টেলিভিশনে নির্ধারিত শিল্পী আসতে না পারলে আমাকে যেভাবে দাঁড় করিয়ে দিত

আজ ১ জুলাই প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদীর জন্মদিন। তিনি ১৯৪০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর স্মৃতিচারণামূলক বই ‘জীবনের গান’। সে বই থেকে একটা অধ্যায় প্রকাশ করা হলো।

সৈয়দ আব্দুল হাদী

ঢাকায় টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হলো ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর, যা ছিল সবার কাছেই নতুন এক বিস্ময়কর প্রচারমাধ্যম। মনে আছে, প্রেসক্লাবের উল্টো দিকে, ইউএসআইএস-এ টেলিভিশন নামক যন্ত্রটি প্রথম প্রদর্শিত হয়েছিল। মানুষ দীর্ঘ লাইন ধরে ক্যামেরার সামনে দিয়ে এগিয়ে যেত এবং তাত্ক্ষণিকভাবে টেলিভিশনের পর্দায় নিজের ছবি ভেসে উঠতে দেখে বিস্মিত হতো।

সম্ভবত ১৯২৯ সালে ইউরোপে টেলিভিশনের যাত্রা শুরু, আর তার ৩৫ বছর পর এই উপমহাদেশে প্রথম টেলিভিশন সম্প্রচারের কৃতিত্ব আমরাই দাবি করতে পারি এবং তা-ও বাংলা ভাষায়। যদিও সম্প্রচারের সীমানা ছিল খুবই সীমিত (১৮ কিমি) এবং মাত্র আড়াই ঘণ্টা সময়ের জন্য। খুব কম বাড়িতেই টেলিভিশন ছিল, কিনতেও ‘পারমিট’-এর প্রয়োজন হতো।

বিকেল হলেই টেলিভিশন যে বাড়িতে থাকত, সেখানে পাড়া-প্রতিবেশীরাও এসে যোগ দিতেন। নিপ্পন ইলেকট্রিক কোম্পানির তৈরি একটি সেটের দাম ছিল ৮০০ টাকা। সে সময়ের প্রেক্ষাপটে দাম যথেষ্টই বটে, যখন প্রথম শ্রেণির একজন কর্মকর্তার মাসিক বেতন শুরু হতো ৩৫০ টাকায়।

যদ্দুর মনে পড়ে, প্রথম দিকে দিনে একটি দেশি অথবা বিদেশি সিনেমা এবং একটি সরাসরি অনুষ্ঠান প্রচার করা হতো। প্রথম গানের অনুষ্ঠানটিতে গেয়েছিলেন ফেরদৌসী, তারপর কিছুদিনের মধ্যেই আমরাও গাইতে শুরু করলাম। আমার প্রথম গানটি ছিল কবি শামসুর রাহমানের লেখা এবং আনোয়ার উদ্দীন খানের সুর করা ‘বলাকারা যত দূরে যায় উড়ে/ তত দূরে যাবে এই উজ্জ্বল জীবনের গান’। তখন তো সব অনুষ্ঠানই হতো সরাসরি। ভিডিও টেপ রেকর্ডার তখনো আসেনি।

অনুষ্ঠানের দিন অনেকক্ষণ ধরে রিহার্সাল করতে হতো। বিখ্যাত বাদ্যযন্ত্রশিল্পীরা বাজাতেন। সেতার বাজাতেন খুরশীদ খান, বেহালা রাজা হোসেন খান এবং সুবল দত্ত, বাঁশি বাসুদেব এবং শুক্কুর আলী, তবলা বাজাতেন অরুণ, অ্যাকর্ডিয়ান বাজাতেন সুজা উদ্দীন। সবাই খুব যত্ন করে গানের রিহার্সাল করে নিতেন। কারণ, বেতারে সরাসরি অনুষ্ঠানে একে অপরের সঙ্গে নিঃশব্দে যোগাযোগ রাখা যেত কিন্তু টেলিভিশনে ক্যামেরার সামনে তো আর সে সুযোগ থাকত না।

