ভূমিকম্প যে সব সময় সশব্দে জানান দিয়ে আসে, তা নয়। এক মুহূর্তের ভূমিকম্প নীরবে টালমাটাল করে ফেলতে পারে আমাদের চেনা পৃথিবী। অতি সম্প্রতি ঢাকায় হয়ে যাওয়া ভূমিকম্পের কম্পনে সেই অনুভূতিরই আঁচ পেলাম আমরা শহরের মানুষেরা। ব্যস্ত শহরের শুক্রবারের স্বাভাবিক দিনটিকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য থামিয়ে দিল এক আচমকা কাঁপন। তারপর? আবার কি জীবন এগিয়ে যাবে, যেন কিছুই হয়নি, সেভাবে? সত্যিই কি আমরা কেবল এগিয়েই যাই? নাকি মনের কোনো গহিনে লুকিয়ে রাখি সেই ক্ষণিকের অদৃশ্য ভয় আর অনিশ্চয়তার বোধ?
সাহিত্য বহুদিন ধরে এ প্রশ্নগুলোকে অনুসরণ করে আসছে। বারবার তাই সাহিত্যে উঠে এসেছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের বয়ান, মানুষের অসহায়ত্বের গল্প। দুর্যোগগুলোকে অবশ্য কেবল প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট আর বলা যায় না আর আলাদাভাবে। প্রকৃতির ওপর মানুষের যে বাড়াবাড়ি রকমের কর্তৃত্ব, তাতে ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগের জন্য মানুষও একইভাবে দায়ী। এই সব জটিলতাকে অনেক লেখকই অনুসন্ধান করতে চেয়েছেন তাঁদের সাহিত্যের মধ্য দিয়ে। সেই সব বই আর ফিকশন কেবল দুর্যোগকালীন ঘটনার ধারা বর্ণনা হয়ে থাকেনি। দুর্যোগকে ঘিরে মানুষের মনোজাগতিক পরিবর্তন, দীর্ঘ সময়ের ট্রমা আর বৃহত্তর দার্শনিক চিন্তার প্রতিফলন হিসেবেও ধরা দিয়েছে।
তেমনই একটি বই হারুকি মুরাকামির ‘আফটার দ্য কোয়েক’। প্রকৃতির অনির্দেশ্য শক্তির সামনে মানুষ কেমন করে দাঁড়ায়, কতভাবে ভেঙে পড়ে, আর ভেতরে ভেতরে কীভাবে বদলে যায়, এই বই সেসবেরই সূক্ষ্ম অনুসন্ধান। ১৯৯৫ সালের হানশিন ভূমিকম্পের ছায়ায় লেখা ছয়টি গল্প এখানে সরাসরি ট্র্যাজেডির বিবরণ নয়; বরং ভূমিকম্প–পরবর্তী দীর্ঘস্থায়ী মানসিক টানাপোড়েনের কাহিনি। এই বইয়ের গল্পগুলোর বেশির ভাগ চরিত্র সরাসরি ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত কেউ নন। তারা দূর থেকে খবর দেখে, অন্যের কান্নার শব্দ শোনে, আবার তাদের নিজেদের ভেতরেও অস্থিরতা দানা বাঁধতে থাকে। কেউ কেউ নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ টের পায়, তার আশ্রয়স্থলগুলো কতটা ঠুনকো। কেউ আবার নিজের সুখ-দুঃখের হিসাব নতুন করে কষতে থাকে। মাটির নিচের টেকটনিক প্লেটের যে ঘর্ষণ, তার ঢেউ পৌঁছায় মানুষের চিন্তার গহিন অন্দরমহলে, সত্তার গভীরে।
সেই সব বই আর ফিকশন কেবল দুর্যোগকালীন ঘটনার ধারা বর্ণনা হয়ে থাকেনি। দুর্যোগকে ঘিরে মানুষের মনোজাগতিক পরিবর্তন, দীর্ঘ সময়ের ট্রমা আর বৃহত্তর দার্শনিক চিন্তার প্রতিফলন হিসেবেও ধরা দিয়েছে।
