবে মা কেন আর গান করেননি

প্রথমা প্রকাশন থেকে এই বইমেলায় প্রকাশিত আনিসুল হকের উপন্যাস ‘কখনো আমার মাকে’ এরই মধ্যে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। পাঠক কেন পছন্দ করলেন এই আখ্যান? কোন মায়ের কথা বলা হয়েছে এখানে? সাহিত্যিক আখতার হুসেনের কলমে আছে তার জবাব।

আনিসুল হক এবং তাঁর উপন্যাস ‘কখনো আমার মাকে’-এর ছবি অবলম্বনে কোলাজ

আমি যখন আনিসুল হকের সদ্য প্রকাশিত উপন্যাস ‘কখনো আমার মাকে’ পড়তে শুরু করি, এর প্রথম অধ্যায়ই আমাকে জানান দেয়, অসম্ভব মর্মছেঁড়া একটা কিছু আছে এই কাহিনির পরিণতিতে। আছে আমাদের যাপিত জীবনের স্মৃতি-সম্পদ, যা আমরা বুকের গভীরে নিত্য বয়ে চলি আর প্রতিনিয়ত হারিয়ে ফেলে খুব নিভৃতে আফসোস করি। বলি, আহারে, আহারে...।

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি উপশহর বা উপজেলা থেকে এ উপন্যাসের কাহিনির শুরু। শুরু হয় উত্তম পুরুষে এক কিশোরের বয়ানে। সেই কিশোরের নাম ‘মাবলু’।

মাবলুর বয়স বাড়তে থাকলেও তার কাছে তার অতীত যেমন সুখে-দুঃখে ভরা, তেমনি কৈশোরকাল পেরিয়ে যখন সে যুবক হয়ে ওঠে, তখনো তার বয়ানেই এমন একটা কালপর্বের ছবির পর ছবি উঠে আসে, যেমন তা একান্ত ব্যক্তিগত, তেমনি তা সামগ্রিকভাবে পারিবারিক, চলমান সামাজিক ও রাজনৈতিক। তার ভাইবোনদের কৈশোরকালের যে ছবি তিনি এঁকেছেন, মনকে সত্যিই তা স্মৃতিমেদুর করে তোলে।

মাবলুদের সেই পরিবার মফস্‌সলের বাসিন্দা হলেও তাদের জীবন ছিল গর্বের। তাদের বাবা রফিকুর রহমান বিএ ছিলেন সক্রিয় বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্থানীয় একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান। তবে তাদের মা ছিল দুজন। বড় মা—সন্তানহীন। ছোট মা তিন ছেলেসন্তানের জন্মদাত্রী। প্রথম মা ছিলেন সর্বংসহা, গভীর মমতাময়ী। ছোট মা সন্তানদের গায়ে হাত তুললেও বড় মা কোনো দিন তাদের গায়ে হাত তোলেননি। উল্টো তিনি ছোট মায়ের হাত থেকে যথাসম্ভব তাদের রক্ষা করেছেন।

অন্য আর দশটি পরিবারের মতো সতিনে–সতিনে যে দ্বন্দ্বগত ঝগড়া-বিবাদ থাকে, দুজনের মধ্যে তার বিন্দুমাত্র অস্তিত্ব ছিল না। সেই বড় মা আকস্মিকভাবে গর্ভবতী হন। সময়ের ব্যবধানে এক মেয়েসন্তানের জন্ম দেন। তার নাম রাখা হয় লাভলি। বড় মা সন্তানপ্রসবজাত অবস্থা কাটিয়ে না ওঠা পর্যন্ত সেই লাভলিকে ছোট মা কোলে-পিঠে করে গভীর যত্নে লালন করতে থাকেন।

এর মধ্যেই একটা ঘটনা ঘটে, একাত্তর–পরবর্তীকালে জমিজমাসংক্রান্ত একটা বিবাদে জড়িয়ে পড়তে হয় মাবলুর মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে। সেই বিবাদের পরিণতিতে মামলা হয়। স্থানীয় প্রভাবশালী সংসদ সদস্যের করা সেই মামলায় তিনি হেরে যান। যেতে হয় তাঁকে জেলে। এই অবিচারের বেদনা ভেতরে-ভেতরে তাঁকে কুরে কুরে খেতে থাকে। তারই পরিণতি তার আকস্মিক অকালমৃত্যু।

এবার দুর্যোগ নেমে আসে পরিবারে। বাংলো টাইপের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে উঠে আসে তারা ঠাসাঠাসি করা স্বল্প পরিসরের একটা বাড়িতে। শুরু হয় সংসারে সেই টানাটানি, যার জেরে সবাই আপাতত হতাশাগ্রস্ত হলেও ভেঙে পড়ে না।

মাবলু-বাবলুদের বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই আমরা এই উপন্যাসের মূল ভিত্তির দিকে এগোতে থাকি। ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে থাকে এমন সব ঘটনা, আমাদের যা হতচকিত করে, হতবিহ্বল করে, মানুষের নীচতা-হীনতা, সেই সঙ্গে সাহসের সঙ্গে আসন্ন বা চলমান বিপদকে মোকাবিলা করার পথের যে সন্ধান, তারও ছবিকে ফুটিয়ে তোলেন ঔপন্যাসিক আনিসুল হক সুচারু শিল্পীর তুলিতে।