মনে আছে, বেতারে আলী হোসেন নামে একজন বেশ সিনিয়র তবলাবাদক ছিলেন, তাঁর আফিম সেবনের অভ্যাস ছিল। অনুষ্ঠান চলাকালে তিনি মাঝেমধ্যে চোখ বন্ধ করে ঝিমিয়ে পড়তেন এবং সেই সঙ্গে গানের লয়ও ধীরে ধীরে কমে আসত। গাইতে গাইতে তাঁকে একটু ধাক্কা দিলে আবার আগের লয়ে ফিরে আসতেন।

চলচ্চিত্রের গানের অর্কেস্ট্রা দলে একজন ক্লারিওনেটবাদক ছিলেন, তাঁর ছিল গ্যাসট্রিকের সমস্যা। তিনি সঙ্গে একটি ‘সেভেনআপ’-এর বোতল নিয়ে বসতেন। গানের রেকর্ডিং প্রায় শেষ পর্যায়ে, এমন সময় হয়তো সেভেনআপের ক্রিয়ায় বিরাট এক ঢেকুর এসে তাঁর ক্ল্যারিওনেটের ভেতর দিয়ে সশব্দে নির্গত হলো; রেকর্ডিং ‘কাট’ হয়ে গেল এবং আবার প্রথম থেকে শুরু হলো। এমনি নানাবিধ সমস্যার মধ্য দিয়েই সে সময় রেকর্ডিংয়ের কাজ করতে হয়েছে। কারিগরি সীমাবদ্ধতার কারণে সারা রাত ধরে রেকর্ডিং করে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়তেন।

টেলিভিশন সারা দেশের মানুষের জন্যই এক অভিনব অভিজ্ঞতা, যদিও ঢাকার বাইরে তখনো সম্প্রচার সম্প্রসারিত হয়নি। ঢাকার যে কয়টি বাড়িতে টেলিভিশন ছিল, সেখানে পাড়া-প্রতিবেশী তো আসতই, ঢাকার বাইরে থেকেও আত্মীয়স্বজন এ নতুন মাধ্যমটির অভিজ্ঞতা নেওয়ার জন্য চলে আসত। আমারও মনে একটু আগ্রহ সৃষ্টি হলো টেলিভিশনে কাজ করার। চাকরিরও প্রয়োজন ছিল।

প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী কলিম শরাফী ছিলেন তখন প্রোগ্রাম ম্যানেজার। তিনি আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। একদিন চলে গেলাম তদানীন্তন ডিআইটি ভবনে তাঁর কাছে। ডিআইটি ভবনটি তখন পর্যন্ত ঢাকার সর্বোচ্চ ভবন। টেলিভিশন অ্যানটেনা স্থাপনের প্রয়োজনে এই ভবনটিকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল স্টুডিও এবং প্রশাসনিক যাবতীয় কার্যক্রমের জন্য, তা-ও শুধু নিচতলার একটি অংশ। কলিম ভাইকে আমার বাসনার কথা জানালাম। কলিম ভাই খুশি হয়েই বললেন, ‘কাল থেকেই যোগ দিতে পারো। কিছুদিন ফ্লোর ম্যানেজ করো, কাজ শেখো তারপর কন্ট্রাক্ট পাবে।’

তখন অনুষ্ঠান প্রযোজনার দায়িত্বে ছিলেন বেতার থেকে আসা জামান আলী খান, যিনি পরে করাচি টেলিভিশনের প্রধান হয়েছিলেন। ছিলেন মুনিরুল আলম ও শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার। মুস্তাফা মনোয়ার শুধু প্রযোজনা নয়, সেট ডিজাইন থেকে শুরু করে সবকিছুই করতেন। কলিম ভাই তাঁদের বলে দিলেন আমাকে কাজ শেখানোর জন্য। সে সময় শিল্পসংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তি ছাড়া কাউকেই নেওয়া হতো না।