বইয়ের কিছু গল্পে আবার আছে জাদুবাস্তবতার ছোঁয়া। বইয়ের বিখ্যাত একটি গল্প ‘সুপার ফ্রগ সেভস টোকিও’–তে যেমন আমরা দেখি এক সাধাসিধে ব্যাংক–কর্মচারী কাতাগিরিকে। ভূমিকম্পের খবর সে টিভিতে শুনেছে, অফিসে সহকর্মীদের আলাপে পেয়েছে, কিন্তু তার নিজের জীবনে তাতে কোনো কিছু বদলায়নি। অথচ একদিন হঠাৎ সে দেখতে পায়, তার ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে এক বিরাট ব্যাঙ—যে দাবি করে, টোকিওর মাটির নিচে এক ভয়ংকর ভূকম্পনের শক্তি জমে আছে, সেটি ঠেকাতে তাকে সাহায্য করতে হবে, লড়াই করতে হবে এক অতিকায় কৃমির সঙ্গে! পাঠকের কাছে ব্যাঙটি বাস্তব কি না, তা স্পষ্ট হয় না, কিন্তু গল্পটি যেন কাহিনির বাইরেও আরও অনেক কিছু বলে ফেলতে চায়। সাদাসিধে কাতাগিরিকে এখানে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয় এক ভয়াবহ অতিকায় দানবের সামনে, যেখানে সাহায্য করা বলতে কেবল চেঁচানো ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না তার। অথচ ব্যাঙটি তাকে বোঝাতে চায়, এই আর্তচিৎকারের সীমাহীন গুরুত্ব সম্পর্কে! হয়তো দুর্যোগের মুখোমুখি হওয়ার অর্থ কেবল নিজের শহরকে বাঁচানো নয়, নিজেদের অস্থিরতাকে মোকাবিলা করাটাও।
দুর্যোগসংক্রান্ত মানসিক বিপর্যয়ের আরেক রূপ আমরা পাই মুরাকামির নন–ফিকশন গ্রন্থ ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’–এ। ১৯৯৫ সালের টোকিও সাবওয়েতে গ্যাস হামলার ভুক্তভোগীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে লেখা এই বইটি ভূমিকম্পের গল্প নয়, তবে মানুষের ভেতরের অসহায়ত্ব, সন্দেহ আর ভয়ের চিত্র একইভাবে ধরা পড়ে এই বইতেও। এই বইতে কোনো ভবন ভাঙেনি, কিন্তু মানুষের ভরসা ভেঙে চৌচির হয়ে গেছে। ফিকশনে আমরা দুর্যোগের যে অন্তর্নিহিত চিত্র খুঁজে পাই জাদুবাস্তবতা আর উপমার মধ্যে, এই নন-ফিকশনে তা ধরা দেয় রূঢ় বাস্তবতা হিসেবে। দুর্যোগ–পরবর্তী সময়ের অস্থিরতার মাঝে ছুটে বেড়িয়ে সংগ্রহ করা নানান বক্তব্য, আলোচনায় সমৃদ্ধ এই বইটি মুরাকামির একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ, সামাজিক স্মৃতিকে নথিবদ্ধ করার কঠোর প্রচেষ্টা হিসেবে বিবেচিত।
জাপানের বাইরেও লেখা হয়েছে ভূমিকম্প নিয়ে বহু বই। নেপালে গোরখা ভূমিকম্প–পরবর্তী সময়ে থিং তামাং কবিতায় দেখিয়েছেন, ঘরবাড়ি ধসে পড়ার ভয় কীভাবে প্রথমে সবার আগে আঘাত করে নারীদের নিরাপত্তাবোধে।
