যে বইয়ে আছে দেশের সাহিত্যজগতের ঘরোয়া অধ্যায়

সদ্য কলেজ পেরোনো এক যুবক। মাথাভর্তি একরাশ অগোছালো শব্দ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বুয়েট, শহীদ মিনার আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। কোথাও কোনো কবিতা উৎসব, আবৃত্তি, সাহিত্য আলোচনা হচ্ছে দেখলেই টুপ করে ঢুকে কৌতূহলী কিশোরের মতো মন্ত্রমুগ্ধতা নিয়ে শুনছেন সবার কথা! এভাবে শুনতে শুনতেই অগোছালো শব্দগুচ্ছকে গুছিয়ে এনে লিখে ফেললেন একটি কবিতা। ইত্তেফাক-এর রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই সেটি ছাপলেন তাঁর পত্রিকায়। সেই থেকে যাত্রা শুরু। কবিতা লেখা বা কবিতার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণেই সেই সময়ের বিখ্যাত সব কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে নানা মিথস্ক্রিয়ার স্মৃতি তিনি ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন প্রথম আলো ‘অন্য আলো’তে। সেসব স্মৃতিকথার সংকলন লেখক-সঙ্গ স্মৃতি আনন্দ।

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০২৩, প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা, ২৬৪ পৃষ্ঠা, দাম: ৫৮০ টাকা। 

বইটি পাওয়া যাচ্ছে

prothoma.com এবং মানসম্মত বইয়ের দোকানে।

পশ্চিমবঙ্গে আমরা প্রায়ই দেখি, সম্পাদক ও প্রকাশকেরা সাহিত্যিকদের সঙ্গে তাঁদের মিথস্ক্রিয়ার বিচিত্র গল্প নিয়ে বই লেখেন। সাগরময় ঘোষ বা বাদল বসুর কথা এ ক্ষেত্রে বলা যায়। তবে পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশের সাহিত্যে এমন নজির সম্ভবত আনিসুল হকের লেখা লেখক-সঙ্গ স্মৃতি আনন্দ প্রথম। তরুণ বয়স থেকেই বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত ও প্রবাদপ্রতিম কবি–সাহিত্যিকদের স্নেহ-ভালোবাসা পাওয়া পরম সৌভাগ্যের বিষয়। আনিসুল হক নিজ গুণে তা অর্জন করেছেন। তিনি কবি হতে চেয়েছিলেন। কবি হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই একদা রংপুর থেকে এসেছিলেন ঢাকা শহরে। বুয়েটে ভর্তি হলেও কবিতাই ছিল তাঁর আরাধ্য। ‘কবিতার কামড়ে অস্থির যুবা’—বুদ্ধদেব বসুর এই উক্তি যেন যথার্থভাবেই মিলে যায় বুয়েটপড়ুয়া কবিতাপ্রেমী আনিসুল হকের সঙ্গে। কবিতা ও লেখালেখির প্রতি তীব্র টানেই কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশেছেন এই লেখক। বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার সঙ্গে সম্পৃক্ততা তাঁর জন্য এই পথকে হয়তোবা আরেকটু সহজ করেছে। কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ, মহাদেব সাহা থেকে শুরু করে সাহিত্যিক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, কথাশিল্পী রাবেয়া খাতুন, সেলিনা হোসেন, হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলনসহ আরও অনেক সমকালীন সাহিত্যিকদের কাছ থেকে দেখা এবং সেই ‘দেখা থেকে লেখা’ এই স্মৃতিকথার বই আগ্রহী পাঠকের জন্য সেই সাহিত্যিকদের জীবনের নানা আনন্দ-বেদনা, অভিজ্ঞতা ও রসবোধের এক অমূল্য চিত্রায়ণও বটে।

বইটিতে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের লেখায় উপমা ও বিশেষণের ব্যবহার নিয়ে দারুণ বিশ্লেষণ করেছেন আনিসুল হক। সাধারণ পাঠক হিসেবে আমরা হয়তো এভাবে কোনো দিনই ভাবতে পারতাম না। একজন সত্যিকারের সুলেখক হতে হলে শব্দের যথাযথ প্রয়োগ যে লেখার মান কতটা বাড়িয়ে দিতে পারে, তা এককথায় বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। সৈয়দ শামসুল হক বা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ যেমন বারবার বলতেন, ‘পড়ো’, একজন ভালো লেখক হতে গেলে পড়ার বিকল্প নেই; আনিসুল হকও তাঁর লেখার মাধ্যমে তরুণ লেখক ও পাঠকদের পড়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

বইয়ের শেষে অরুন্ধতী রায়ের সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে এসেছে লেখালেখি নিয়ে খুঁটিনাটি আরও অনেক বিষয়। বইটিতে নির্মলেন্দু গুণের রসিকতাবোধের বেশ কিছু মজার কাহিনি ছাড়াও তাঁর বেশ কয়েকটি কবিতা নিয়ে রয়েছে বিস্তর আলোচনা। শামসুর রাহমানের ‘একটি মোনাজাতের খসড়া’ কবিতা নিয়ে নতুন আঙ্গিকের আলোচনা পাঠকের সামনে তুলে আনা এখনকার সময়ের প্রেক্ষাপটে কতটা প্রাসঙ্গিক, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বলা ভালো, স্মৃতির সমান্তরালে প্রাসঙ্গিকভাবে এখানে এসেছে বিভিন্ন কবির কবিতা এবং সে-সংক্রান্ত আলোচনা, যা বইটিকে বেশ মনোগ্রাহী করে তুলেছে।

আনিসুল হকের সবচেয়ে বড় গুণ হলো, তিনি সমকালীন কোনো সাহিত্যিককেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতেন না। সবার কাছ থেকেই তিনি শিখেছেন—শুধু সাহিত্য নয়, জীবনের নানা পাঠ তিনি নিয়েছেন তাঁদের কাছ থেকে। আল মাহমুদ ও হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে ভুল–বোঝাবুঝির বিষয়টি তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন এখানে। তবে এ বইয়ে রয়েছে কি শুধু এটুকুই? নস্টালজিয়ার চাদরে মোড়ানো এই স্মৃতিকথায় আছে বাংলাদেশের প্রণম্য লেখকদের সাহিত্যের বিশ্লেষণসহ তাঁদের অন্দর-বাহিরের বিচিত্র প্রসঙ্গ। সব মিলিয়ে লেখক-সঙ্গ স্মৃতি আনন্দ বইটি যেমন সমকালীন লেখকদের প্রতি আনিসুল হকের সম্মান ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের রেখাচিত্র, তেমনি এখানে বিধৃত আছে বাংলাদেশের সাহিত্যজগতের অজানা কিছু ঘরোয়া অধ্যায়ও।