পরের দিনই এসে যোগ দিলাম। কয়েক দিন পর কলিম ভাই ডেকে নিয়ে প্রযোজক হিসেবে নিয়োগের কন্ট্রাকটি দিলেন। শুরু হলো আমার চাকরিজীবনে টেলিভিশন পর্ব। সম্পূর্ণ নতুন একটি মাধ্যমের প্রাথমিক পর্যায়, অতি সীমিত সুযোগ-সুবিধা; একটি মাত্র ছোট স্টুডিও, দুটি ক্যামেরা, একটি কন্ট্রোল প্যানেল, স্বল্পসংখ্যক জনবল, সর্বোপরি অনভিজ্ঞ শিল্পী, কলাকুশলী নিয়ে কত প্রকার যে আকস্মিক সমস্যার সৃষ্টি হতো! স্মৃতির ধূসর পাতা থেকে আপাতহাস্যকর, বিব্রতকর এমন কিছু ঘটনার কথা বলব, যার আকস্মিকতাকে তাত্ক্ষণিক বা উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে কোনো প্রকারে সামলাতে হতো।

আমার পরে প্রযোজক হিসেবে যোগ দিলেন কবি শহীদ কাদরী, যশোর থেকে আসা অভিনেতা নাট্যকার দীন মুহাম্মদ। মোমিনুল হক আগে থেকেই ছিলেন। আমরা চারজনই নিয়মিত সব অনুষ্ঠান প্রযোজনার দায়িত্বে ছিলাম। মন্টু মামা (মুস্তাফা মনোয়ার), মনিরুল আলম ও জামান আলী খান—তাঁরা বিশেষ বিশেষ কিছু অনুষ্ঠান করতেন। মন্টু মামা ছিলেন সব কাজের কাজি, সেট ডিজাইন থেকে শুরু করে সৃজনশীল অনুষ্ঠান পরিকল্পনা, প্রযোজনা—সবই করতেন। তাঁর অবদান ছিল সৃজনশীলতার অভিনবত্বে।

সৈয়দ আব্দুল হাদী
ছবি: প্রথম আলো

শেক্‌সপিয়ারের ‌‘টেমিং দ্য শ্রু’ অবলম্বনে মুখরা রমণী বশীকরণ এবং রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী নাটক নির্মাণ, টেলিভিশন নাটকের ইতিহাসে এক মাইলস্টোন। মাত্র দুটি ক্যামেরা এবং নিতান্ত স্বল্পসংখ্যক কলাকুশলী নিয়ে এ কাজ তিনি কীভাবে করলেন, ভাবলে আজও বিস্মিত হতে হয়। অবশ্য সে সময়ের টিম স্পিরিট, আন্তরিকতা, পরিশ্রম ও মেধার ফলেই তা সম্ভব হয়েছে।

ক্যামেরায় ছিলেন রফিকুল বারী, মুস্তফা, মাহমুদ; সেট ডিজাইনে কেরামত মওলা, এমদাদ ভাই; সাউন্ডে ফ্রান্সিস; এডিটিংয়ে রেজাউল করীম; কারিগরি শাখায় খালেদ সালাউদ্দীনসহ আরও অনেক কলাকুশলী, যাঁদের অনেকেই আজ নেই। তাঁদের সবার আন্তরিকতা এবং অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশে টেলিভিশনের প্রাথমিক ভিত্তিটি নির্মিত হয়েছিল।

যদ্দুর মনে পড়ে, প্রথম দিকে আড়াই ঘণ্টার অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো। সপ্তাহের অনুষ্ঠানসূচিতে থাকত সংগীত, নৃত্য, আলোচনা, সাধারণ জ্ঞান, সাময়িক প্রসঙ্গ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ছাত্রছাত্রীদের অনুষ্ঠান ইত্যাদি। মাঝেমধ্যে নাটকও হতো। এই সব নিয়মিত অনুষ্ঠানের পুরো দায়িত্ব আমাদের এই চার প্রযোজকের ওপরই ছিল।

