ফরিদ কবির আশির দশকের একজন বিখ্যাত কবি। কখনো উপন্যাস বা গল্প লিখেছেন শুনিনি। এই বছর ২০২৫ সালেই তিনি লিখেছেন একটি বিশালাকৃতির উপন্যাস: নীল মাকখির চোখ। বিগত দিনগুলোতে ফরিদের কবিতার বিষয়গুলো ছিল, প্রেম-সংশয়-জীবনযাপনের জটিলতা। কিন্তু সেখানে খুব দ্রোহ বা সমাজ-বিপর্যয়কে মুখ্য হয়ে উঠতে দেখিনি। আশির দশকের অন্য কবিদের মতোই তাঁর কবিতাযাপনে নাগরিক যন্ত্রণার পরিস্ফুটন দীপ্র হয়েই দেখা দিয়েছিল।
প্রথম উপন্যাসেই তিনি একজন শক্তিমান গল্পকথক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন—এত দিনের জমে থাকা অভিজ্ঞতা, তাঁর পর্যবেক্ষণগুলো ফল্গুধারার মতো প্রকাশিত হয়েছে এ উপন্যাসে।
কিন্তু নীল মাকখির চোখ লিখতে গিয়ে ফরিদ কবির নিজেকে সম্পূর্ণ বদলে ফেলেছেন। প্রথম উপন্যাসেই তিনি একজন শক্তিমান গল্পকথক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন—এত দিনের জমে থাকা অভিজ্ঞতা, তাঁর পর্যবেক্ষণগুলো ফল্গুধারার মতো প্রকাশিত হয়েছে এ উপন্যাসে। আর এখানে ফরিদ শুধু পুরান ঢাকার উন্মাতাল জনজীবনের পর্যবেক্ষকই নন—এই শহরকে তিনি রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণসহ উঠিয়ে এনেছেন তাঁর লেখায়। শহরের অলিগলি অন্তস্থলী আলুবাজার-চকবাজার-ইসলামপুর-আওলাদ হোসেন লেন-লায়ন সিনেমা হল-নয়াবাজার সর্বত্র তিনি নিয়ে গেছেন পাঠককে। উন্মোচন করে দেখাতে চেয়েছেন, এখানে যে মানুষগুলো থাকে তাদের চালচরিত্র কেমন, কোন নেশায় বন্দী হয়ে তারা বহির্বিশ্বের দ্বার বন্ধ করে এক বিনষ্টির মাকড়সার জালে জড়িয়ে আছে। এই উপন্যাসের বর্ণনায় লেখক অনেক সময়ই অন্তরালে থাকেননি, সক্রিয়ভাবে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েছেন—বঙ্কিমচন্দ্রের মতো মাঝেমধ্যে মন্তব্য করতেও দ্বিধা করেননি। যেমন ‘পুরান ঢাকার কোনো বাড়িতে রান্না হচ্ছে কি না, সেটা বুঝতে পারা যায়, যদি দেখা যায়, বাড়ির ছাদে অনেক কাক কা কা রবে চেঁচাচ্ছে।’ অথবা ‘অথচ এই অঞ্চলে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কী অবলীলায় না গালি দিয়ে ফেলে! কে কাকে গালি দিচ্ছে, তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই।’
নীল মাকখির চোখ
ফরিদ কবির
প্রকাশক: অন্যপ্রকাশ
প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২৫
প্রচ্ছদ: আনিসুজ্জামান সোহেল
পৃষ্ঠা: ৩৯৮; মূল্য: ১০০০ টাকা
