সীমাবদ্ধতা মেনেও সৎ যে আত্মকথন

আকবর আলি খান তাঁর আত্মজীবনীটির প্রায় শুরুতেই একটি কথা লিখেছেন, ‘প্রকৃতপক্ষে কোনো সৎ আত্মজীবনী নেই।’ এ প্রসঙ্গে তিনি আত্মজীবনী এবং তাঁর রচয়িতাদের প্রবণতা সম্পর্কে সাধারণভাবে কতগুলো কথা বলেছেন, যেমন ‘আত্মজীবনীর কতটুকু সত্য আর কতটুকু মিথ্যা, তা যাচাই করতে হলে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য জানতে হবে।’ এবং ‘আত্মজীবনীর লেখক সত্য কথা লিখতে চাইলেও সব সময় সত্য কথা লিখতে পারেন না।’ এই না পারার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি লিখেছেন, ‘সত্য জানা থাকলেও সব সময় সত্য লেখা যায় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আত্মজীবনীকারের কাছে ঘটনাবলি সম্পর্কে দলিল-দস্তাবেজ থাকে না। তাঁকে স্মৃতির ওপর নির্ভর করে লিখতে হয়। অনেক সময় স্মৃতি প্রতারণা করে, আবার সত্য লিখতে গিয়েও অনেকে সত্যের ওপর রং চাপিয়ে দেন। এর ফলে সত্য আর নির্ভেজাল সত্য থাকে না। অনেক আত্মজীবনীকার তাঁদের কর্মকাণ্ডের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করার জন্য লেখেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আত্মজীবনী লেখকেরা দুষ্কর্মের দায়িত্ব গ্রহণ করতে রাজি হন না। দুষ্কর্মের দায়িত্ব অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়।’ (‘পূর্বাভাস’)

উদ্ধৃত কথাগুলোর মধ্য দিয়ে আকবর আলি খান পাঠকদের আসলে যা স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন তা হলো, যেকোনো আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ পাঠ করতে গিয়ে আমাদের কিছু সতর্কতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। নিজস্ব বিচারবুদ্ধিকে সজাগ রাখতে হবে। আত্মজীবনীমূলক রচনার বর্ণিত সীমাবদ্ধতার কথা জানার পরও তিনি যে নিজে আত্মজীবনী লিখেছেন, তার যৌক্তিকতা হিসেবে তিনি তাঁর দিক থেকে তিনটি ‘বাধ্যবাধকতা’র কথা উল্লেখ করেছেন। প্রথমটি হলো তিনি তাঁর অকালপ্রয়াত কন্যাকে কথা দিয়েছিলেন যে তাঁদের বংশের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস তিনি লিখে রেখে যাবেন। কন্যার জীবদ্দশায় যে প্রতিশ্রুতি তিনি রক্ষা করতে পারেননি। আত্মজীবনী লেখার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তাঁর দ্বিতীয় বাধ্যবাধকতাটা ছিল গণমাধ্যমকর্মী বা তাঁদের মাধ্যমে আসলে সমগ্র জাতির কাছে। কেন বা কোন পরিস্থিতিতে তিনি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন, তা তিনি আত্মজীবনীতে লিখবেন বলে পদত্যাগের অব্যবহিত পরে সাংবাদিকদের কথা দিয়েছিলেন। আত্মজীবনী রচনার ব্যাপারে তৃতীয় তাগিদটা সম্পর্কে লেখকের বক্তব্য তাঁর নিজের ভাষাতেই তুলে ধরা যাক, ‘আমার কর্মজীবনের একটি বড় অংশ বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের জগতে অতিবাহিত হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের আত্মজীবনী পাঠ করে আমলাতন্ত্রে [য. প্রা.] বর্তমানে যেসব কর্মকর্তা কর্মরত আছেন, তাঁরা তাঁদের পূর্বতন কর্মকর্তারা সফল অথবা ব্যর্থ হয়েছেন, সে সম্পর্কে ধারণা করতে পারেন। অন্যান্য পেশায় আত্মজীবনী গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত না হলেও আমলাতন্ত্রে এর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।’

