ইতিহাসের প্রতি আমার টান ছোটবেলা থেকেই। যদিও পড়াশোনা ছিল বিজ্ঞান বিষয়ে, তবু মানুষের জীবন, শ্রম আর স্মৃতির বৃত্তে বাঁধা ইতিহাসই সব সময় আমাকে বেশি টেনেছে। বিশেষ করে চা-বাগান, তার প্রকৃতির সুষমা, পরিশ্রমী মানুষ আর নীরবে গড়ে ওঠা ঐতিহ্য আমার চিন্তায় আজও গেঁথে আছে।
ডিনস্টন সিমেট্রির স্মৃতি
১৯৭৫ সাল। আমি তখন ডিনস্টন চা-বাগানের খেজুরিছড়ায় ‘ছোট সাহেব’ হিসেবে কর্মরত। এটি ছিল একটি সেন্টার গার্ডেন যেখানে অবস্থিত ব্রিটিশ প্ল্যান্টারদের এক বড় কবরস্থান, ‘ডিনস্টন সিমেট্রি’ নামে পরিচিত। আমার নিয়মিত কাজের পাশাপাশি এই কবরস্থানের রক্ষণাবেক্ষণ করাও ছিল আমার দায়িত্বের অংশ।
অবসর সময়ে প্রায়ই চলে যেতাম সেখানে। একা দাঁড়িয়ে পড়তাম টম্বস্টোনের ইংরেজিতে লেখা এপিটাফগুলো। ধীরে ধীরে অনেকগুলো মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। ভাবতাম, এই বিলাতি সাহেবরা কত দূরদেশ থেকে, স্কটল্যান্ড থেকে এসেছিলেন জীবিকার সন্ধানে। যেমন আজ আমরা বিদেশে যাই ভাগ্য অন্বেষণে, তেমনি তাঁরা এসেছিলেন অনিশ্চিত জীবনের পথে। তখন স্কটল্যান্ডে অর্থনৈতিক মন্দা, যুদ্ধোত্তর সংকট, আহত সৈনিকদের হতাশা, সব মিলিয়ে চা-বাগানই হয়ে উঠেছিল অনেকের শেষ ভরসা। কিন্তু এখানকার জীবন ছিল কঠিন; জঙ্গল, ম্যালেরিয়া, কলেরা আর অজানা রোগে ভরা। অনেকেই মারা গেছেন অল্প বয়সে; কেউ রোগে, কেউ দুর্ঘটনায়, কেউ বা সাপের কামড়ে। পরিণত বয়সে মৃত্যু তখন ছিল বিরল ঘটনা।
একা দাঁড়িয়ে পড়তাম টম্বস্টোনের ইংরেজিতে লেখা এপিটাফগুলো। ধীরে ধীরে অনেকগুলো মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। ভাবতাম, এই বিলাতি সাহেবরা কত দূরদেশ থেকে, স্কটল্যান্ড থেকে এসেছিলেন জীবিকার সন্ধানে। যেমন আজ আমরা বিদেশে যাই ভাগ্য অন্বেষণে, তেমনি তাঁরা এসেছিলেন অনিশ্চিত জীবনের পথে।
এক বছর পর আমার বদলি হয় অন্য বাগানে, আর ডিনস্টন সিমেট্রির সঙ্গে সম্পর্কটা ছিন্ন হয়ে যায়। কখনো পাশ দিয়ে গেলে দূর থেকে একবার তাকিয়ে দেখতাম, কিন্তু ভেতরে ঢোকা হতো না। প্রায় এক দশক পর আবার ডিনস্টনের বড় বাংলোয় দায়িত্ব পেলাম আর শুরু হলো সেই পুরোনো কবরস্থানে নিয়মিত যাওয়া-আসা।
‘টম্বস ইন টি’ বইয়ের সঙ্গে আমার সংযোগ
১৯৯৫ সালে একদল ব্রিটিশ গবেষক সিলেটের চা-বাগান এলাকায় ইউরোপীয় চা-আবাদকারীদের (টি-প্ল্যান্টার) কবরস্থান নিয়ে এক অনন্য গবেষণা শুরু করেন। বইটির নাম রাখা হয় ‘টম্বস ইন টি’। বিষয়টি আমার পুরোনো আগ্রহের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় আমাকে ডিনস্টন সিমেট্রির প্রতিটি কবরের ছবি তোলা এবং সমাধিফলকের লেখা টাইপ করে পাঠানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। সব তথ্য পাঠানো হয় আমাদের ব্রিটিশ কর্মকর্তা জন রেডফোর্ডের কাছে। পরে বইটি প্রকাশিত হলে সেটি হাতে পাওয়া ছিল আমার জীবনের এক বিশেষ মুহূর্ত। আজও সেই বই আমার সংগ্রহে আছে সময় আর স্মৃতির নীরব সাক্ষী হয়ে।
ঔপনিবেশিক যুগে গড়ে ওঠা এসব কবরস্থান শুধু মৃত্যুর স্মারক নয়, বরং সিলেটের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের জীবন্ত অংশ। বইটিতে সিলেটে চা-শিল্পের সূচনা, ইউরোপীয়দের আগমন, তাদের জীবনযাপন, বিশ্বাস ও মৃত্যুর রীতিনীতির পাশাপাশি কবরস্থানের স্থাপত্য ও শিলালিপির বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে।
ছবি, মানচিত্র ও নকশায় সমৃদ্ধ ‘টম্বস ইন টি’ কেবল একটি গবেষণাগ্রন্থ নয়, বরং এক দৃশ্যমান ঐতিহাসিক দলিল যেখানে সিলেটের চা-বাগানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার একসঙ্গে ধরা দিয়েছে। বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য সংরক্ষণের এক মূল্যবান প্রচেষ্টা হিসেবেও বইটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
এক আবেগঘন সফর
