বাতাস আমার নাম জানে

স্প্যানিশ ঔপন্যাসিক ইসাবেল আলেন্দের নতুন উপন্যাস দ্য উইন্ড নোজ মাই নেম বের হয়েছে এ বছরের ৬ জুন। প্রকাশের পরই উপন্যাসটি সাড়া জাগিয়েছে। কী আছে এই উপন্যাসে?

নিজের বইয়ের সঙ্গে স্প্যানিশ ঔপন্যাসিক ইসাবেল আলেন্দে
ছবি: আল্টা অনলাইনডটকমের সৌজন্যে

চিলির বংশোদ্ভূত স্প্যানিশ ভাষার ঔপন্যাসিক ইসাবেল আলেন্দে তাঁর উপন্যাসে সমকালীন জীবনের কঠিন বাস্তবতা ও নৃশংসতা তুলে ধরতে মূলত বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসের দিকে আলোকপাত করে থাকেন। ইতিহাসের বাস্তবতার আলোকে নজর দেওয়ার চেষ্টা করেন সমস্যার গভীরে। সম্ভবত এ কারণেই তাঁর উপন্যাস একদিকে যেমন বস্তুনিষ্ঠ ও বাস্তববাদী হয়ে ওঠে, অন্যদিকে লেখকের লেখনীর পরশ এতে এনে দেয় এমন এক মায়াবী আবেদন, যা পাঠককে আপ্লুত করে; কখনো বা কাঁদায়। ইসাবেল আলেন্দের লেখার বলিষ্ঠ পরিচয় আমরা পেয়েছি দ্য হাউস অব দ্য স্পিরিট হয়ে বছর দুয়েক আগে প্রকাশিত আ লং পেটাল অব দ্য সি–তে। 

তবে অতি সম্প্রতি তিনি উপস্থিত হয়েছেন কাছের ইতিহাসকে আরও কাছ থেকে দেখে ভিন্ন দুই জগতের ভিন্ন কিছু চরিত্রের অভিন্ন দুর্ভাগ্য পাঠকের সামনে তুলে ধরার প্রয়াসে। তাই পাঠক হিসেবে আমরা পেয়েছি তাঁর আরও এক অসাধারণ উপন্যাস দ্য উইন্ড নোজ মাই নেম। বাংলা অনুবাদে যার অর্থ দাঁড়ায় ‘বাতাস আমার নাম জানে’।

জার্মানিতে হিটলার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নাৎসি প্রশাসন যে তাণ্ডবলীলা শুরু করে, কাব্যিক নামসমৃদ্ধ এই উপন্যাস সেই পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হলেও এর কাহিনি আমাদের নিয়ে যায় একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশকে। এ সময় মধ্য আমেরিকার কয়েকটি দেশে একই রকম তাণ্ডব শুরু করে ওই সব দেশের সামরিক জান্তারা। সেসব সামরিক জান্তার পৈশাচিক দমনের শিকার যাঁরা হয়েছিলেন, সে রকম কয়েকটি চরিত্রের জীবনের করুণ অধ্যায়ের ছবি ফুটে উঠেছে এখানে। পাশাপাশি শতবর্ষজুড়ে বিশ্বের ভিন্ন দুই প্রান্তের মধ্যে ট্র্যাজিক যে যোগসূত্র এর মধ্যেই পরোক্ষভাবে গড়ে উঠেছে, সেই বর্ণনা পড়ে একদিকে আমরা যেমন শোকাহত হই, পাশাপাশি মানুষের দুর্দশা লাঘবের চেষ্টা করে যাওয়া কিছু চরিত্রের নিঃস্বার্থ অবদানও আমাদের আপ্লুত করে।

উপন্যাসের প্রধান চরিত্র একটি নয়, কয়েকটি। তবে এসব চরিত্রের কেন্দ্রে বিরাজমান দুজন হলো স্যামুয়েল অ্যাডলার নামের অস্ট্রিয়ার এক ইহুদি আর আট বছর বয়সী বালিকা আনিতা দিয়াজ। এই দুই চরিত্রকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে আরও কয়েকটি অসাধারণ চরিত্র, যারা গল্পের মুখ্য চরিত্র না হলেও কাহিনির কাঠামোকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছে।

১৯৩৮ সালে স্যামুয়েল অ্যাডলারের বয়স যখন পাঁচ বছর, সে সময় হিটলারের নাৎসি জার্মানি অস্ট্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। এর ঠিক পরপরই জার্মানির অনুকরণে অস্ট্রিয়ার নাৎসিরাও ভিয়েনায় ‘ক্রিস্টাল নাইট’ নামে পরিচিত ইহুদিদের মালিকানাধীন ব্যবসা, দোকান এমনকি বাড়িঘরও ভাঙচুর করার মতো প্রশাসনিক দুর্বৃত্তায়নে নেমে পড়ে। আর তারপরই শুরু হয় ইহুদিদের ধরে ধরে মৃত্যুপুরী হিসেবে পরিচিত কুখ্যাত বন্দিশিবিরগুলোয় পাঠিয়ে দেওয়া।

স্যামুয়েলের পিতা ছিল ভিয়েনার প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক। তাদের পারিবারিক জীবন ছিল সচ্ছল। অল্প বয়সেই স্যামুয়েল স্কুলের গতানুগতিক লেখাপড়ার বাইরে বেহালাবাদনে দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছিল। ফলে অনেকেই সেদিন স্যামুয়েলকে দেখেছিল অসাধারণ পারদর্শিতা দেখানো মেধাবী বালক হিসেবে, যে অস্ট্রিয়ার সমৃদ্ধ ধ্রুপদি সংগীতের জগতে নিজের স্বাক্ষর রাখবে একদিন। কিন্তু স্যামুয়েলের ভাগ্য মন্দ। তাই জীবনে তার তেমন কিছুই ঘটেনি। উপরন্তু মাত্র পাঁচ বছর বয়সে হতে হয়েছে দেশছাড়া।

ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি, ১৯৩০–এর দশকে জার্মানির পাশাপাশি অস্ট্রিয়া ও মধ্য ইউরোপের অন্য যেসব অঞ্চল হিটলারের দখলে ছিল, সেখান থেকে পালিয়ে গেছেন অনেক ইহুদি। তবে অ্যাডলার পরিবার শুরুতে ভিয়েনা ছেড়ে চলে যেতে না চাইলেও ওই ‘ক্রিস্টাল নাইট’ তাদের বাধ্য করেছিল পালানোর পথে পা বাড়াতে। কিন্তু তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। স্যামুয়েলের বাবা রুডলফকে হতে হয়েছে নাৎসি হামলার শিকার। এরপর তার মা পাঁচ বছর বয়সী স্যামুয়েলকে নিয়ে দেশ ছাড়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। কিন্তু সে হাল ছাড়েননি। সন্ধান করেছে ভিন্ন পথের, যাতে নিজে না পারলেও ছেলেটাকে এখান থেকে সরিয়ে দিয়ে নাৎসি হামলা থেকে বাঁচাতে পারে।

এই প্রেক্ষাপটে শিশুদের নিয়ে ইংল্যান্ডের উদ্দেশে যে ‘কিন্ডার রেল’ ভিয়েনা ছেড়েছিল, সেই ট্রেনে করে স্যামুয়েলকে বাইরে পাঠিয়ে দেন সেই সময়ের ভিয়েনার কিছু ব্যক্তি। যদিও দেশ ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে যাওয়া স্যামুয়েলের পরবর্তী জীবন খুব বেশি সুখকর হয়নি।

