মুক্তিযুদ্ধের জন-ইতিহাস নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা

একাত্তরের চিঠি বের করার মধ্য দিয়ে ২০০৯ সালে জন্ম হয়েছিল প্রথমা প্রকাশনের। এর পর থেকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে প্রকাশনা সংস্থাটি বের করেছে অনেক বই। আলো ফেলেছে মুক্তিযুদ্ধের অনালোচিত অনেক অধ্যায়ের ওপর।

প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত কয়েকটি মুক্তিযুদ্ধের বইছবি: খালেদ সরকার

মুক্তিযুদ্ধকে সাধারণ মানুষ দেখে দেশ স্বাধীনের জন্য করা একটা যুদ্ধ হিসেবে। এই যুদ্ধে প্রাণ-মান-অর্থ–বুদ্ধিবৃত্তি—কত কিছুর যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। বাংলার আপামর জনসাধারণ এটাও মনে করে যে এই অপূরণীয় ক্ষতির বিনিময়েই আমরা একটি পতাকা অর্জন করেছি। এ জন্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সাধারণ মানুষের কাছে একই সঙ্গে আনন্দ আর বিষাদের মিশেলে রচিত অপূর্ব এক গীতিকা। গণমানুষের এই ধারণা অমূলক নয়। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে এ ধরনের চিন্তা অবশ্যই উপসংহারসূচক।

কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নানা ঘটনাস্রোত আছে। সব স্রোত সব সময় যে একই দিকে বয়ে চলেছে, তা নয়। পৃথিবীর যেকোনো দেশের মুক্তির লড়াই-সংগ্রামের মতোই অনুকূল-প্রতিকূল নানা ধারা-উপধারা, মত-মতান্তর, সংকট-সম্ভাবনার দোলায় দুলে অবশেষে সার্থক হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। অর্থাৎ জানা অধ্যায়ের বাইরেও মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসের মধ্যে অজানা অজস্র অধ্যায় রয়ে গেছে। সেসবের নিবিড় তালাশের নামই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা। এ গবেষণা আগে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এই অন্বেষণের কাজটি চলে রাষ্ট্রের তরফে এবং গবেষকদের তরফে। একটা রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের মানুষেরা যখন মুক্তিযুদ্ধের দিকে নজর দেন, তখন এর বিস্তার আর গভীরতা একটা ভিন্নমাত্রায় দেখা দেয় বৈকি। তখন যুদ্ধের পেছনের যুদ্ধ, যুদ্ধের ভেতরের যুদ্ধ, অজানা আরও কত–কী উঁকিঝুঁকি মারতে থাকে, তার ইয়ত্তা নেই। অনেকটা ফিকশনের মতো। মূল কাহিনিটি কত উপকাহিনির সমবায়ে গড়ে ওঠে! একটা সফল পরিণতির মহাকাব্যিক কাহিনির জন্য কত কিসিমের মানুষের কত বিনিদ্র ভাবনা-ব্যাকুলতা, ঘষামাজা! কিন্তু সাধারণ চোখে এর সবকিছু কি ধরা পড়ে!

এই যে বাংলাদেশের ইতিহাসের মহাকাব্যিক ঘটনা, যা ঘটেছিল আজ থেকে অর্ধশত বছরের বেশি সময় আগে, সে ঘটনার সবকিছু আমরা জানি না। অনেক পরম্পরা ও চিহ্নসূত্রও হারিয়ে ফেলেছি। মূল ঘটনার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত অনেক উপঘটনা আমরা ভুলে গিয়েছি; ধরে রাখার প্রয়োজনও বোধ করিনি হয়তো। প্রয়োজনীয় অনেক নায়কোপম চরিত্র বিস্মৃতির অতলে চলে গেছে। আমরা এসবের যত খোঁজ করব, ততই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গভীর, সম্পূর্ণ ও বিস্তৃত হবে। আমাদের বর্তমান অবশ্যই একটা শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ঋদ্ধ করতে; বর্তমানকে একটা আরও শক্ত পটভূমির ওপর দাঁড় করানোর জন্য রাষ্ট্র, নানা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। প্রথমা প্রকাশন এই চর্চাযজ্ঞের অন্যতম শরিক।