১৯৯৮ সালে হঠাৎ গ্লাসগো হেড অফিস থেকে একটি চিঠি এল। এক ষাটোর্ধ্ব ভদ্রলোক বাংলাদেশে আসছেন। জীবনে তিনি খুব কম দেশেই গেছেন, কিন্তু এবারের সফরের উদ্দেশ্য ছিল গভীরভাবে ব্যক্তিগত: চা-বাগানে সমাধিস্থ তাঁর পিতার কবর পরিদর্শন করা ও শ্রদ্ধা নিবেদন।
কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার ভদ্রলোককে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাঁর হাতে ছিল কিছু পুরোনো অ্যালবাম—বাংলো, ফ্যাক্টরি ও চা-বাগানের সাদাকালো ছবি। জানলাম, তাঁর বাবা গিলবার্ট হেনরি টেইট, রাজঘাট চা-বাগানের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার ছিলেন। ১৯৩৭ সালের এক সকালে ফ্যাক্টরিতে যাওয়ার পথে হঠাৎ পড়ে গিয়ে মারা যান; সম্ভবত হার্ট অ্যাটাকে। মৃতদেহ ইংল্যান্ডে নেওয়া সম্ভব হয়নি; সহকর্মীরা তাঁকে সমাধিস্থ করেন ডিনস্টন সিমেট্রিতে।
গিলবার্ট হেনরি টেইটের স্ত্রী ও দুই ছোট সন্তান তখন স্কটল্যান্ডে। স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী আর বিয়ে করেননি। স্বামীর স্মৃতিই হয়ে উঠেছিল তাঁর জীবনের একমাত্র আশ্রয়। মৃত্যুর আগে সন্তানদের তিনি বলেছিলেন, ‘আমার দাহশেষ সেই চা-বাগানের মাটিতে ছড়িয়ে দিয়ো, যেখানে তোমাদের বাবা চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।’
গিলবার্ট হেনরি টেইটের স্ত্রী ও দুই ছোট সন্তান তখন স্কটল্যান্ডে। স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী আর বিয়ে করেননি। স্বামীর স্মৃতিই হয়ে উঠেছিল তাঁর জীবনের একমাত্র আশ্রয়। মৃত্যুর আগে সন্তানদের তিনি বলেছিলেন, ‘আমার দাহশেষ সেই চা-বাগানের মাটিতে ছড়িয়ে দিয়ো, যেখানে তোমাদের বাবা চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।’
বড় ভাই মানসিকভাবে অসুস্থ থাকায় ছোট ভাই নিজেই মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণের দায়িত্ব নেন। গ্লাসগোর হেড অফিসের সহযোগিতায় তিনি মায়ের দাহশেষ নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। বিমানে তাঁর পাশের আসনে ছিলেন এক আমেরিকান যাত্রী, যাচ্ছিলেন ভিয়েতনামে, নিজের নিহত বাবার স্মরণে মায়ের দাহশেষ আকাশে ছড়িয়ে দিতে। পরে টেইট সাহেব আমাকে বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয়েছিল, পৃথিবীতে এমন ঘটনা সত্যিই বিরল, যখন দুই অপরিচিত মানুষ একই বিমানে পাশাপাশি বসে আর দুজনেরই গন্তব্য তাঁদের প্রিয়জনের দাহশেষ পৃথিবীতে মুক্ত করে দেওয়া।’
শেষ অধ্যায়
নির্দিষ্ট দিনে আমরা গেলাম ডিনস্টন সিমেট্রিতে। টেইটকে দেখানো হলো তাঁর পিতার কবর। নীরবে তিনি বললেন, ‘এখানে, আমার বাবার কবরের পায়ের কাছে একটি গর্ত করুন।’
গর্ত তৈরি হলে টেইট মায়ের দাহশেষ সেখানে রেখে মাটি দিয়ে ঢাকলেন। দীর্ঘক্ষণ নীরবে প্রার্থনা করলেন। তারপর অঝোরে কেঁদে ফেললেন, সম্ভবত অনুভব করছিলেন, আজ তিনি চিরবিদায় জানালেন তাঁর মা–বাবাকে, যাঁদের সঙ্গে আর দেখা হবে না কোনো দিন।
বেরিয়ে আসার সময় টেইট মাথার লাল টুপিটি কেয়ারটেকারকে দিয়ে বললেন, ‘আমার মা–বাবাকে দেখবেন।’
বিদায়ের আগে টেইট জেনারেল ম্যানেজারকে একটি ব্রোঞ্জের পাখির মূর্তি উপহার দেন এবং বলেন, এটি যেন প্রতিবছর হেনরি গিলবার্ট টেইট সাহেবের নামে ‘অলরাউন্ড পারফরম্যান্স ট্রফি’ হিসেবে দেওয়া হয়।
বহু বছর পরও শুনেছি, কোম্পানি আজও সেই সিমেট্রিকে যত্নে রক্ষণাবেক্ষণ করে যাচ্ছে। এই নাম না জানা বিদেশিরা শতবর্ষ আগে এসেছিলেন দূরদেশ থেকে। কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে গড়ে তুলেছিলেন চা–বাগানগুলো। কেউই আর ফিরে যেতে পারেননি নিজের মাটিতে। তাঁদের রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার আজও বয়ে নিয়ে চলেছি আমরা।
তাঁদের প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা।