১০০ পৃষ্ঠার কম মুক্তিযুদ্ধের পাঁচ অনবদ্য উপন্যাস

এই ক্ষুদ্র কলেবরের আখ্যানগুলো পাঠককে কোনো বিস্তৃত যুদ্ধগাথার ভার না চাপিয়ে, একটি বিশেষ মুহূর্তের কিংবা নির্দিষ্ট চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক সংকটের গভীরে প্রবেশ করতে সাহায্য করে।

প্রতিকৃতি ও অলংকরণ: মাসুক হেলাল। গ্রাফিকস: প্রথম আলো

দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গভীর তাৎপর্যবাহী ঘটনা। এই বিশাল প্রেক্ষাপটকে সামগ্রিকভাবে উপলব্ধির জন্য বৃহৎ পরিসরের উপন্যাসের পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের উপন্যাসগুলোর পাঠও অপরিহার্য।

এই ক্ষুদ্র কলেবরের আখ্যানগুলো পাঠককে কোনো বিস্তৃত যুদ্ধগাথার ভার না চাপিয়ে, একটি বিশেষ মুহূর্তের কিংবা নির্দিষ্ট চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক সংকটের গভীরে প্রবেশ করতে সাহায্য করে। ফলস্বরূপ, এক দিনে বা এক বসায় এই উপন্যাসসমূহ পাঠ করে মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা, মানবিক বিপর্যয়, সাধারণ মানুষের টিকে থাকার সংগ্রাম এবং আত্মত্যাগ; এই সবকিছুর মর্ম সহজে উপলব্ধি করা সম্ভব হয়।

নিচে মুক্তিযুদ্ধের ওপর ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে আলো ফেলা পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাসের প্রসঙ্গ উত্থাপন করা হলো, যা চাইলে আপনার পাঠতালিকায় রাখা যেতে পারে।

১. জাহান্নম হইতে বিদায় (১৯৭১)

শওকত ওসমান (১৯১৭–১৯৯৮)

বাংলাদেশের উপন্যাসের বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকগত নিরীক্ষায় সবচেয়ে উৎসাহী লেখক হিসেবে পরিচিত শওকত ওসমান (১৯১৭–১৯৯৮) তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রচনা করেন মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাস ‘জাহান্নম হইতে বিদায়’। এটি কলকাতার মুক্তধারা থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি ৮৯ পৃষ্ঠার ছোট কলেবরের হলেও এর কাহিনি মানব হৃদয়ে গভীর প্রভাববিস্তারী। বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণে মাতৃভূমি যখন আক্ষরিক অর্থেই ‘জাহান্নম’ হয়ে ওঠে, তখন প্রবীণ শিক্ষক গাজী রহমান নামক মূল চরিত্রের ঢাকা থেকে সীমান্তের দিকে হেঁটে যাওয়ার এক সরল আখ্যান এই উপন্যাস। এর মধ্য দিয়ে লেখক কেবল গণহত্যা (অপারেশন সার্চলাইট) ও শরণার্থীর স্রোতের মতো ঐতিহাসিক সত্যই তুলে ধরেননি, বরং ফুটিয়ে তুলেছেন মধ্যবিত্ত বাঙালির মানসিক দ্বন্দ্ব; সবুজ মাতৃভূমি ছেড়ে পালাবেন নাকি মাটি আঁকড়ে থাকবেন।

উপন্যাসের কাহিনি একদম হঠাৎ করেই কথোপকথনের মাধ্যমে শুরু হয়, যেমন ‘এখন কী করবেন, স্যার?’ ‘তা-ই ভাবছি।’ এই সরল সূচনাতেই পাঠককে দ্রুত কাহিনির কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়। সাত খণ্ডে বিভক্ত এই উপন্যাসে গাজী রহমানের চরিত্র কোনো নির্দ্বন্দ্ব ছিল না; বরং তার মাঝে পলায়নপরতা ও আত্মরক্ষার প্রবণতা সর্বদা ক্রিয়াশীল ছিল, যা সেই সময়ের আক্রান্ত অসহায় মানুষেরই প্রতিচ্ছবি। উপন্যাসের নামকরণের সার্থকতা মেলে তার নিজেরই উক্তিতে, যেখানে তিনি নৌকার মাঝিকে বলছেন, যুদ্ধের ভয়াবহতা বোঝাতে: ‘জোরে চালাও, আরও জোরে, জোরে চালাও, তোমার নৌকা হাঁটে না কেন?… দেখছ না চারিদিকে দোজখ। অগ্নিকুণ্ড দাউ দাউ জ্বলছে…এই নরক থেকে আমি বাইরে যেতে চাই…।’