মুরাকামি ছাড়াও সমসাময়িক জাপানি সাহিত্যে ‘দুর্যোগ’ ব্যাপারটি নানাভাবে উঠে এসেছে। ২০১১ সালের ফুকুশিমা পারমাণবিক বিপর্যয়ের পর ইয়োকো তাওয়াদা তাঁর উপন্যাস ‘দ্য এমিসারি’তে দেখিয়েছেন, বিপর্যয় ভবন ভেঙে ফেললেও তার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়ে মানুষের শরীর ও রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপর। বইটি যেন একটা অসুস্থ সমাজব্যবস্থার নিজস্ব দুর্বলতার উন্মোচনের গল্প। অন্যদিকে বানানা ইয়োশিমোতোর উপন্যাস ‘কিচেন’–এ আমরা দেখি সম্পর্কের বিপর্যয়। শোক ও বিচ্ছেদ ধরা পড়ে খুবই ঘরোয়া পরিবেশে। রান্নাঘর, টেবিল বা আলমারির মতো পরিচিত জিনিসও ভেঙে পড়া সম্পর্ক ও স্মৃতির বোঝা নিয়ে হাজির হয় পাঠকের সামনে। ফলে দুর্যোগ সেখানে প্রতিদিনের জীবনযাপনের মধ্যেই টিকে থাকে। সরাসরি দুর্যোগের কথা উল্লেখ না করেও বইটি যেন এক বিপর্যয়ের গল্প।
২০১১ সালের তোহোকু ভূমিকম্প ও সুনামির উল্লেখও আমরা দেখি নানা লেখায়। লরা ইমাই মেসিনার ‘দ্য ফোন বুথ অ্যাট দ্য এজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ লেখা হয়েছে ভূমিকম্প আর সুনামিতে শোকাহত মানুষের শোক নিয়ে বেঁচে থাকার গল্প নিয়ে। লিজা লোউইৎসের ‘আপ ফ্রম দ্য সি’ ধরে রাখে ভূমিকম্পের পর সবকিছু হারিয়ে ফেলা এক টিনএজার তরুণের নতুন করে বাঁচতে চাওয়ার চেষ্টা। ভিন্ন সুরে লেখা ইসোমায়ে জুনইচির নন–ফিকশন ‘লিসেনিং টু দ্য ভয়েসেস অব দ্য ডেড’ আমাদের সামনে তুলে ধরে মৃতদের কণ্ঠস্বরের এক সামাজিক নির্মাণ। সম্প্রতি নোরিকো হোরিয়ের ‘দ্য প্লেস অব সেলস’–এ তোহোকু সুনামিতে মৃত এক বন্ধুর সম্ভাব্য ফিরে আসার গল্প হয়ে ওঠে এক মানবিক বয়ান।
জাপানের বাইরেও লেখা হয়েছে ভূমিকম্প নিয়ে বহু বই। নেপালে ২০১৫ সালের গোরখা ভূমিকম্প–পরবর্তী সময়ে নেপালের কবি বিনা থিং তামাং কবিতায় দেখিয়েছেন, ঘরবাড়ি ধসে পড়ার ভয় কীভাবে প্রথমে সবার আগে আঘাত করে নারীদের নিরাপত্তাবোধে। অন্যদিকে নিউজিল্যান্ডে ২০১১ সালের ক্রাইস্টচার্চ ভূমিকম্প সেখানকার সাহিত্যকেও প্রভাবিত করে। সমসাময়িক স্মৃতিকথার বই ‘উই ক্যান মেক আ লাইফ’–এ চেসি হেনরি লিখেছেন সেসব অভিজ্ঞতার কথা। ক্রাইস্টচার্চ নিয়ে লেখা প্রবন্ধ ও আলোচনাতে নিউজিল্যান্ডের এলিজাবেথ নক্স শহর পুনর্গঠনের অভিজ্ঞতাকে বর্ণনা করেছেন। তাঁর লেখায় স্থাপত্যের পরিবর্তনের পাশাপাশি গুরুত্ব পেয়েছে নিজের শহরের বদলে যাওয়ার মানসিকতার কথা।
ঢাকায় সাম্প্রতিক ভূমিকম্প কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী ছিল। কিন্তু হয়তো আজও কেউ কেউ হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়েছেন, হালকা সন্দেহ নিয়ে তাকিয়েছেন দেয়াল বা সিলিং ফ্যানের দিকে। সাহিত্য হয়তো সেই থমকে যাওয়া ক্ষণিক সময়টুকু ধরে রাখে।