যেখানে আলো পড়েনি

প্রথমা প্রকাশন প্রকাশনাজগতে প্রবেশ করে ২০০৯ সালে। এর মধ্যে বিচিত্র বিষয়-আশয় নিয়ে অসংখ্য বই প্রকাশিত হয়েছে এখান থেকে। ১৫ বছরের অভিযাত্রায় এই প্রকাশনা সংস্থা থেকে শুধু মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই-ই প্রকাশিত হয়েছে ৬৫টির মতো। গড়ে প্রতিবছর প্রায় ৪টি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বই বের করা কম কথা নয়। প্রকাশনার এই পরিসংখ্যান বলে দেয়, সংস্থাটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নির্মাণের প্রশ্নে আন্তরিকভাবে আগ্রহী। তবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শুধু নন–ফিকশন নয়, অনেক গল্প–উপন্যাসও প্রকাশিত হয়েছে প্রকাশনাটি থেকে।

আদতে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দীর্ঘ চর্চার ভেতর দিয়ে প্রথমা ইতিমধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নির্মাণের অন্যতম অংশীজনে পরিণত হয়েছেও বটে।

প্রথমার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অন্বেষণের একটা বিশেষ চরিত্র আছে। যেখানে আলো পড়েনি, সেখানেই তারা আলো ফেলতে চায়। ইতিহাসের যেখানে অসম্পূর্ণতা ও অন্ধকার, সেখানেই প্রথমার নজর। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে, প্রথমা প্রকাশন থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের চিকিৎসা ইতিহাস বইটির কথা। বইটি লিখেছেন কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান ও চিকিৎসাবিদ খায়রুল ইসলাম। আমরা মুক্তিযুদ্ধে কিছু চিকিৎসকের আত্মত্যাগের কথা জানি। এ–ও জানি যে কিছু কিছু চিকিৎসক কোথাও কোথাও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিয়ে বাঁচিয়েছেন। তাঁদের আবার যুদ্ধের উপযোগী করে তুলেছেন। বহু সাধারণ মানুষকে তাঁরা জীবনের মধ্যে ফিরে আসতে সহায়তা করেছেন। কিন্তু তৎকালীন পূর্ব বাংলার চিকিৎসাব্যবস্থাটা সামগ্রিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত ছিল, কীভাবেই–বা কাজ করেছে ওই সংকটকালে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও অপরাপর হাসপাতালগুলোর ভূমিকাটা কেমন ছিল, সেক্টরভিত্তিক চিকিৎসাব্যবস্থাটা কেমন ছিল, শরণার্থীশিবিরের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির বিষয়টা কারা কীভাবে মোকাবিলা করেছে—এসব বিষয়ের পূর্ণাঙ্গ কোনো ইতিহাস আমরা জানি না। কোনো তরফেই এই অধ্যায়টির ওপর তেমন একটা আলো ফেলা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের চিকিৎসা ইতিহাস বইটি ইতিহাসের ওই অনালোকিত দিকটিতে আলো ফেলেছে। ফলে উন্মোচিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ভিন্ন একটি অধ্যায়।