শওকত ওসমান শব্দ চয়ন ও ভাষা প্রয়োগে মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন, যেমন প্রাকৃতিক দৃশ্যও যেন সেই সময়ে বেদনাহত: ‘নদীর টলটলে জলের ওপর ভাসতে ভাসতে দুই চোখ লংস্পটে ছড়িয়ে দিলে যদ্দুর তাকাও, বাংলাদেশের আকাশ, হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে।’ এই উপন্যাসটি অপরাপর লেখা থেকে ভিন্নতার দাবি রাখে; কারণ এখানে রাজনৈতিক ইতিহাস নয়, বরং ব্যক্তিগত অনুভূতি ও দুর্বিষহ অবস্থা বর্ণনা করাই ছিল মুখ্য। তাই মুক্তিকামী বাঙালির স্বাধীনতাসংগ্রামের দিনগুলোর মনস্তাত্ত্বিক সংকট ও পলায়নপর জীবনের দৃশ্যপট চিত্রায়ণে এই উপন্যাস ভিন্ন এবং একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যে এক অনন্য নিদর্শন।

২. নিষিদ্ধ লোবান (১৯৮১)

সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫–২০১৬)

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের (১৯৩৫–২০১৬) ‘নিষিদ্ধ লোবান’ (১৯৮১) মুক্তিযুদ্ধের ওপর রচিত একটি উল্লেখযোগ্য মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। এই উপন্যাস মাত্র ৭১ পৃষ্ঠার ক্ষুদ্র পরিসরে বৃহৎ এক যুদ্ধের বিস্তৃত আখ্যান তুলে ধরে। এই উপন্যাসের ছায়া অবলম্বনে নাসির উদ্দীন ইউসুফ পরিচালিত ‘গেরিলা’ চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয় ২০১১ সালে। প্রচলিত বিজয়গাথার পরিবর্তে একাত্তরের চলমান ভয়াবহতা ও অনিশ্চয়তার মাঝে সাধারণ মানুষের টিকে থাকার সংগ্রামকে তুলে ধরতেই শামসুল হক এ উপন্যাসটি লিখেছিলেন।

২৫ মার্চের পর থেকে এ দেশে যে মৃত্যু ও বিভীষিকার রাজত্ব শুরু হয় এবং সাধারণ মানুষ জীবনের মৌলিক নিশ্চয়তা হারায়, তা একান্তই বাস্তব। কেন্দ্রীয় চরিত্র বিলকিস, যার স্বামী আলতাফ নিখোঁজ। সে সধবা না বিধবা, এই অস্তিত্বসংকটে ভোগা সত্ত্বেও শুধু পারিবারিক টানে গ্রামের বাড়ি জলেশ্বরীর দিকে এক অনিশ্চিত যাত্রা শুরু করে। নবগ্রামে ট্রেন থেমে যাওয়ায় এবং এরপর কিশোর সিরাজকে সঙ্গী হিসেবে পাওয়া তার কণ্টকাকীর্ণ যাত্রার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিলকিসের মতো একজন শহুরে রমণী, যে কখনো চিতা দেখেনি, সে যেভাবে হাল না ছাড়ার মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ চালিয়ে যায় এবং সিরাজের সঙ্গে কাজ সম্পূর্ণ করার পরিকল্পনা করে, তা তার চরিত্রের অদম্য সাহসিকতাকে সাবলীলভাবে ফুটিয়ে তোলে। সিরাজ চরিত্রটি সেই সময়ের ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মানবিকতা এবং বিচক্ষণতার প্রতীক।

