আকবর আলি খানের লেখালেখির জগতের খোঁজ রয়েছে যে বইয়ে 

আকবর আলি খানছবি: প্রথম আলো

রবীন্দ্রনাথ কোনো কোনো ইংরেজকে ‘বড় ইংরেজ’ বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম আ মোল ইন দ্য ক্রাউন–এর লেখক মাইকেল ক্যারিট (১৯০৬–১৯৯০)। ক্যারিট ছিলেন ব্রিটিশ আমলের বড় আমলা। পড়ালেখা করেছেন অক্সফোর্ডে। কিন্তু মনেপ্রাণে ছিলেন সমাজতন্ত্রপন্থী মানুষ। গোপনে কাজ করেছেন ইংরেজদের বিরুদ্ধেই। আদতে ক্যারিট ছিলেন মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ। শত বিপদের মধ্যেও ন্যায়, নীতি, আদর্শ ও মূল্যবোধকে বন্ধক রাখতে রাজি ছিলেন না। তাই তিনি দাঁড়িয়েছিলেন মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে। কাজ করেছেন মজাফ্ফর আহমদ, পি সি জোশী, গঙ্গাধর অধিকারী, বি টি রণদিভে, এস এস মিরাজকর, অজয় ঘোষ, আবদুল হালিম প্রমুখের সঙ্গে।

বাংলাদেশের আকবর আলি খান (১৯৪৪–২০২২) এমনই একজন অগ্রগণ্য মানুষ, যিনি সরকারের বড় আমলা হয়েও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধকালে তৎকালীন সরকার তাঁকে ১৪ বছরের জেলও দিয়েছিল। সরকারি আমলা হওয়ার পরও তিনি কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেন? উত্তরে তিনি বলেছেন, ‘আমি সরকারি কর্মচারীর পরিচিতিতে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেইনি বা সরকারি কর্মচারী ছিলাম বলে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলাম, তেমন নয়। আমি দেখেছিলাম যে পাকিস্তান রাষ্ট্র মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে এবং করে চলেছে। তাই বিবেকবান, সমর্থ মানুষ হিসেবে আমার দায়িত্ব দাঁড়িয়েছিল সেই অপরাধের প্রতিবাদ করা এবং নিজেকে, নিজের জাতিগোষ্ঠীকে রক্ষা করার চেষ্টা করা। সরকারি কর্মচারীর পরিচিতি তখন আমার কাছে ছিল গৌণ অথবা অর্থহীন।’

মাইকেল ক্যারিট ভারতীয় ছিলেন না, তারপরও ভারতীয়দের জন্য কাজ করেছেন। আকবর আলি খান নিজের জাতিগোষ্ঠীকে নির্যাতন থেকে রক্ষার জন্য যুদ্ধে গিয়েছেন। দুজনের আদর্শ প্রায় একই। কেউ অন্যায় সহ্য করেননি। ন্যায়ের জন্য কাজ করে গেছেন আজীবন।

সম্প্রতি প্রথমা প্রকাশন থেকে বেরিয়েছে আমিনুল ইসলাম ভুইয়ার আকবর আলি খান: লেখালেখির জায়গা–জমিন বইটি। লেখক এই বইয়ে আকবর আলি খানের সমগ্র লেখালেখির জগৎ নিয়ে আলোচনা করেছেন। সঙ্গে আছে কিছু স্মৃতিচারণা। আকবর আলি খানের অধীনে একসময় কাজ করেছেন বইটির লেখক। সেই সূত্রেই তাঁর কাজ সম্পর্কে ঘনিষ্ঠ ধারণা ছিল তাঁর।

বইটিতে আকবর আলি খানের চিন্তার জগৎ নিয়ে আলোচনা রয়েছে। সেখানে স্থান পেয়েছে তাঁর পল্লি উন্নয়ন ভাবনা, স্বদেশ–অন্বেষণ, বইপত্র, মুক্তির লড়াই ইত্যাদি। এখানে আকবর আলি খানের বইগুলো বিচার–বিশ্লেষণ করে তাঁর চিন্তার জগৎ উন্মোচনের প্রয়াস নিয়েছেন লেখক।

আকবর আলি খান বাংলাদেশের সত্তার অন্বেষা বইয়ে বাংলাদেশের সামাজিক পুঁজির ঘাটতির কথা বলেছেন। বইটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ গ্রাম ছিল ‘প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সংঘবদ্ধ গ্রাম’, অপর পক্ষে বাংলাদেশের গ্রাম ছিল উন্মুক্ত। আর এ বইয়ের অনিবার্য উপসংহারে আকবর আলি খানের মূল বক্তব্য হলো, বাংলাদেশ অঞ্চলের গ্রামীণ বসতিতে সামাজিক পুঁজির প্রভূত ঘাটতি রয়েছে এবং এই ঘাটতি প্রভাবিত করেছে এ দেশের ইতিহাসকে। আকবর আলি খান: লেখালেখির জায়গা–জমিন বইটির ‘আকবর আলি খানের উন্নয়নচিন্তা ও ইতিহাস–ভাবনা’ অধ্যায়ে এই বই নিয়ে বিশদ আলোচনা আছে।

বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায় ‘আকবর আলি খানের স্বদেশ–অন্বেষণ’–এ বাংলায় ইসলামের প্রসার নিয়ে রয়েছে বিভিন্ন মতামত। মূলত আকবর আলি খানের বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য: একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ বইয়ে তিনি এ বিষয় খোলাসা করেছেন। রিচার্ড ম্যাক্সওয়েল ইটন তাঁর বই দ্য রাইজ অব ইসলাম অ্যান্ড দ্য বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার বইয়ে যে তত্ত্ব দিয়েছেন, সেই তত্ত্বকে সূত্র হিসেবে বিবেচনা করে এবং অসীম রায়ের সমন্বয়বাদী তত্ত্বকে প্রশ্ন করে নিজের বইয়ে আকবর আলি খান বিভিন্ন তথ্য–উপাত্ত দিয়ে দেখিয়েছেন, ‘১৮৭২ সালে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের জনসংখ্যার ঘনত্ব সম্পর্কে যে তথ্য জানা যায়, তা পশ্চিমবঙ্গের মৃতপ্রায় বদ্বীপ হতে বড় ধরনের অভিবাসন হয়েছে, এ ধরনের অনুমান আদৌ সমর্থন করে না।’

তৃতীয় অধ্যায় ‘বিচিত্র জ্ঞানপথের পরিব্রাজক আকবর আলি খান’। এ অধ্যায়ে যে তিনটি প্রধান সমস্যা, যা তাঁকে সব সময় তাড়া করত, তা নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে এভাবে—১. বাংলাদেশ ও এ দেশের জাতিগত আলাদা ও সুস্পষ্ট পরিচিতি; ২. আমাদের দারিদ্র্য; ৩. আমাদের অব্যবস্থাপনা। এই তিন বিষয়কে উপজীব্য করে তিনি বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন, যেমন পরার্থপরতার অর্থনীতি, ফ্রেন্ডলি ফায়ারস, হামটি ডামটি ডিজঅর্ডার অ্যান্ড আদার এইসে, গ্রাহাম’স ল সিনড্রোম অ্যান্ড বিয়ন্ড, আজব ও জবর আজব অর্থনীতি, বাংলাদেশ: বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি, বাংলাদেশে বাজেট: অর্থনীতি ও রাজনীতি ইত্যাদি। এই অধ্যায়ে প্রতিটি বই ঘিরে আলাদা আলাদাভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

এবং চতুর্থ অধ্যায় ‘অন্বেষিত দেশের মুক্তির লড়াইয়ে আকবর আলি খান’–এ আকবর আলি খানের আত্মজীবনী পুরানো সেই দিনের কথা নিয়ে বিশ্লেষণ রয়েছে। এই বইটি যেমন স্বাধীনতাযুদ্ধের সংঘটন ও সংগঠন সম্পর্কে জানার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নতুন মধ্যবিত্তের জাগরণ ও বিকাশ, তখনকার রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক অবস্থা সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যাবে। এই বইকে লেখক আমিনুল ইসলাম ভুইয়া বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করেছেন।

শেষে যুক্ত হয়েছে ‘আকবর আলি খানের লেখাজোখার তালিকা’ নামে একটি অধ্যায়। এখানে তাঁর সামগ্রিক লেখালেখি ও বইপত্রের তালিকা রয়েছে।

আকবর আলি খান: লেখালেখির 

জায়গা–জমিন

আমিনুল ইসলাম ভুইয়া

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: আগস্ট ২০২৩, প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল,

১২০ পৃষ্ঠা, দাম: ৩২০ টাকা।

বইটি পাওয়া যাচ্ছে

prothoma.com এবং মানসম্মত বইয়ের দোকানে।

বইটি নিবিড়ভাবে পড়লে পাঠক আকবর আলি খানের সব বই সম্পর্কে ধারণা যেমন পাবেন, একইভাবে বুঝতে পারবেন তাঁর মানসগঠন সম্বন্ধেও। এটি পড়ার পর আকবর আলি খানের অন্যান্য বই পড়তেও আগ্রহী হয়ে উঠতে পারেন অনেকেই। সব মিলিয়ে বলা যায়, লেখক আকবর আলি খানকে বোঝার জন্য বইটি খুব কার্যকর। বইয়ের ব্যাককভারের লেখাটি দিয়ে শেষ করি, ‘আকবর আলি খানের বিপুল বিচিত্র রচনা ও চিন্তাজগতের সামগ্রিক খতিয়ান এক মলাটে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীর লেখায়।’