‘জ্ঞানতাপস’ বলে বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রে যেসব বিদ্বান ব্যক্তিকে আমরা আজতক সম্বোধন আর স্মরণ করি, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বিশ শতকের প্রথমার্ধে ঢাকা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে পূর্ব বাংলায় যে আলাদা জ্ঞানজগৎ নির্মিত হয়েছিল, সেই আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বেও ছিলেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি তাঁর নিজের জ্ঞানতাত্ত্বিক কর্মকাণ্ড ও সক্রিয়তায় তার প্রমাণ নিজেই দিয়েছিলেন। তাঁর নিজের গবেষণা আর লেখাজোখার ভেতর দিয়ে একই সঙ্গে তিনি বিষয়টির সমৃদ্ধি ও শক্তিশালীকরণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এসব গবেষণা আর লেখাজোখার প্রায় সবটাই প্রকাশিত হয়েছে, নানা সময়ে নানাভাবে। তবে এখনো তার সম্পূর্ণতা সম্পন্ন হয়নি, তা বলার মতো যথেষ্ট প্রমাণ হাতে রয়েছে। এই সক্রিয়তার কালে তিনি নানা সময় নানাজনকে চিঠি লিখেছিলেন এবং তাঁকেও নানাজন চিঠি লিখেছিলেন। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত তাঁর রচনাবলির পাশাপাশি নানা জায়গা থেকে শহীদুল্লাহর চিঠি প্রকাশিত হয়েছে। তবে আগে প্রকাশিত হয়নি এমন আরও বেশ কিছু চিঠি নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ: অগ্রন্থিত চিঠিপত্র শিরোনামের গ্রন্থটি। বইটি সম্পাদনা করেছেন আনিসুর রহমান আর এখানে মনোজ্ঞ একটি ভূমিকা লিখেছেন মোরশেদ শফিউল হাসান। ভূমিকায় এই বিষয়ে বলা হচ্ছে, ‘বর্তমান পুস্তকে আমরা চেষ্টা করেছি ইতিপূর্বে গ্রন্থিত সেসব চিঠি না রাখতে।’
১৯২৬ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত অগ্রন্থিত চিঠি নিয়ে এই বই। দুই রকম চিঠি পাওয়া যাবে এখানে। তাঁকে লেখা হয়েছে এমন চিঠি আর তিনি লিখেছেন এমন চিঠি। চিঠিগুলোর প্রাপক ও প্রেরকের তালিকায় আছেন কালজয়ী সব ব্যক্তি—কায়কোবাদ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দীনেশচন্দ্র সেন, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, মোহিতলাল মজুমদার, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, কাজী আবদুল ওদুদ, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, গোলাম মোস্তফা, আব্বাসউদ্দীন আহমদ থেকে শুরু করে আবুল ফজল, অন্নদাশঙ্কর রায়, আশুতোষ ভট্টাচার্য, মুহাম্মদ আবদুল হাই, সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখ। শহীদুল্লাহর ব্যক্তিজীবনের বিচিত্র ঘটনাবলি একত্র হয়েছে এই চিঠিপত্রের একাংশের ভেতর। বিশেষত প্রবাসজীবনে যখন তিনি গবেষণায় ব্যাপৃত ছিলেন, সেই সময়ের চিঠিগুলোয় সেই বিশ শতকের খণ্ডমুহূর্তের সাপেক্ষে তখনকার জ্ঞানের পরিকাঠামো খুঁজে পাওয়া যায়। আবার পরিবার ও পরিচিতজনের কাছে লেখা চিঠিগুলো শহীদুল্লাহর ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে জানার জন্য সবিশেষ; এবং এই সময়কালে প্রশাসনিক বিষয়আশয় নিয়ে লেখা চিঠিগুলোর গুরুত্বও অপরিসীম। বলা ভালো, এই দুই ধারার চিঠি দেশভাগের পূর্ব ও পরবর্তীÑদুই সময়েই রয়েছে।