লেখক সহজ ভাষায় গভীর বোধ জাগিয়ে তোলেন, যেখানে তিনি বোঝান, কেবল সশস্ত্র যুদ্ধই নয়, বিলকিসের মতো হাজারো নারীর জীবনের প্রতি অবিচল প্রত্যাশা ও সংগ্রাম স্বাধীনতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। উপন্যাসের মর্মকথা—‘আঘাতপ্রাপ্ত সত্তা জাতিস্মরে পরিণত হয়। প্রজ্বলিত হয় মশালের মতো’—প্রমাণ করে, ব্যক্তিগত বেদনা ছাপিয়ে সেই সময়ে মানুষ কীভাবে জাতীয় চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়েছিল। এই কারণে, ‘নিষিদ্ধ লোবান’ মুক্তিযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কেবল বীরত্বের নয়, বরং সাধারণ মানুষের সংগ্রাম ও দেশপ্রেমের মর্ম উপলব্ধির এক অপরিহার্য সহায়িকা হওয়ার যোগ্য।

৩. অবেলায় অসময় (১৯৭৪)

আমজাদ হোসেন (১৯৪২–২০১৮)

চলচ্চিত্রকার হিসেবে অধিক পরিচিত হলেও আমজাদ হোসেনের (১৯৪২–২০১৮) রচিত মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হলো ‘অবেলায় অসময়’। মাত্র ৭০ পৃষ্ঠার এই পকেটসাইজ আখ্যানটি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের শিকার হয়ে কোটি মানুষের ভারতে আশ্রয় নেওয়ার ঐতিহাসিক সত্যকে ধারণ করে।

এর কাহিনি আবর্তিত হয়েছে হরিরামপুর গ্রাম থেকে প্রাণ বাঁচাতে আলী মাঝির ‘গয়না নৌকা’য় চেপে গন্তব্যহীন সীমান্তের দিকে যাত্রা করা কিছু হতভাগ্য মানুষের ছয় দিনের যাত্রাপথকে কেন্দ্র করে। গ্রাম পুড়ছে, আর সেই আগুনের যন্ত্রণা যেন নৌকার ভেতরে ঠাসাঠাসি করে থাকা উদ্বাস্তু মানুষগুলোর হৃদয়েও দাউ দাউ করে জ্বলছে।

লেখকের চিত্রনাট্য লেখার শিল্প দক্ষতায় সৃষ্টি হওয়া এই আখ্যানে প্রতিটি চরিত্রই যুদ্ধের শিকার হওয়া মানবিক সংকটের প্রতীক। বিশেষত নবদম্পতি কাশেম ও সাকিনার মর্মান্তিক পরিণতি পাঠককে গভীরভাবে নাড়া দেয়; পঞ্চম দিনে সাকিনার মৃত্যুর পর কাশেম তাকে বুকে জড়িয়ে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত দুজনের সলিলসমাধি হয়, যা চরম ট্র্যাজেডিকে তুলে ধরে। এ ছাড়া দেশভাগের শিকার পচা মিয়ার মতো চরিত্র পুনর্বার বাস্তুচ্যুতির নিয়তিকে তুলে ধরে। যুদ্ধকালীন শরণার্থীজীবনের ‘নিদারুণ কষ্টের আখ্যান’ হিসেবে এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য, কারণ এটি রণাঙ্গনের বাইরে থাকা সাধারণ মানুষের ‘অস্তিত্বের লড়াই’ ও গভীর মানবিক বিপর্যয়ের এক ‘নিটোল ও গোছানো অনন্যসাধারণ’ চিত্রায়ণ। উপন্যাসটি শরণার্থীজীবনের প্রতিটি ক্ষুদ্র কষ্ট, আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তার অনুভূতিকে অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে ধরে রেখেছে। তাই যেখানে সম্মুখযুদ্ধের হুংকার নেই, কেবলই টিকে থাকার নীরব আর্তনাদ, সেই প্রেক্ষাপটে এই উপন্যাস মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যের এক শক্তিশালী সংযোজন।

৪. জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা (১৯৮৭)

শহীদুল জহির (১৯৫৩–২০০৮)