উপন্যাসের শুরুতে ইসাবেল আলেন্দে দিয়েছেন স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায় থাকা মা–ছেলের এক চমৎকার বর্ণনা, যা পড়লে পাঠকের চোখ জলে ভিজে ওঠে। এই কিন্ডার রেলের ব্যবস্থা যারা করেছিল, তাদের কঠোর নির্দেশ ছিল, শুধু একটি ব্যাগ ছাড়া অন্য আর কিছু যেন বালক-বালিকারা সঙ্গে না নিয়ে যায়। কিন্তু স্যামুয়েল তো তার প্রাণপ্রিয় বেহালাটি রেখে যেতে পারে না। ফলে বাক্সে ভরা বেহালাও সে কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু বিপত্তি দেখা দিল রেলস্টেশনে। পাহারায় থাকা সৈন্যরা যখন বেহালাটি তার সঙ্গে রাখতে অনুমতি দিল না, তখন। অনেক অনুনয়ের পরও সৈন্যদের মন গলাতে ব্যর্থ হয়ে স্যামুয়েল বেহালা বের করে তাতে সুর তুলতে শুরু করলে জনবহুল সেদিনের সেই রেলস্টেশনে নেমে এল নীরবতা। সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকল তার বাদন। এ সময় সেখানে উপস্থিত উদ্যোক্তাদের প্রধান এগিয়ে এসে ঘোষণা দিলেন যে স্যামুয়েল যাবে এবং সঙ্গে যাবে তার বেহালাটিও।

দ্য উইন্ড নোজ মাই নেম–এর প্রচ্ছদ

স্যামুয়েলকে বিদায় জানাতে স্টেশনে সেদিন উপস্থিত ছিল পরিবারের দুই অস্ট্রীয় শুভানুধ্যায়ী, যাদের একজন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত অস্ট্রো-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের সামরিক বাহিনীর কর্নেল থিওবোল্ড ভলকার আর অন্যজন এলাকার ওষুধের দোকানের মালিক পিটার স্টেইনার। এই লোক স্যামুয়েলের বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং দাবা খেলার সঙ্গী। ভলকার যুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য আয়রন ক্রস পদক পেয়েছিল সে। বিদায়ের আগমুহূর্তে সেই পদক স্যামুয়েলের হাতে তুলে দিয়ে লোকটি বলে, কঠিন অবস্থায় পড়লে সে যেন পদকটিতে আলতোভাবে আঙুলের স্পর্শ বুলিয়ে দেয়; এতে ওর মনোবল চাঙা হবে। পরবর্তী জীবনে নানা উথালপাতাল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাওয়া স্যামুয়েল কখনো ওই পদক হাতছাড়া করেনি। একপর্যায়ে শেষ বয়সে পৌঁছে সেটি সে তুলে দিয়েছিল অন্য এক হতভাগা বালিকা আনিতার হাতে। তবে সেই কাহিনি আরও অনেক পরের।

ইংল্যান্ডে শুরুর দিনগুলোয় সুখী পরিবার ছেড়ে আসা একাকী জীবন স্যামুয়েলের জন্য ছিল কষ্টের। তবে ধীরে ধীরে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ খুঁজে পেয়েছিল সে। অর্কেস্ট্রার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি সংগীতের শিক্ষক হিসেবেও কাজ করেছে দীর্ঘ সময়। পরে জ্যাজ সংগীতের আকর্ষণে স্যামুয়েল চলে যায় জ্যাজের প্রাণকেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অর্লিয়েন্সে। সেখানেই শুরু হয় তার জীবনের নতুন এক অধ্যায়।