ধরা যাক, মতিউর রহমান সম্পাদিত ১৯৭১: শিলিগুড়ি সম্মেলন বইটির কথা। বইটির সম্পাদক ভূমিকায় বলছেন, ‘১৯৭১ সালের জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত হয় শিলিগুড়ি সম্মেলন, যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য ছিল একটি নির্ধারক ঘটনা। এ সম্মেলনে গৃহীত নীতিমালা ও সিদ্ধান্তের আলোকে পরিচালিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের মূল কর্মকাণ্ড।’ ৫ ও ৬ জুলাইয়ের ওই সম্মেলনে অল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও ইস্ট পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যসহ মোট ৪০০ জন প্রতিনিধি যোগ দেন। সম্মেলনটি সার্বিক সমন্বয়ের দায়িত্ব ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৩৩ কোর সদর দপ্তরের ওপর। ‘সম্পাদকের কথা’ অংশে বইটির সম্পাদক জানাচ্ছেন, ‘এ সম্মেলনের পরপরই যোগদানকারীদের সঙ্গে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর ধারাবাহিক আলোচনা আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে সৃষ্ট বিভ্রান্তি ও নেতৃত্বের কোন্দল দূর করে এবং নীতিনির্ধারণে সহায়তা করে, যা পরবর্তী সময়ে যুদ্ধ চলাকালে প্রয়োগ করা হয়। এতে দ্রুত যুদ্ধজয় নিশ্চিত হয়।’ কিন্তু বিস্ময়কর হচ্ছে, এই সম্মেলন সম্পর্কে তেমন কোনো ইতিহাসসম্মত ঘাঁটাঘাঁটিই হয়নি। ঘাঁটাঘাঁটিই–বা বলি কেন, আদতে এত গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা সম্পর্কে ‘বিশেষ কিছু জানাই সম্ভব হয়নি।’ প্রথমা ২০২২ সালে ওই সম্মেলনের কিছু ইংরেজি দলিল ও মূল্যায়নসহ ১৯৭১: দ্য শিলিগুড়ি কনফারেন্স নামে একটি ইংরেজি বই প্রকাশ করে। পাঠকচাহিদার দিকে লক্ষ করে বইটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয় ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। মুক্তিযুদ্ধের এই অজানা ইতিহাসের প্রতি মানুষের আগ্রহের মাত্রাটা বোঝা যাবে এই তথ্যে যে ওই একই মাসে নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ অনূদিত ও মতিউর রহমান সম্পাদিত বইটির দ্বিতীয় মুদ্রণ প্রকাশিত হয়েছে। এই মুদ্রণও শেষের পথে।

একাত্তরের চিঠি বা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী এবং এই ধরনের আরও আরও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বইয়ের মধ্য দিয়ে প্রথমা প্রকাশন সম্ভবত বড় লোকদের ভিড়ে অনেকটা হারিয়ে যাওয়া অথচ সাধারণ মানুষের মুখে মুখে স্থান পাওয়া প্রত্যন্ত অঞ্চলের আত্মত্যাগী ও বীর সেনানীদের ওপর আলো ফেলতে চায়।

বাড়ছে মানুষের আগ্রহ

মুক্তিযুদ্ধের খুঁটিনাটি আজকাল সাধারণ মানুষ ও বিদ্বৎসমাজ জানতে চায়। বুঝতে চায়। এটি নিশ্চয়ই একটি জনগোষ্ঠীর তার ইতিহাসের প্রতি অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠার লক্ষণ। এই অনুসন্ধিৎসার প্রকাশ আমরা দেখি প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত রেহমান সোবহানের বাংলাদেশের অভ্যুদয়: একজন প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য, (২০১৭); শ্রীনাথ রাঘবন রচিত ও কাজী জাওয়াদ অনূদিত ১৯৭১: বাংলাদেশ সৃষ্টির বৈশ্বিক ইতিহাস, (২০২৪); মতিউর রহমানের ভালোবাসায় বাড়ানো হাত: মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি লেখক-শিল্পী বন্ধু, (২০২২); মঈদুল হাসানের উপধারা একাত্তর: মার্চ-এপ্রিল, (২০১৫); মালেকা বেগমের মুক্তিযুদ্ধে নারী, (২০১১); হাসান ফেরদৌসের ১৯৭১: বন্ধুর মুখ শত্রুর ছায়া, (২০০৯); মতিউর রহমান সম্পাদিত ১৯৭১: শত্রু ও মিত্রের কলমে, (২০২০); মিজানুর রহমান খানের মার্কিন দলিলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, (২০২২); গোলাম মুরশিদের মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর: একটি নির্দলীয় ইতিহাস, (২০১০); মুনতাসীর মামুনের মুক্তিযুদ্ধে সাংস্কৃতিক অবদান, (২০২০); রাশেদুর রহমান সম্পাদিত অবরুদ্ধ ঢাকা ১৯৭১: গোপন প্রতিরোধকারীদের সাক্ষাৎকার, (২০২১); মুহাম্মদ লুৎফুল হকের স্বাধীনতাযুদ্ধের গোপন বিদ্রোহী কমান্ডার মোয়াজ্জেম, (২০২১) প্রভৃতি বইয়ের ক্ষেত্রেও। এসব বইয়ের অধিকাংশই প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই নিঃশেষিত হয়েছে। এর মধ্যে একটা বড় অংশ বইয়ের অষ্টম-নবম মুদ্রণ পর্যন্ত নিঃশেষিত হয়েছে। যাঁরা মনে করেন মানুষ বই কেনে না, পড়ে না, তাঁদের কথা এই পরিসংখ্যান ভুল প্রমাণিত করছে।

