রাজমিস্ত্রির ঘরে পাওয়া যে বই ঘোরগ্রস্ত করেছিল

সেই ছোট্টবেলা থেকে আমি গল্পের বইয়ের পাগল। অক্ষর চেনার পর থেকেই গল্পের বই আমার কাছে নেশার মতো।

রাজমিস্ত্রির ঘরে পাওয়া বিভূতিভূষণের উপন্যাস পথের পাঁচালী ঘোরগ্রস্ত করেছিল সেদিনের কিশোরী আনোয়ারাকেঅলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘মন বদলে দেওয়া বই’ শিরোনামটি এত সুন্দর যে কীভাবে এটাকে নিজের মনের মতো করে বিশ্লেষণ করব, বুঝে পাচ্ছিনে।

এ পৃথিবীতে অনেক কিছু বাস্তব–অবাস্তব আছে, অনেক শিরোনামযোগ্য ঘটনা আছে, যা দেখে বা শুনে মানুষের মন বদলে যেতে পারে। কখনো তা এমনভাবে যে সারাটা জীবনেও সেই অভিজ্ঞতার কোনো ব্যত্যয় হয় না।

কিন্তু মন বদলে দেওয়া বই? সামান্য একটি বই কেমন করে একজন মানুষের মন বদলে দেয়?

একটা বইয়ে অনেক ধরনের লেখা থাকে। অনেক ছবিও থাকে। আরও অনেক কিছু থাকে, যেমন বইটার প্রচ্ছদ, গন্ধ বা স্পর্শ।

এসব লেখার বই, চোখে দেখে বা পড়ে বা চারপাশে তার ছায়া দেখে বা না দেখে কল্পনার রথে চড়ে একজন মানুষের মনের ভেতরে কি উত্তুঙ্গ হয়ে জেগে ওঠে বড় হয়ে ওঠার বাসনা? এই পৃথিবীকে ভিন্ন চোখে দেখার স্পৃহা?

চোখের পরতে পরতে জড়িয়ে যায় কিছু অদেখা স্বপ্ন? কিছু শিউলি ফুলের সুবাস? বা অন্তর্গত অনুভবের পেছনে বেজে ওঠে শিঞ্জনি? হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে?

অবশ্যই দেয়। অন্তত আমার জীবনটাই তার প্রমাণ।

একটা বই যদি মানুষের মন বদলে দিতে পারে, তাহলে তার কী হয়?

আনোয়ারা সৈয়দ হক

যা হয় তা বাইরে থেকে দেখে দেখে বোঝা প্রায় অসম্ভব। যা হয় তা ঘটে বুকের ভেতরে। যে কষ্ট হয়, যে বেদনা হয়, যে রক্তক্ষরণ হয়—সব হয় বুকের মধ্যে। বাইরের লোকের তা বোঝা প্রায় অসম্ভব।

বই নিয়ে কথা বলতে গেলে আমার নিজের কথা এসেই যাবে। জন্মেছিলাম একটা ডামাডোলের সময়। বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগে আগে।

শুধু তা–ই নয়, আমার জন্মক্ষণটি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের তুঙ্গ সময়। সর্বোপরি তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ (পঞ্চাশের মন্বন্তর) আমার তিন বছরের ছোট্ট শরীরের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। চারদিকের একটা ভাঙাচোরা পরিবেশে, দেশভাগের উত্তুঙ্গ সময়ে, ছোট বন্ধুবান্ধবকে প্রতিনিয়ত হারিয়ে ফেলার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছিল আমার শৈশব। তখন এসবের কিছুই বুঝতাম না আমি। কিন্তু এখন বুঝি এর প্রতিটি ঘটনাই আমার ছোট্ট মনের ভেতরে কিছু জিজ্ঞাসার চিহ্ন, কিছু রক্তাক্ত রেখার আঁকিবুঁকি কেটে গিয়েছিল মনের গহিনে।

একটু বড় হতে, হয়তো ১০–১১ বছর বয়সের সময় আমার বাবা তাঁর পিতৃদত্ত জমির ওপর দোতলা বাড়ির ভিত কাটলেন। এ উপলক্ষে আমাদের বাসস্থান ভরে গেল শাবল, কোদাল, গাঁইতিতে। আর ভরে গেল দিন-শ্রমিক ও রাজমিস্ত্রিদের পদচারণে।

কীভাবে সেখানে মা–বাবা, ভাই–বোনসহ থাকতাম, আজ আর স্মরণে নেই। কিন্তু মিস্ত্রিদের কাজ আমি মনোযোগ দিয়ে দেখতাম। তারা বাড়ির ভিত গাঁথছিল মাটি কেটে, একের পর এক গভীর ভিত কেটে চলছিল। যা বাইরে থেকে উবু হয়ে বসে দেখতে দেখতে আমার শরীর শিরশির করে উঠত অজানা এক ভয়ে। যশোরের অনেক দূর থেকে এই মিস্ত্রিদের ভাড়া করে আনা হতো। বিশেষত রাজমিস্ত্রি।

রোজ সকালে মহাসমারোহে এই ভিত কাটা চলত। আর ৮ বা ৯ বছরের আমি তাদের পায়ে পায়ে ঘুরতাম। মা বকা দিতেন, বাবা চোখ রাঙাতেন; কিন্তু তাঁদের চোখের আড়ালে কেবলই ঘুরঘুর করতাম। এসব মিস্ত্রি রাতের বেলা আমাদের বাড়ির লাগোয়া একটা ছোট হলঘরে ঘুমিয়ে থাকত। সেখানে তাদের জামাকাপড়, থালাবাসন, বদনা, জায়নামাজ—সব থাকত।