অনুষ্ঠানের মান সম্পর্কে কলিম ভাই ছিলেন অত্যন্ত আপসহীন। নিয়মিত প্রোগ্রাম মিটিং হতো। কারও অনুষ্ঠানের কোনো ত্রুটিবিচ্যুতি ঘটলে তার জন্য বকাঝকাও খেতে হতো। একবার একটি গানের অনুষ্ঠানে একজন শিল্পীর চেহারার একটি বিশেষ ‘শট’ (যা খুব দৃষ্টিনন্দন ছিল না) চলে যাওয়ার পরদিন কলিম ভাইয়ের বকা খেতে হয়েছিল আমাকে। মোটকথা, দৃশ্য গ্রহণের মূল রীতিনীতিগুলো এবং নান্দনিকতা—সবকিছুই কঠিনভাবে অনুসরণ করতে হতো।

একদিন কলিম ভাই আমাকে ডেকে একজন নতুন শিল্পীকে গানের একটি অনুষ্ঠানে নিতে বললেন। শিল্পীটি মোটামুটি ভালোই গাইতেন, কিন্তু নতুন মাধ্যমে অনভিজ্ঞতার ফলে সম্ভবত খুবই নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি গাইছিলেন সমর দাসের সুরে সে সময়ের বেশ জনপ্রিয় একটি দেশের গান, ‘কুয়াশা কাটিয়ে উদয়ের আলো ভোরের আকাশে জ্বলল’। ভালোই গাইছিলেন, কিন্তু বিপত্তি ঘটল গানের স্থায়ী শেষে। ইন্টারল্যুড বা মধ্যবর্তী সংগীতের পর পরবর্তী অংশ (অন্তরা) কিছুতেই আর ধরতে পারছিলেন না, কণ্ঠে এদিক-সেদিক সুর খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। আমি কন্ট্রোল প্যানেলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায়। সবাই ছুটে এলেন, অনুষ্ঠান তো আর বন্ধ করা যায় না। তখন তো ভিডিও রেকর্ডিং ছিল না যে অন্য কিছু (ফিলার) দিয়ে চালিয়ে নেওয়া যাবে। হঠাৎ করেই বুদ্ধি এল মাথায়, গানটি আমার জানা ছিল বলে রক্ষা। ‘টেলপ ক্যামেরা’য় একটি প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি ধরে, অডিও ফেড আউট করে দৌড়ে স্টুডিওতে ঢুকলাম এবং গায়িকাকে বললাম আমার সঙ্গে অন্তরাটি গাইতে থাকার জন্য। তাঁকে গানটি ধরিয়ে দিয়ে আবার কন্ট্রোল প্যানেলে ফিরে এসে অডিও ফেড ইন করলাম। সে যাত্রা কোনোরকমে রক্ষা পাওয়া গেল।

অনুষ্ঠান শেষে এই নিয়ে বেশ হাস্যরসিকতার সৃষ্টি হয়েছিল এবং পরিস্থিতিটি সামাল দেওয়ার জন্য কলিম ভাইয়ের অনেক প্রশংসাও পেয়েছিলাম। মাঝেমধ্যে হঠাৎ করেই কোনো অনুষ্ঠানের শিল্পী উপস্থিত হতে না পারলে পর্দা তো আর খালি রাখা যেত না। অগত্যা মধুসূদন—আমাকেই পাঞ্জাবি পরে দাঁড়িয়ে পড়তে হতো অথবা খুরশীদ খানকে সেতার নিয়ে বসে পড়তে হতো। বেশ কয়েকটি পাঞ্জাবি আমার টেবিলের ড্রয়ারেই থাকত, অনেক সময় শিল্পীদেরও দিতে হতো। আরও কত যে ঘটনার কথা মনে পড়ে।