কিন্তু বইয়ের কাটতির পরিসংখ্যানও আসলে মূল ব্যাপার নয়। এটা সব সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্যও করে না হয়তো। কিন্তু এই পরিসংখ্যান থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। এই আগ্রহ একই সঙ্গে আশঙ্কার আর আসানের। বাংলাদেশের মানুষ তার নিজের ইতিহাস নিজেই যাচাই–বাছাই করে দেখতে চায়। খননে যেতে চায়। বিভিন্ন পক্ষ-বিপক্ষের নির্মিত ইতিহাসে সে কি তবে আস্থা রাখতে পারছে না! নাকি আস্থা স্থাপনের জন্যই এই অনুসন্ধিৎসা!

প্রথমা প্রকাশনের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম বই একাত্তরের চিঠি প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালে। বইটির ৫৫তম মুদ্রণ এর মধ্যে নাকি শেষ হয়েছে। সংখ্যাটা ১ লাখ ৬১ হাজার। এটা একরকম অবিশ্বাস্য বটে! বই পড়ার সংস্কৃতিহীন একটা সমাজে একটি বইয়ের এত মুদ্রণ অবিশ্বাস্য বৈকি! কৌতূহল জাগা স্বাভাবিক যে বইটিতে কী আছে! আছে অতিসাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের কিছু চিঠি। এসব চিঠিতে তাঁরা তাঁদের পরিবার-পরিজনের কাছে যুদ্ধ নিয়ে, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পরিবারের জন্য অনুভূত প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে, শত্রুকে খতম করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে, দেশপ্রেমের অনুভব নিয়ে তাঁদের নিরাবিল অনুভূতি প্রকাশ করেছে। মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ। এই জনযুদ্ধে জনগণের পরিস্থিতি কী ছিল; কী ছিল তাঁদের প্রতিজ্ঞা-অনুভব-অনুভূতি; কীভাবে তাঁরা সাড়া দিয়েছিলেন ওই যুদ্ধে—বর্তমানের সাধারণ মানুষ তা জানতে ও বুঝতে চান। এ জন্যই এই বই মানুষের কাছে এত আদরণীয় হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়।

জনযুদ্ধের ইতিহাস–দর্শন

আমাদের ইতিহাস অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষদের নিয়ে নীরব থাকে। বড়দের কথায়, অসাধারণদের কথায় মুখর এই ইতিহাস। বাংলার ইতিহাসচর্চার এই একদেশদর্শী প্রবণতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথও কম আক্ষেপ করেননি। প্রথমা তার বিচিত্র ধরনের কাজের ভেতর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চার অভিমুখটি যেন কিছুটা বদলে দিতে চায়। সংস্থাটি কি তবে জন-ইতিহাস নির্মাণ করতে চায়! একাত্তরের চিঠি বইয়ের ভূমিকায় বলা হয়েছে, ‘...এটি ছিল জনযুদ্ধ। সাধারণ, অতিসাধারণ কৃষক, মজুর, জেলে, কামার, কুমার, শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী, শিল্পী, ছাত্রছাত্রী, কন্যা, স্ত্রী, এমনকি বয়স্ক নারী-পুরুষও সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন; যুদ্ধে অনেক প্রবীণ-প্রবীণা মুক্তিবাহিনীর অকুতোভয় সৈনিকদের প্রতি সর্বতোভাবে সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন।’ ভূমিকায় উল্লিখিত এই কথার পরেই বলা হয়েছে, ‘জনযুদ্ধ কথাটির সূত্রেই আমরা একাত্তরের চিঠির চিঠিগুলো পর্যালোচনা করলে দেখতে পাব, বেশির ভাগ চিঠিই লিখেছেন তরুণ যোদ্ধারা; অল্পশিক্ষিত যুবক, স্কুল-কলেজের ছাত্র।’