একদিন তারা যখন মাটি কাটার কাজে মহাব্যস্ত। গোপনে আমি তাদের বাসস্থানে গিয়ে উঁকি দিলাম। সেখানে এক জায়গায় এক রাজমিস্ত্রির জামাকাপড় দড়ির আলনায় ঝোলানো। নিচে তার পায়ের খড়ম, তামাকের কলকে, চটি জুতা—এসব।

আর একটি লম্বা তক্তার ওপর ছোট একটি ডালা ভাঙা টিনের ট্রাঙ্ক।

রাজমিস্ত্রির ট্রাঙ্ক।

ট্রাঙ্কটা এত পুরোনো যে তার গা থেকে ফুলের নকশা প্রায় উঠে গেছে।

সেই ছোট্টবেলা থেকে আমি গল্পের বইয়ের পাগল। অক্ষর চেনার পর থেকেই গল্পের বই আমার কাছে নেশার মতো। গল্প শোনা অথবা গল্পের বই পড়া আমার জন্য ভীষণ এক জরুরি প্রয়োজন হয়ে উঠেছে আমার সেই ১০–১১ বছরের জীবনে থেকেই।

কৌতূহল না চাপতে পেরে সেই ডালাভাঙা টিনের ট্রাঙ্কের ঢাকনা খুলে ফেলে যা আমি চোখে দেখলাম, তা ছিল একটি পাতা ছেঁড়া তুলোট রঙের মোটা বই। বইটি একটু উল্টে পাল্টে দেখে পড়তে লাগলাম আমি। বর্ণনার পর বর্ণনা—সেখানে একটি ছোট ছেলে জঙ্গলে বসে তির–ধনুক বানিয়ে কিছু একটা করতে চাইছে। তার বোন দুর্গা আর সে ঘুরে বেড়াচ্ছে এধার–ওধার।

সেদিন সেই প্রায়ান্ধকার ঘরে বালিকা বয়সের আমি গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম মন কেমন করা সেই বর্ণনা। আমার চারপাশে যেন শিঞ্জনি বেজে উঠল মধুর স্বরে। কিন্তু বেশিক্ষণ পড়তে সাহস হলো না। কারণ, যেকোনো মুহূর্তে যে কেউ ঘরে ঢুকে পড়তে পারে। বুভুক্ষু হৃদয়ে বইটির কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে আমার যেন ঘোর লেগে গেল।

আমি এখন কী করি?

কার বই? কী নাম?

কোথায় পাওয়া যাবে?

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

সেই ঘোরলাগা মুহূর্তে, কিশোরীকালে মনে কেবলই প্রশ্ন।

অনেক বছর পরে জানলাম, সেটি ছিল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস পথের পাঁচালী

তো সেই বই দিয়ে আমার বাংলার মানুষের জীবনের কথা জানার শুরু। কতবার করে যে বইটা পড়েছি!

তারপর আরেকটু বড় হতে, যখন কিশোরীকাল পার হব হব সময়, হাতে এল এরিখ মারিয়া রেমার্কের থ্রি কমরেডস–এর বাংলা অনুবাদ তিন বন্ধু। এই বই পড়ে আমার দিন–রাত্রি যেন বিদেশি কোনো রাষ্ট্রের জল, বায়ু, পরিবেশের সঙ্গে একাকার হয়ে গেল। যেনবা প্রেম হয়ে গেল আমার। আমি একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলাম। দিন–রাত হয়ে উঠল স্বপ্নময় কোনো জগৎ। এটা এমন এক জগৎ, যেখানে মানুষের জীবনে বন্ধুত্বের চেয়ে আর কিছু বড় নয়। কোনো কিছুই বড় নয়।

সেই অবস্থার ঘোরের মধ্যে কাটতে লাগল দিন। সত্যি যদি বলি, বইয়ের সেই ঘোর কি এখনো কেটেছে? জীবনের ঘোর কি কোনো দিন কাটে? জীবন নিজেই তো একটি ঘোর।

এরপর যখন যৌবনে পা রেখেছি, জীবন যখন শুধুই একটি মুনলাইট সোনাটা, তখন একদিন কাকতালীয়ভাবে হাতে এল তিন পয়সার জ্যোছনা নামে চটি একটি উপন্যাস। উপন্যাসটি ছাপা হয়েছিল গাজী শাহাবুদ্দীনের সচিত্র সন্ধানী পত্রিকায়। তখন আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজে তৃতীয় বর্ষে পড়ি। মন উড়ু উড়ু। কিন্তু দৃষ্টি নিবদ্ধ ডাক্তার হওয়ার দিকে। সেই সময় এই পত্রিকা এল আমার হাতে।

ব্যস, আমার রাতের ঘুম যেন টলোমলো হয়ে গেল! দিনের প্রখর রৌদ্র, রাতের অসহ্য গরম, বাইরের কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার—সব যেন হয়ে গেল জোছনায় মোড়ানো কোনো রবীন্দ্রসংগীত, ‘আজি জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে।’

আমার জীবনে এই তিনটি মাত্র বই, তিনটিই মাত্র বই—গুরুতর কিছু না, দার্শনিক কিছু না, পাণ্ডিত্যের কিছু না, অহমিকার কিছু না, শুধু জীবন, শুধুই মানুষের জীবন...। আহা, মানুষের জীবনের চেয়ে এত ভালো, এত মহৎ, এত পবিত্র, এত বিশ্বাসের আর কী আছে?

তারপর আরও আছেন—তলস্তয়, মানিক, শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, আছেন বুদ্ধদেব; এবং অবশ্যই আছেন রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল। তাঁরা সবাই প্রতিটি মানুষেরই মন বদলে দেওয়ার কারিগর।

এঁদের লেখা বই আমার মন শুধু নয়, গোটা জীবনই বদলে দিয়েছে।