সুপ্রাচীনকাল থেকেই নানা কারণে পিছিয়ে থেকেছে পূর্ব বাংলা। বিষয়টি এই অঞ্চলের মানুষের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দিক থেকে উন্নতি সাধনের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষা ও জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিসরের অনগ্রসরতা ছিল এর অন্যতম। কিন্তু বিষয়টি কেবল এই অঞ্চলের মানুষের ভেতরে-ভেতরে নির্মিত হয়েছিল, বিষয়টি এমন নয়। বরং বিষয়টি সামাজিক ও রাষ্ট্রিক নানা কৌশল-সৃষ্ট সংকটের ভেতর দিয়েই তৈরি হয়েছিল। বইয়ের অনেক চিঠিতে পূর্ব বাংলার এই অনগ্রসরতার বিপরীতে শহীদুল্লাহর ভূমিকা ছিল সবিশেষ, এ–বিষয়ক চিঠিগুলোয় তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
বইয়ের চিঠিগুলো সাল-তারিখের ক্রম অনুযায়ী সাজানো। তাই শহীদুল্লাহর জীবনের নানা ঘটনার ধারাবাহিকতা সম্পর্কে যেমন ধারণা পাওয়া যায়, তেমনি সেই সময়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহাসিক পরম্পরা সম্পর্কেও জানা যায়, যা যুগপৎভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া সামগ্রিকভাবে চিঠিগুলোয় অবিভক্ত বাংলা ও দেশভাগের পরও বাংলা অঞ্চলের জ্ঞানচর্চার একটি সমন্বিত রূপের বিষয়-ধারণা প্রকাশিত হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, সে সময় এই পুরো অঞ্চলে শহীদুল্লাহর গুরুত্ব কতখানি ছিল, তা উপলব্ধি করা যায় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে যেসব চিঠি লিখেছিলেন, তা আমলে নিলে। পাশাপাশি সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে শহীদুল্লাহর ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও যে তাঁদের ভেতর একটি হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল, বেশ কিছু চিঠি সে বিষয়ই ধারণ করে আছে।
পরিশেষে বইটির কিছু সংকট নিয়ে কথা বলা জরুরি। বিশেষ করে যে যুগের গুরুত্বপূর্ণ মানুষজনের সঙ্গে মুহম্মদ শহীদুল্লাহর যোগাযোগ ছিল এবং চিঠির মাধ্যমে তাঁর যোগাযোগ হয়েছিল, তাঁরা কিন্তু এ সময়ের গড় পাঠকের কাছে পরিচিত নন। ফলে তাঁদের সম্পর্কে আলাদাভাবে টীকা কিংবা পরিশিষ্ট অংশের নির্মাণ বিষয়টি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারতো। কিন্তু তা হয়নি।
আর পুরোনো সময়ের ইংরেজি বলে কেবল নয়, নতুন সময়ের ইংরেজি বোঝার বিষয়েও অন্য ভাষার মানুষের একটি সংকট থেকে যায়। আর চিঠিপত্রের ভাষা হয় আরও সংকটপূর্ণ, অন্তত এর গঠনগত দিক বিবেচনায়। ফলে বইটিতে ইংরেজি চিঠিগুলোর অনুবাদ করে দিতে পারলে সেটি যেকোনো শ্রেণির পাঠকের জন্য হতো সহজসাধ্য আর সর্বজনীন। সহজেই সবাই-ই চিঠিগুলোর মর্মার্থ অনুধাবন করতে পারত। এই দু-একটি সংকট বাদে সামগ্রিকভাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, সর্বোপরি বাংলাভাষী বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস নির্মাণের বিষয়-উপাদান হিসেবে বইয়ে অন্তর্ভুক্ত চিঠিগুলোর মূল্য অপরিসীম।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ: অগ্রন্থিত চিঠিপত্র, তাঁর লেখা, তাঁকে লেখা
সংকলক ও সম্পাদক:
আনিসুর রহমান
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা; প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০২৫; প্রচ্ছদ: আনিসুজ্জামান সোহেল; ১৭৪ পৃষ্ঠা; দাম: ৪৭০ টাকা।
বই টি পাওয়া যাচ্ছে: prothoma.com এবং মানসম্মত বইয়ের দোকানে