একদিন কলিম ভাই আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘দেখো তো, একে কোনো অনুষ্ঠানে নেওয়া যায় কি না, পল্লিগীতি গায়।’ তার চেহারা, বেশভূষা এবং হাবভাব দেখে বেশ মরমি শিল্পী বলেই মনে হচ্ছিল। স্টুডিওতে নিয়ে গিয়ে একখানা গান শোনাতে বললাম। তিনি চোখ বন্ধ করে যে গান ধরলেন, তা সংগীত ব্যাকরণের কোনো সংজ্ঞাতেই শ্রবণযোগ্য মনে হলো না। তাঁকে বললাম, ‘ভাই, আপনাকে দিয়ে এ কাজটি হবে না, আপনি বরং অন্য কিছু চেষ্টা করুন।’ তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে নীরবে বেরিয়ে গেলেন। বুঝলাম আমার ওপর দারুণ রুষ্ট হয়েছেন।

কাজ শেষ করে বাসায় যাচ্ছি, দেখি সেই ব্যক্তি ডিআইটির সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখেই সামনে এসে পথ রোধ করে বললেন, ‘আমি আপনাকে জেলের ভাত খাওয়াব।’ আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘আমার অপরাধ কী, আপনি কী করে আমাকে জেলে দেবেন?’ তিনি রক্তচক্ষু করে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘আমি আত্মহত্যা করব এবং লিখে যাব আপনি আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী।’ আমি প্রমাদ গুনলাম। তাঁর চেহারার ভাষাতে এমন একটা কিছু করে ফেলাও অসম্ভব বলে মনে হলো না। আমি শঙ্কিত হয়ে তাঁর কাঁধে হাত রেখে বললাম, ‘ভাই, এ কাজটি করবেন না, আপনিও মরবেন না আমাকেও মারবেন না। আমি আপনাকে নেব, তবে আপনাকে একটা কাজ করতে হবে, বাড়ি ফিরে যান, আরও দু-চারজনকে নিয়ে একটা দল করুন এবং প্র্যাকটিস করে কিছুদিন পর আসুন।’

কাজ হলো, তিনি চলে গেলেন এবং কয়েক মাস পর বেশ হাসি হাসি মুখ নিয়ে আবার এসে উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘স্যার, এবার শুনুন।’ শুনলাম, এবার মোটামুটি একটা সহনীয় অবস্থায় এসেছে বলে মনে হলো। দলীয় গান হিসেবে একটা অনুষ্ঠানে নিলাম এবং কোনো রকম উতরেও গেল, আমিও বাঁচলাম। সম্ভবত এটাই ছিল টেলিভিশনে প্রথম দলীয় গানের অনুষ্ঠান। অনেকটা আজকের বয়াতিদের অনুষ্ঠানের মতো।

বেশ কিছু দিন পর ঈদের আগে একদিন দেখি সেই লোক আগের মতোই সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছেন, তবে এবার মুখটি খুব হাসি হাসি এবং হাতে একটি বড় প্যাকেট। সামনে এসে হঠাৎ করেই কদমবুসি করে বসলেন। আমি অপ্রস্তুত হয়ে গিয়ে বললাম, ‘একি করছেন!’ তিনি সহাস্যে উত্তর দিলেন, ‘আপনি আমার জীবন বাঁচিয়েছেন।’ হাতের প্যাকেটটি (তখনকার বিখ্যাত স্যুট প্রস্তুতকারক এ ডি পলের) এগিয়ে দিলেন। আমি ভীষণ অপ্রস্তুত অবস্থায় রেগে গিয়ে বললাম, ‘আপনি এখুনি এটা নিয়ে চলে যান, নয়তো কোনো দিন আর এখানে আসতে পারবেন না।’ তিনি মুচকি হেসে বললেন, ‘ঠিক আছে যাচ্ছি। তবে এবারও আপনাকে জেলে যেতে হবে!’