নিউ অর্লিয়েন্সের স্থায়ী বাসিন্দা নাদিন লে’ব্লাঙ্কের সঙ্গে পরিচয়, প্রেম ও বিয়ে স্যামুয়েলের জীবনে পূর্ণতা নিয়ে এলেও ঝামেলামুক্ত ছিল না সেই পারিবারিক জীবন। একসময় সাফল্যের সোপান বেয়ে স্যামুয়েল যখন পেশাগত জীবনে একটা উচ্চতায় পৌঁছাল, তখন তার বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করতে আসে লাতিসিয়া। সে ছিল এল সালভাদর থেকে আসা অভিবাসী। শৈশবে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত লাতিসিয়া চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে থাকার সময় সামরিক বাহিনী নৃশংস হামলা চালায় তাদের গ্রাম ফারাবুন্দা মার্তিতে। এতে পরিবারের সবাই নিহত হলেও হাসপাতালে থাকার কারণে বেঁচে যায় লাতিসিয়া ও তাঁর বাবা। এ সময় দেশ থেকে পালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় আশ্রয় নেয় তাঁরা। একপর্যায়ে গৃহকর্মী হিসেবে লাতিসিয়া কাজ করে স্যামুয়েলের বাসায়। 

এই কাহিনির পাশাপাশি উপন্যাসটিতে আমরা দেখি, আনিতা দিয়াজ নামের এক বালিকার জীবনের করুণ গল্প, যা স্যামুয়েলের শৈশবের অভিজ্ঞতার সঙ্গে অনেকটাই যেন মিলে যায়। একদিন আশ্রয়ের সন্ধানে মায়ের হাত ধরে আনিতা পাড়ি জমিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে। তবে দক্ষিণ থেকে আসা আশ্রয় গ্রহণকারীদের জন্য তত দিনে বন্ধ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দুয়ার। ফলে যা হওয়ার তা–ই হলো, আনিতাসহ তার মা মারিসোলকে আটকে দেওয়া হলো মেক্সিকোর সীমান্তে।

পরে অবশ্য অভিভাবকহীন অবস্থায় আনিতাকে সাময়িকভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হলেও তার মাকে ফিরে যেতে হয় মেক্সিকোয়। আর সেখান থেকেই দেশে ফিরতে গিয়ে একদিন নিখোঁজ হয়ে যায় মারিসোল।

অনেক পরে বৈধ অনুমোদনপত্র না থাকা প্রবাসীদের জন্য কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রের দুই আইনজীবী আনিতার পক্ষ হয়ে যখন আদালতে ধরনা দেয় এবং মারিসোলের সন্ধান করে, তখনই জানা যায়, কী ঘটেছিল ওই নারীর ভাগ্যে। অবৈধ মানব পাচারকারীদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হয়েছিলেন সে। এদিকে আইনজীবীরা আরও যে তথ্য জানতে পারে, তা হলো স্যামুয়েলের বাড়িতে গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ করা লাতিসিয়া হলো আনিতার নিকটাত্মীয়। ঘটনার এ পর্যায়ে লাতিসিয়ার মাধ্যমে আনিতার থাকার ব্যবস্থা হয় স্যামুয়েলের বাড়িতে। ফলে এত দিন পর অতীতের স্মৃতি জাগিয়ে তোলা এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয় স্যামুয়েল। তবে স্যামুয়েলের আরও অভিভূত হওয়ার অন্য কারণও ছিল; তা হলো, প্রায় অন্ধ হওয়া সত্ত্বেও পিয়ানোবাদনে অনিতার দক্ষতা। এই বালিকার মধ্যে স্যামুয়েল দেখতে পেয়েছিল নিজেরই অতীত। সংগত কারণেই জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে থিওবোল্ড ভলকারের দেওয়া সেই আয়রন ক্রস আনিতার হাতে তুলে দিয়ে স্যামুয়েল বলে সেই একই কথা, যা তাঁকে ভলকার শুনিয়েছিলেন আট দশকের বেশি আগে।

এ রকম এক তিক্ত-মধুর অনুভূতির মিশ্রণে শেষ হয় দ্য উইন্ড নোজ মাই নেম নামের উপন্যাস। গোটা উপন্যাসে চরিত্রগুলোর দুর্ভাগ্যের পরম্পরায় ধ্বনিত হয়েছে মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসার এমন এক বার্তা, যা সবকিছুর পরও এ কথা বলে যে ‘মানুষ মানুষের জন্য’।