সম্ভবত এই ‘জনযুদ্ধের’ ইতিহাস-দর্শনের অংশ হিসেবেই প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কয়েকটি বই। এর মধ্যে অতিসম্প্রতি বেরোনো মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অন্তত দুটি বইয়ের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার। একটি সাজ্জাদ শরিফ সম্পাদিত একাত্তরের দিনপঞ্জি : মুক্তিযুদ্ধের দৈনিক ঘটনালিপি এবং অন্যটি আনিসুল হক সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী: স্মৃতি জীবন যুদ্ধ প্রথমটি ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের প্রতিদিনের মুক্তিযুদ্ধের মোটামুটি খুঁটিনাটি পরিস্থিতি নিয়ে লেখা। গ্রন্থটিতে বড় বড় ঐতিহাসিক ঘটনা ও ব্যক্তিত্বদের উত্তাপ থাকলেও সাধারণ মানুষের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার একটা গমগমানিও খুব ভালোভাবেই চোখে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধে গণমানুষের গতিবিধি বইটিকে একটা ভিন্নমাত্রা দিয়েছে বলে মনে হয়। দ্বিতীয় বইটি ইতিহাসকে জনপরিসরের মধ্যে দেখার আকাঙ্ক্ষা থেকে রচিত। পরিচিত, স্বল্পপরিচিত ও অপরিচিত মিলিয়ে ৩৫৪ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর জীবনবৃত্তান্ত ও অবদান লিপিবদ্ধ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী: স্মৃতি জীবন যুদ্ধ বইয়ে। বইটি ‘বাংলাদেশের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় সংকলন।’  

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের হাতে গোনা কয়েকজনকে মাত্র আমরা চিনি। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আমরা যাঁদের চিনি, তাঁরা অধিকাংশই চাকরিতে বড়। অবদানেও বড়। কিন্তু এর বাইরেও বহু শহীদ বুদ্ধিজীবী আছেন। তাঁদের অবদানেও আমাদের পতাকার লাল রং রঞ্জিত। কিন্তু কোনো এক অলৌকিক নিয়মে তাঁরা অধিকাংশই আলোর বাইরে রয়ে যান। তাঁদের স্থান আমাদের ‘বড় ইতিহাসে’ কমই হয়। এই চরিত্রদের সম্পর্কেই কি তবে কবি বলেছেন, ‘হয়তোবা ইতিহাসে তোমাদের নাম লেখা রবে না/ বড় বড় লোকেদের ভীড়ে, জ্ঞানী আর গুণীদের আসরে/ তোমাদের কথা কেউ কবে না’! তাহলে এঁদের স্থান কোথায়! কবি নিজেই এঁদের স্থান বাতলে দিচ্ছেন এভাবে, ‘থাক ওরা পড়ে থাক ইতিহাস নিয়ে/ জীবনের দীনতা হীনতা নিয়ে/ তোমাদের কথা রবে সাধারণ মানুষের ভীড়ে/ মাঠে মাঠে কৃষাণের মুখে,/ ঘরে ঘরে কৃষাণীর বুকে/ স্মৃতি-বেদনার আঁখিনীরে।’ একাত্তরের চিঠি বা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী: স্মৃতি জীবন যুদ্ধ এবং এই ধরনের আরও আরও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বইয়ের মধ্য দিয়ে প্রথমা প্রকাশন সম্ভবত বড় লোকদের ভিড়ে অনেকটা হারিয়ে যাওয়া অথচ সাধারণ মানুষের মুখে মুখে স্থান পাওয়া প্রত্যন্ত অঞ্চলের আত্মত্যাগী ও বীর সেনানীদের ওপর আলো ফেলতে চায়। এদিক থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আনিসুল হক সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী: স্মৃতি জীবন যুদ্ধ গ্রন্থটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। মুক্তিযুদ্ধের জন-ইতিহাস নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত বইয়ের একটা বড় অংশের প্রধান প্রবণতা। ইতিহাসচর্চার এই ধরন দরকারি বলে মনে করি।