সেই দিনগুলোয় শিল্পী-কলাকুশলীদের নিয়ে এমনি বহু মজার ঘটনা রয়েছে। মনে আছে, নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে কাজ করতে হতো, অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হতো, কিন্তু দিন শেষে ঠিকই একটা তৃপ্তির অনুভূতি নিয়ে ঘরে ফিরেছি। বন্ধু, সহকর্মী, শিল্পী কেরামত মওলা, কবি শহীদ কাদরী, মোমিনুল হক, মুস্তফা, মাহমুদ, অনুষ্ঠান ঘোষক মডি কোহেন—সবাই মিলে কাজের ফাঁকে ফাঁকে আড্ডা হতো। কখনো পুরোনো স্টেডিয়াম চত্বরে, কখনো ডিআইটির লনে। মাঝেমধ্যে দুপুরের খাবারের জন্য সে সময়ের গুলিস্তানের বিখ্যাত রেক্স রেস্তোরাঁয় যাওয়া হতো। শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের আড্ডার জায়গাও ছিল এটি, অনেকটা কলকাতার ‘কফি হাউস’ ধরনের। মাত্র দেড় টাকায় জাম্বু সাইজের কাবাব-পরোটা পাওয়া যেত। অবশ্য সে সময়ের জন্য বেশ দামই বটে।

তখন পর্যন্ত গুলিস্তানই ছিল ঢাকার প্রাণকেন্দ্র। ‘গুলিস্তান’, ‘নাজ’ (শুধু ইংরেজি সিনেমার জন্য) সিনেমা হল, ‘গুলসিতাঁ’, ‘ক্যাসবা’—নামীদামি রেস্তোরাঁও ছিল এখানে। গুলসিতাঁয় দু-একবার গিয়েছি অভিনেতা, বন্ধু সৈয়দ আহসান আলী সিডনি ও নায়ক আজিমের সঙ্গে। ওখানে সুরা পান হতো। আমি চা-কফি খেয়েছি। সেখানে পানরত ব্যক্তিদের হট্টগোল এবং অসংযত কথাবার্তার পরিবেশটি আমার ভালো লাগত না। সুরা পান মোটেই দোষের কিছু নয়; কিন্তু পান করে তা হজম করতে না পারাটাই অবাঞ্ছিত।

মনে আছে, একসময় আমেরিকা দূতাবাস বিভিন্ন উপলক্ষে পার্টির আয়োজন করত। সেখানে সুরাও পরিবেশন করা হতো। মাঝেমধ্যে আমিও নিমন্ত্রণ পেতাম। কিন্তু একসময় আমন্ত্রিত অতিথিদের আকণ্ঠ পান এবং বেসামাল আচরণ দেখে সুরা পরিবেশনের রীতিটি রহিত করা হয়।

গুলিস্তানে আর একটি রেস্তোরাঁ ছিল ‘সেলিমাবাদ’ নামে। ভাত থেকে আরম্ভ করে সবকিছুই পাওয়া যেত বেশ কম দামে। বিশেষ করে সলিমাবাদের শিঙাড়া ছিল অতিবিখ্যাত। নবাবপুর রেলগেটের পাশে ছিল একটি মোগলাই পরোটার দোকান। তখনকার বিখ্যাত বনেদি স্যুট প্রস্তুতকারক ‘এ ডি পল’ এবং ‘বরকতুল্লা’ও ছিল এখানেই। পাশেই পুরোনো স্টেডিয়ামের বিরাট মাঠ। তখন নানা প্রয়োজনে, সিনেমা, আড্ডা ইত্যাদি বিনোদনের জন্য গুলিস্তানই ছিল সবচেয়ে জমজমাট এলাকা। গুলসিতাঁ রেস্তোরাঁর উল্টো দিকে ‘বেবি আইসক্রিম’ নামে একটি আইসক্রিমের বার ছিল, অতি সুস্বাদু আইসক্রিম, তবে বেশ দামি; হারুন নামে একজন অবাঙালি অভিনেতা ছিলেন এর মালিক।