ঐন্দ্রজালিক কথাকোবিদ হিসেবে পরিচিত শহীদুল জহির (১৯৫৩–২০০৮) তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ (১৯৮৭) রচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে এক স্বতন্ত্র স্থান অধিকার করেন। উপন্যাসটি পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের শ্যামাপ্রসাদ চৌধুরী লেনের একটি মহল্লাকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধ ও তৎপরবর্তী পনেরো বছরের জীবন-বাস্তবতার প্রতীকাভাসে বয়ন করা হয়েছে। মাত্র ৬৪ পৃষ্ঠার এই রচনায় মহল্লাটির সমাজ-কাঠামোর কেন্দ্রে অবস্থান করে রাজাকার বদু মাওলানা এবং প্রান্তে থাকে মহল্লাবাসী সাধারণ জনতা। এই ক্ষমতা-সম্পর্কে বদু ‘উচ্চবর্গ’ এবং মহল্লাবাসীকে ‘নিম্নবর্গ’ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষশক্তি-বিপক্ষশক্তির মৌল যুগ্ম-বৈপরীত্যেই উপন্যাসের ক্ষমতাকেন্দ্রিক দ্বান্দ্বিকতার বিস্তার ঘটেছে।

যুদ্ধপূর্ব সময়ে মহল্লার ক্ষমতা-কাঠামোতে বদু মাওলানারা সমাসীন ছিল না। কিশোর আলাউদ্দিনের ঔদ্ধত্য কিংবা মোমেনার সংগীতচর্চা ও অসাম্প্রদায়িক জীবনচর্যার বিরুদ্ধে সে কেবল অশ্লীল কটূক্তি করা ছাড়া কোনো ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয়নি। তবে যুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানি মিলিটারির সাহায্যকারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বদু রাতারাতি মহল্লার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে। যুদ্ধের এই নয় মাস সে সম্পূর্ণত বল প্রয়োগ ও দমন-পীড়নের মাধ্যমে অর্জিত প্রভুত্ববাদী ক্ষমতা চর্চা করেছে। তার ক্ষমতার প্রতিস্পর্ধী হয়ে ওঠা কিশোর আলাউদ্দিন, খাজা আহমেদ আলী, খাজা শফিক, আবু করিমের বড় ছেলে, ইসমাইল হাজাম এবং মোমেনার মতো মহল্লাবাসীরা তার রোষের শিকার হয়।

যুদ্ধে পরাজয়ের পর আত্মগোপনে থাকা বদু মাওলানা ১৯৭৩ সালে সাধারণ ক্ষমার পর মহল্লায় প্রত্যাবর্তন করে। সে সময় তার ভূতপূর্ব প্রভুত্ববাদী ক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে হৃত ছিল। তাই এবার সে বিনীত আচরণ ও লেবাসের মাধ্যমে মহল্লাবাসীর সম্মতি আদায় করে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় অধিক সচেষ্ট হয়। মহল্লার ক্ষমতাকেন্দ্রে পুনঃ প্রবেশের জন্য সে আজিজ পাঠানের কাছ থেকে বৈধতা সংগ্রহ করে এবং নিজের ছেলেকে দিয়ে জনগণকে ‘ভাইসব’ বলে সম্বোধন করায়। এই সময়ে সে যুদ্ধকালীন নিজের ভূমিকাকে এক মহৎ-কীর্তি হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করে, কিন্তু যুদ্ধোত্তরকালেও বদু মাওলানা মহল্লাবাসীর ওপর তার মতাদর্শগত সম্মতি বা আধিপত্য কখনোই লাভ করতে সক্ষম হয়নি। তার এই কৃত্রিম সমবেদনা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে এবং একাত্তর সালে তার প্রতি জন্ম নেওয়া প্রবল অবিশ্বাস ও ঘৃণা আর কখনোই খণ্ডানো সম্ভব হয়নি।

৫. ১৯৭১ (১৯৮৬)

হুমায়ূন আহমেদ (১৯৪৮–২০১২)

বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম লেখক হুমায়ূন আহমেদ (১৯৪৮–২০১২); যিনি ১৯৭১ নামক ৯৬ পাতার এক উপন্যাসে ভিন্ন আঙ্গিকে তুলে ধরেছেন মুক্তিযুদ্ধের অপ্রিয় বাস্তবতা। একাত্তরের অদ্ভুত সময়টাকে ছোট পরিসরে বন্দী করার দিক থেকে এটি তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ। এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য হলো ১৯৭১ সালের ১ মে নীলগঞ্জ গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকারের দল কর্তৃক চালানো নৃশংসতা ও বাঙালিদের প্রতি তাদের চরম ঘৃণা। কোনো মুক্তিযোদ্ধার চরিত্র বা সম্মুখযুদ্ধের বিবরণ নেই।

উপন্যাসের কাহিনিসংক্ষেপে দেখা যায়, নীলগঞ্জ গ্রামের স্কুলে আস্তানা গেড়ে হানাদার বাহিনী গ্রামের নিরীহ শিক্ষক আজিজ মাস্টার, মসজিদের ইমামসহ কয়েকজনকে আটকে রাখে। পাশের জেলে এলাকায় লুকিয়ে থাকা মুক্তিবাহিনীর খবর বের করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। সারা দিন ধরে তারা নিরীহ বন্দীদের ওপর অমানুষিক, বর্ণনাতীত পাশবিক নির্যাতন চালায় এবং একই সঙ্গে গ্রামজুড়ে নারীদের লাঞ্ছিত করে, বাড়িঘরে আগুন দেয়। এমনকি তাদের অত্যাচার থেকে গ্রামের পাগলও রেহায় পায়নি। রাতে মুক্তিবাহিনীর লুকিয়ে থাকার জায়গায় হামলা করতে যাওয়ার আগে বন্দীদের ধরে পাশের জলাধারে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মারে; শেষে মরার ভয়ে একজন বন্দী মুক্তিবাহিনীর লুকিয়ে থাকার জায়গায় ইঙ্গিত দেয়। এভাবেই শেষ হয় গ্রামের ওপর চালানো সেই তাণ্ডব।

এই উপন্যাসে ঐতিহাসিক সত্য ফুটে ওঠে দখলদার বাহিনীর নির্মম গণহত্যা ও জাতিগত অবজ্ঞার মাধ্যমে। সামরিক কর্মকর্তাদের মন্তব্যে তাদের ঔপনিবেশিক মানসিকতা ও চরম অবজ্ঞা প্রকাশ পায়, যেমন মেজর এজাজ একজন বাঙালি মুসলিমকে বলেন, ‘তোমরা মাত্র পঁচিশ ভাগ মুসলমান, বাকি পঁচাত্তর ভাগ হিন্দু।’ এবং আরও বলেন, ‘বাঙালিদের মান-অপমানের বলে কিছু নেই। একটা কুকুরেরও আত্মসম্মান থাকে, এদের তা–ও নেই।’

এই বক্তব্যগুলোই প্রমাণ করে, হানাদাররা বাঙালিকে মানুষ নয়, শোষণের পাত্র মনে করত। নিরীহ শিক্ষক ও ইমামের মতো চরিত্রগুলো ছিল সেই সময়ের অসহায় সাধারণ মানুষের প্রতীক, যাদের মান-অপমান বলে কিছু নেই বলেই মনে করত দখলদার বাহিনী। আঞ্চলিক ভাষার সুনিপুণ ব্যবহার এর আঙ্গিকগত বৈশিষ্ট্য, যার উদাহরণ: ‘নান্দাইল রোড থেকে রুয়াইল বাজার আসতে বেলা পুইয়ে যায়’—প্রমিত ভাষার সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষার এই সংমিশ্রণ আখ্যানটিকে এক বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। সব মিলিয়ে, ‘১৯৭১’ মুক্তিযুদ্ধের কেবল গৌরবগাথা নয়, বরং এর পেছনের সংগ্রাম, বর্বরতা এবং ঔপনিবেশিক ঘৃণা উন্মোচনের ক্ষেত্রে এক সার্থক ও ব্যতিক্রমী সাহিত্যিক দলিল।