এ ঘটনার পর থেকেই, অর্থাৎ মাবলু-বাবলুদের বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই আমরা এই উপন্যাসের মূল ভিত্তির দিকে এগোতে থাকি। ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে থাকে এমন সব ঘটনা, আমাদের যা হতচকিত করে, হতবিহ্বল করে, মানুষের নীচতা-হীনতা, সেই সঙ্গে সাহসের সঙ্গে আসন্ন বা চলমান বিপদকে মোকাবিলা করার পথের যে সন্ধান, তারও ছবিকে ফুটিয়ে তোলেন ঔপন্যাসিক আনিসুল হক সুচারু শিল্পীর তুলিতে।

যেমন মাবলু-বাবলুর বাবা মারা যাওয়ার পর ‘তাদের বড় মার বাড়ি থেকে সেজ মামা আসতে শুরু করলেন।’ নাটক-থিয়েটার করা মানুষটি ডাবলুকে আড়ালে ডেকে নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, ‘শোন! তোরা সব নাবালক। একমাত্র বাবলু আঠারো হবে সামনের বছর। কিন্তু একটা মুশকিল আছে। বাবলুর বাবা তো তোদের বাবা নয়।’ সেই সঙ্গে এ-ও বললেন, ‘ফলে সে তো তোদের বাবার সম্পত্তি পেতে পারে না।’

কিন্তু তিন ভাইয়ের সম্পর্ক এতটাই গভীর আর অকাট্য ছিল যে ডাবলু সেই মামাকে লক্ষ্য করে সোজা বলে বসল, ‘আপনি এক্ষুনি বাড়ি ছেড়ে চলে যান। আপনাকে যদি আর কোনো দিনও দেখি, স্ট্রেট গুলি করে মেরে ফেলব। আমার বাবার বন্দুক আছে, তা তো জানেন। আমি সেটা চালাতে জানি।’

পরিবারের একান্ত সদস্যদের আস্থা যার ওপরে এত গভীর, অথচ তার পিতৃপরিচয় নিয়ে প্রচারিত এত কথা, সেই বাবলুই সংসারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়। অবশ্য প্রথম দিকে ধর্মাচারের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। ঢাকায় এসে সে চাকরি নিয়ে দিনে কাজ করে এবং রাতে করে ক্লাস। দুই মাস পর থেকে ছোট মায়ের নামে সে টাকা পাঠাতে থাকে। ফলে সংসারের টানাটানি ঘুচে যেতে থাকে। ঠিকঠাকমতো চলতে থাকে ভাইবোনদের লেখাপড়াও।

তারপর? তারপর উপন্যাসের সমাপ্তির দিকে ফেরা যাক। ‘কখনো আমার মাকে’উপন্যাসের ছোটমা একসময় গান করতেন। কিন্তু কেন ছোটমা আর গান করেন না? গভীর সেই বেদনাসিক্ত ইতিহাস, সত্যিকারভাবে ইতিহাসেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ।

বড় মা স্বামীর মৃত্যুর কিছুকালের মধ্যেই মারা যান। শোকের পর শোক। থাকেন শুধু ছোট মা। সেই ছোট মাকেও একদিন হারায় তাঁর ছেলেমেয়েরা। মৃত্যুর আগে শীর্ণদীর্ণ শরীরের ছোট মা ছেলেমেয়েদের তাঁর জীবনের ইতিহাস শুনিয়ে যান।

কী সেই ইতিহাস?

এখানে বিস্তারিত না বলে বরং বলি, সেই ইতিহাস খুবই করুণ। মর্মন্তুদ ঘটনা দিয়ে মোড়া। তা ছাড়া উপন্যাসটি পড়তে পড়তে এর মধ্যেই আমাদের জানা হয়ে গেছে বিশেষ একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে ছোটমা এখন আর গান করেন না।

তো সেই ঘটনাই–বা কী?—সব প্রশ্নের জবাব রয়েছে উপন্যাসের একদম শেষ পর্যায়ে। ইচ্ছা করেই সেই ঘটনাগুলো বর্ণনা করা থেকে নিজেকে বিরত রাখলাম। এটা পাঠকের জন্য চমক হিসেবেই থাক। কারণ, উপন্যাসের শেষ পর্বে গিয়ে পাঠক যখন এই ঘটনাগুলোর মুখোমুখি হবেন, তখন হয়তো আমার মতো তাঁরও হয়তো মনে হবে, পৃথিবী কি এতটাই নির্মম? দুনিয়ায় এমন ঘটনাও ঘটে!

আদতে এই উপন্যাসের পাঠ শেষে আমার একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি হলো, বহুদিন পর এমন একটা বই পড়লাম, যা আমাকে সত্যিকার অর্থেই কাঁদিয়েছে। আনিসুল হকের ‘কখনো আমার মাকে’ আমাদের সমকালীন উপন্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটা কাজ। ধ্রুপদি এই উপন্যাস পাঠককে মুগ্ধ করবে বলেই আমার বিশ্বাস।

‘কখনো আমার মাকে’ উপন্যাসের প্রচ্ছদ

কখনো আমার মাকে
আনিসুল হক
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২৪
দাম: ৪৮০ টাকা।
উপন্যাসটি বইমেলায় পাওয়া যাবে প্রথমা প্রকাশনের ৫ নম্বর প্যাভিলিয়নে।
ঘরে বসে বইটি পেতে অর্ডার করুন: prothoma.com