ঘরে বসে প্রথমা প্রকাশনের বই পেতে অর্ডার করুন prothoma.com

খননের ভেতর দিয়ে ইতিহাস

প্রথমা প্রকাশনের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বইগুলোর মধ্য থেকে কোনো কোনো বই নানান বিতর্কের জন্ম দিয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। এ জন্য কেউ কেউ তাদের এই চর্চাকে সমালোচনার চোখে দেখেন। মনে করেন, ওই সব বই মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসকে ভিন্ন খাতে নিয়ে যায়। হতে পারে। কিন্তু যাঁদেরই ইতিহাস সম্পর্কে একটা প্রাথমিক জ্ঞান আছে, তাঁরাই জানেন, ইতিহাস কোনো তেজাবি পদার্থ নয়। ইতিহাস চলে বহুমাত্রিক নির্মাণ-প্রতিনির্মাণের ভেতর দিয়ে। ক্রমাগত বিচিত্র খননের ভেতর দিয়ে ইতিহাস কিছুকাল থিতু হয়। কিন্তু চিরকাল একই জায়গায় থিতু হয়ে থাকা ইতিহাসের স্বভাববিরুদ্ধ। ইতিহাস চিরচলিষ্ণু। এই চলিষ্ণুতার ভেতর দিয়েই সে স্বকালের চেতনার বাহক হয়ে ওঠে। কালের চাহিদা পূরণ করে চলে। তাই ইতিহাসদৃষ্টি যত বিচিত্রগামী হয়, ততই তা সমৃদ্ধ হয়। ভুল ইতিহাস, সঠিক ইতিহাস, নিরপেক্ষ ইতিহাস বলে কিছু নেই। ইতিহাস সব সময় ক্ষমতাবান ও লোক-আকাঙ্ক্ষার অনুগামী হয়। আর হঠাৎ–কথা কখনো ইতিহাসের উপাদান হয় না। ইতিহাস মানেই যাচাই-বাছাই, ঝালাই-মালাই।

মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের বাঙালি জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে গৌরবময় ইতিহাস। বাক্যটিও মুক্তিযুদ্ধের মাহাত্ম্যকে ব্যাখ্যা করার জন্য যথেষ্ট নয় বলে মনে করি। কে কবে ভেবেছে জল-জঙ্গল, সাপখোপ আর দারিদ্র্যের আকর এই বাংলাদেশের মানুষেরা একদিন একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে ফেলবে! নৃতাত্ত্বিক জাতভাই ও একই উম্মাহর ধর্মভাই—কেউই ভাবেনি। কিন্তু তবু মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়েই অবিশ্বাস্য ঘটনাটি ঘটেছে; বাংলাদেশের হাইলা-জোলা-কুমার-কামারেরা একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। এর জন্য অবশ্য কম মূল্য দিতে হয়নি!

খালি চোখে দেখতে গেলে বাঙালির এই মহত্তম ইতিহাসের একটিমাত্র বয়ান আছে বলে মনে হয়। কিন্তু গভীরভাবে দেখতে গেলে দেখা যাবে, মুক্তিযুদ্ধের বহিঃকাঠামোটি ঠিক থাকলেও ভেতরে–ভেতরে এর নানা পাঠ-পাঠান্তর আছে। এই পাঠ-পাঠান্তর কারও কারও পছন্দ না–ও হতে পারে। কেউ কেউ গোস্‌সা করতে পারেন। ক্ষুব্ধও হতে পারেন। কিন্তু ইতিহাসচর্চার ময়দানে সেটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে বহুস্বর জারি থাকা। এই বহুস্বরের ভেতর দিয়ে আসল মুক্তিযুদ্ধের একটা রূপরেখা তৈরি হবে। বা মানুষ এই সময়ে বসে মুক্তিযুদ্ধকে যেভাবে দেখতে বা দেখাতে চায়, সেই প্রয়োজনীয় মুক্তিযুদ্ধের কাছে পৌঁছাতে পারা যাবে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বহুমাত্রিক ও গভীর কাজ খুব কমই হয়েছে। সবই প্রায় একটা বা দুটো পাঠ। এ ধরনের সীমিত পাঠের সমস্যা হচ্ছে, এটি একসময় স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে। আধিপত্যবাদী হয়ে উঠতে পারে। চোখ রাঙিয়ে শাসাতেও পারে। গলা টিপে হত্যা করতে পারে অপরাপর পাঠগুলোকে। বাংলাদেশে প্রথমা প্রকাশন একক বা দ্বৈত পাঠের বাইরে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে নানা আলো ফেলে দেখার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বলে মনে হয়। সরকারি ও বেসরকারিভাবে এ ধরনের আরও বহুমাত্রিক চর্চার ভেতর দিয়েই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস একটা শক্তপোক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে বলে মনে করি।