পুরান ঢাকার পটভূমিতে, সম্ভবত গত শতাব্দীর আশি-নব্বই দশকের সমাজ-সংস্কৃতির পরিবর্তনের স্রোতোধারায় কয়েকটি চরিত্রের জীবনের টানাপোড়েনকে উপজীব্য করে লেখা হয়েছে উপন্যাসটি। স্বভাবতই পুরান ঢাকার ভাষা-শব্দ-স্ল্যাং এমনকি ব্যাকগ্রাউন্ড পরিবেশের শব্দাবলিও ঠাঁই পেয়েছে এখানে।
‘মুস্তাফিজুর রহমান’ নামের দুজন ব্যক্তির জীবনের কাহিনিতে আরও কয়েকটি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিলেমিশে এগিয়ে গিয়ে একপর্যায়ে সংঘাত সৃষ্টি করে। এই সংঘাত পর্যন্ত পৌঁছাতেই উপন্যাসের ব্যাপ্তি শেষ হয়।
এই উপন্যাসে লেখক প্রায় তিরিশটির মতো চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। একই সঙ্গে অনেকগুলো উপকাহিনি সৃষ্টি করে ফরিদ ধৈর্যের সঙ্গে প্রতিটি চরিত্রের নির্দিষ্ট ট্রিটমেন্ট দিয়েছেন—চরিত্র-উপযোগী সংলাপ জুড়ে দিয়ে এদের প্রাণবন্ত করে তুলেছেন। প্রায় প্রতিটি চরিত্রের রয়েছে দুঃখজাগানিয়া আবেগ। কোথাও তা ব্যক্ত, কোথাও অব্যক্ত। মূল কাহিনির চেয়ে কোনো অংশে কম উপভোগ্য নয় এসব পার্শ্বচরিত্রের বিকাশ। পুরান ঢাকার ভাষা-সংস্কৃতি-অর্থনীতির সামগ্রিক পরিচিতি নিয়ে এরা বিকশিত।
পুরান ঢাকাকে তিনি রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণসহ উঠিয়ে এনেছেন তাঁর লেখায়। শহরের অলিগলি অন্তস্থলী আলুবাজার-চকবাজার-ইসলামপুর-আওলাদ হোসেন লেন-লায়ন সিনেমা হল-নয়াবাজার সর্বত্র তিনি নিয়ে গেছেন পাঠককে।
এই উপন্যাসের সঙ্গে বিমল মিত্রের কড়ি দিয়ে কিনলাম কিংবা ডিকেন্সের আ টেল অব টু সিটিস–এর সাযুজ্য রয়েছে। এসব উপন্যাস একটা ভৌগোলিক এলাকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঘটমান সব ‘ট্রেন্ড’ বা ‘সামাজিক প্রবণতা’গুলোকে বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে আরোপ করে। তাই ইতিহাস ভেঙেচুরে এখানে ব্যক্তিকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে। নীল মাকখির চোখ তার ব্যতিক্রম নয়। ফরিদের দ্বিতীয় কৃতিত্ব হচ্ছে, সামাজিক এই প্রবণতাগুলোকে চিহ্নিত করে চরিত্রের মধ্যে অনুপ্রবেশ ঘটানো।
বাংলাদেশের সাহিত্যে এত দিন ঢাকার এই অঞ্চলের অন্তর্নিহিত রূপকথা নিয়ে সার্থক উপন্যাস লেখা হয়নি। ফরিদ সেই পথে এসে অনেকাংশে সার্থকতা অর্জন করেছেন।
উপন্যাসটির পাঠ শেষ করে পাঠক হয়তো আবার ১০৩ পৃষ্ঠায় ফিরে দেখতে চাইবেন। যেখানে নায়ক মুস্তাফিজের একটা স্বগতোক্তি পাঠককে ভাবিত করতে পারে বারবার, হয়তো প্রশ্নও থাকবে এ রকম: আমার শুধু মনে হলো কলেজের সেই শিক্ষক ঠিক কথাই বলেছেন, জন্ম নেবার আগে অপশন থাকলে আমি কিছুতেই পুরান ঢাকায় জন্মাতাম না। এই বাবা-মায়ের ঘরেই কি আমি জন্মাতে চাইতাম? সম্ভবত না।