আত্মজীবনী পুরানো সেই দিনের কথায় আকবর আলি খান তাঁর প্রথম, অর্থাৎ কন্যাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতিটি বলা যায় পুরোপুরিই রক্ষা করতে পেরেছেন। ‘পিতৃপুরুষের শিকড়ের সন্ধান’ এবং ‘রসুল্লাবাদ খাঁ বাড়ির কুশীলব’ শিরোনামের দুটি অধ্যায়ে প্রায় ৭০ পৃষ্ঠাজুড়ে তিনি তাঁর নিজ ও স্ত্রীর পারিবারিক ইতিহাস বা বংশপরিচয় এবং পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে তথ্যাদি বিশদভাবে উপস্থাপন করেছেন। গ্রন্থের এ অংশ সাধারণ পাঠককে সেভাবে আকর্ষণ না–ও করতে পারে, হয়তো এই আশঙ্কা মাথায় রেখেই। তাঁর দ্বিতীয় ‘বাধ্যবাধকতা’র সঙ্গে পরিচিত হতে আমাদেরকে তাঁর আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খণ্ডের জন্য অপেক্ষা করতে হবে—এমন ধারণা দিয়েছেন। তৃতীয় বিষয়, অর্থাৎ তাঁর আমলাজীবনের স্মৃতিচারণাই আমাদের আলোচ্য গ্রন্থের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বা কৌতূহলোদ্দীপক অংশ। যদিও সে জীবনেরও একটা পর্যায় পর্যন্ত অভিজ্ঞতা তিনি এ বইয়ে লিপিবদ্ধ করেছেন। বাকিটা যে লিখতে পারেননি, তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘সরকারের উচ্চ পদে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা রাষ্ট্রের অনেক গোপন তথ্য জানেন।...সরকারের গোপনীয়তা রক্ষার জন্য আমার পক্ষে আত্মজীবনীতে সব তথ্য পরিবেশন করা সম্ভব হবে না।...১৯৭৩ সাল পর্যন্ত আমি নিম্ন পর্যায়ে সরকারের কর্মকর্তা ছিলাম। তাই এই সময়কালে সরকারি কাজের গোপনীয়তার বড় সমস্যা ছিল না। পরবর্তী পর্যায়ে আমি সরকারের অনেক উঁচু দায়িত্ব পালন করেছি। সে সময়ে গোপনীয়তার অনেক সমস্যা রয়েছে। এই সময়ের স্মৃতিকথা আমি দ্বিতীয় খণ্ডে লিপিবদ্ধ করব। দ্বিতীয় খণ্ডটি আমি লিখে রেখে যাব। দ্বিতীয় খণ্ডের লেখা শেষ হলে এটি কখন প্রকাশিত হবে, এ সম্পর্কেও নির্দেশনা দিয়ে যাব।’ পরিতাপের বিষয়, আমাদের সে প্রত্যাশা পূরণের সুযোগ মৃত্যু তাঁকে দিল না।