টেলিভিশনে আমার চাকরিকাল খুব দীর্ঘ ছিল না। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে কত বিচিত্র অভিজ্ঞতাই না হয়েছে। সংগীতানুষ্ঠান থেকে শুরু করে সাধারণ জ্ঞানের অনুষ্ঠান, ছাত্রছাত্রীদের জন্য অনুষ্ঠান, এমনকি নাটকও করেছি। মনে আছে, ছাত্রছাত্রীদের অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমিই আবদুল্লাহ আল-মামুনকে (পরবর্তীকালে বিখ্যাত নাট্যকার, অভিনেতা) এনে ‘ড. জেকিল অ্যান্ড মি. হাইড’-এর বাংলা নাট্যরূপ প্রচার করেছিলাম। শিল্পী হাসিনা মমতাজ এবং রওশন আরা মুস্তাফিজকেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এনে আমিই এ অনুষ্ঠানে গান গাইয়েছিলাম। শাহনাজকেও ছোটদের অনুষ্ঠান থেকে বড়দের অনুষ্ঠানে আমিই এনেছিলাম।

শাহনাজের সঙ্গে পরে করিম শাহাবুদ্দীনের সুরে টেলিভিশনে দ্বৈত কণ্ঠে একটি গান গেয়েছিলাম, ‘সাগরের তীর থেকে মিষ্টি কিছু হাওয়া এনে/ তোমার আঁচলে ছোঁয়াব গো’, গানটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। পরে শাহনাজ ‘আঁচলে ছোঁয়াব গো’-এর জায়গায় ‘কপালে ছোঁয়াব গো’ দিয়ে গানটি বেতারে একক কণ্ঠে গেয়েছিলেন। পরে শিল্পী জিনাত রেহানাও এই গানটি গেয়েছিলেন।

নায়ক রাজ্জাকের সঙ্গেও প্রথম পরিচয় টেলিভিশনেই ‘ঘরোয়া’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। উপমহাদেশের বিখ্যাত উচ্চাঙ্গসংগীতশিল্পী ভ্রাতৃদ্বয় ওস্তাদ আমানত আলী, ফতেহ আলীর সঙ্গে এখানেই প্রথম দেখা। একদিন অনুষ্ঠান শেষে আমার ছোট্ট হার্ডবোর্ডের পার্টিশন দেওয়া বসার কক্ষে তিনি এসে বসলেন। অত্যন্ত রসিক লোক ছিলেন। চা খেতে খেতে একটি কৌতুক শোনালেন, সেটি এখানে বলার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। একজন সারেঙ্গিবাদক তার বাড়ির সামনে বারান্দায় বসে নিবিষ্টচিত্তে, মুদিত নেত্রে বাজাচ্ছিলেন। এমন সময় রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পথে এক পথিক অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে বাজনা শুনছিলেন। বাজনা শেষ করে এই শ্রোতাকে দেখতে পেয়ে অত্যন্ত প্রীত হয়ে কেমন লেগেছে জিজ্ঞেস করলেন। সেই শ্রোতা উত্তর দিলেন, ‘আরে ভাই, তুমি কেমন বোকা, ঘোড়ার লেজের লোম দিয়ে লোহার তার কাটার চেষ্টা করছ!’

এ প্রসঙ্গে আরও একটি গল্প মনে পড়ছে, কুমিল্লার বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ খসরু, যিনি একসময় ভারতের বিখ্যাত সংগীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মরিস কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তাঁর কাছে একজন গায়ক প্রায়ই এসে আবদার করতেন, ‘ওস্তাদজি একদিন আপনাকে একটু গান শোনাবার সুযোগ দিন।’ ওস্তাদজি দিচ্ছি, দেব করে তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছিলেন। একসময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে সেই গায়ককে গান গাওয়ার সুযোগ দিলেন এবং বেশ মনোযোগসহকারে তাঁর গান শুনলেন। গায়ক গান শেষ করে অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওস্তাদজি, কেমন লাগল।’ তিনি জবাব দিলেন, ‘বাবাজি, থামলে খুব ভালো লাগে!’ সংগীত নিয়ে এ ধরনের আরও অনেক কৌতুকই রয়েছে, তবে ওস্তাদ খসরুর এ ঘটনাটি নাকি সত্য।