লেখকের জন্ম (১৯৪৪), শৈশবকাল, প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষাজীবন, সিএসএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি চাকরিতে যোগদান, পাকিস্তানের লাহোরে প্রশিক্ষণ গ্রহণ, তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অংশে বিভিন্ন পদে চাকরি ইত্যাদির বিস্তারিত ও অনুপুঙ্খ বিবরণ লেখক অত্যন্ত তথ্যনিষ্ঠভাবে এ বইয়ে তুলে ধরেছেন। শিক্ষা ও কর্মজীবনের নানা পর্বে কারা তাঁর সহপাঠী বা সহকর্মী ছিলেন, তাঁদের কে কোন পরীক্ষায় এমনকি কোন পত্রে কত নম্বর পেয়েছিলেন, তাঁর চেয়ে কে কত নম্বর বেশি বা কম পেয়েছেন, ভাইভা বোর্ডের সদস্য ছিলেন কারা, ব্যাচমেটদের মধ্যে কে পরবর্তী সময়ে কোথায় কর্মরত ছিলেন—এসব এবং প্রাসঙ্গিক অন্যান্য তথ্য যতটা সুনির্দিষ্টভাবে তিনি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠাজুড়ে দিয়ে গেছেন, তাতে চরম বিস্ময়ের সঙ্গে পাঠকমনে কৌতূহল জাগা স্বাভাবিক, লেখক কি এ ব্যাপারে শুধুই আপন স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভর করেছেন, নাকি দলিলপত্র, ব্যক্তি পর্যায়ে অনুসন্ধান ও অন্যান্য সূত্রের সহায়তাও তাঁকে নিতে হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন তিনি ছিলেন হবিগঞ্জের মহকুমা প্রশাসক। সে অবস্থায় তাঁর স্বাক্ষরেই ট্রেজারি খুলে এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অস্ত্র বিতরণ করা হয়। পরে তিনি সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যান এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। মুজিবনগর সরকারে তিনি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিবের দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধকালীন সরকারের একজন আমলা হিসেবে তাঁর নিজের ও কাছ থেকে দেখা ভালো–মন্দ অন্যান্য অভিজ্ঞতা তিনি অকপটেই এ বইয়ে তুলে ধরেছেন। ১৬ ডিসেম্বর দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর তাঁকে সিলেটের জেলা প্রশাসক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর সে পদে যোগদান করা হয়নি। এ সময়কার লেখকের কিছু কৌতূহলোদ্দীপক অভিজ্ঞতা, গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণও পাওয়া যাবে তাঁর এ আত্মজীবনীতে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি তাঁর যাত্রারম্ভেই কীভাবে স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ ও প্রশাসনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের পাকচক্রে পড়ে যায়, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে তার কিছু নমুনা আকবর আলি খান এ বইয়ে দিয়েছেন। ডিসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলে প্রথম দিনেই সরকারি দলের একজন মন্ত্রী পর্যায়ের নেতা (এককালের বামপন্থী রাজনীতির ঐতিহ্যানুসারী হিসেবে সুপরিচিত) যেভাবে তাঁর নিজ দলেরই স্থানীয় সংসদ সদস্যদের তালিকায় কিছু নামে টিক চিহ্ন আর কিছু নামে ক্রস চিহ্ন দিয়ে তাঁদেরকে যথাক্রমে তাঁর সমর্থক ও বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করে দেন এবং প্রথমোক্তদের সঙ্গে সহযোগিতা ও দ্বিতীয়দের বেলায় সতর্কতার নীতি অনুসরণ করতে বলেন, তা লেখককে কেবল হতবুদ্ধিই করেনি, ভবিষ্যতের জন্য তাঁর কাছে অশনিসংকেত হয়ে দেখা দিয়েছিল। লেখক চরিত্রদের নামোল্লেখ করেই এসব ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন।

১৯৫২ সালে সে সময়ের তরুণ নেতা শেখ মুজিব যখন শান্তি সম্মেলনে যোগদান উপলক্ষে চীন সফরে যান, তখন পিকিংয়ের (বর্তমান বেইজিং) পাকিস্তান দূতাবাসের একমাত্র বাঙালি কর্মকর্তা ছিলেন মাহাবুবুল আলম। যিনি ছিলেন মুজিবের পুরোনো বন্ধু, আইন ক্লাসে তাঁর সহপাঠী। বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং আমার দেখা নয়াচীন—এই দুটি গ্রন্থের একাধিক স্থানে চীনে থাকাকালীন ব্যক্তিগতভাবে তাঁর প্রতি বন্ধু মাহবুব ও তাঁর পত্নীর উষ্ণ আতিথেয়তা এবং যত্ন-আপ্যায়নের সকৃতজ্ঞ উল্লেখ করেছেন। আকবর আলি খানের এই আত্মজীবনী পাঠেই আমরা প্রথমবারের মতো জানতে পারি যে সেদিনের পিকিং দূতাবাসের সেই থার্ড সেক্রেটারি মাহাবুবুল আলমই পরবর্তীকালের বহুপরিচিত মাহবুবুল আলম চাষী। খন্দকার মোশতাকের বিশ্বস্ত হিসেবে বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যিনি জড়িত ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। অথচ বঙ্গবন্ধুর উল্লিখিত দুটি গ্রন্থের টীকা অংশে অনেক বাড়তি কথা থাকলেও সম্পাদকেরা এমনকি মাহবুবুল আলমের পরিচয় দিতে গিয়েও এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি যোগ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

ইতিমধ্যে আকবর আলি খানের এক বা একাধিক গ্রন্থ কিংবা অন্য রচনা পাঠের সুযোগ যাঁদের হয়েছে, তাঁর সাক্ষাৎকার-বিবৃতি কিংবা টিভি টক শোর সঙ্গে অল্পাধিক পরিচয় ঘটেছে, তাঁদেরকে তাঁর বিদ্যাবত্তা ও ধীশক্তির মতো অনুচ্চকণ্ঠ কিন্তু দৃঢ় ও অকপট বাক্​বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও ধারণা দেওয়ার বিশেষ প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। সদ্য প্রয়াত লেখকের এ আত্মজীবনীটিও সে অসংকোচ প্রকাশের পরিচয় বহন করছে।