চিত্রনাট্যে মান্টোর ‘মির্জা গালিব’

মির্জা গালিব সিনেমার পোষ্টার

ইতিহাস যেন দুনিয়া ও মানুষের বাস্তবিক সম্পর্কগুলোর ওপর ছেয়ে থাকা এক জালের মতো। সে কারণে ইতিহাসের দিগন্তবিস্তারী জালের গ্রন্থিতে থাকে সাহিত্যের ইতিহাসও। উপমহাদেশের সাহিত্যের ইতিহাসে গালিব ও মান্টো অমোচনীয় দুটি নাম।

ভাষা বা লিখিত রচনার ক্ষেত্রে অপরিহার্যতা সিলসিলা দাবি করে। সাদত হাসান মান্টো এই সিলসিলার চর্চা অব্যাহত রেখেছিলেন মির্জা গালিব নামে চিত্রনাট্য লিখে। মান্টোর জন্ম গালিবের মৃত্যুর ৪২ বছর পরে। পাঠক বুঝবেন, এই সিলসিলা বা পরম্পরার পেছনে কালো পর্দাটা ছিল ঔপনিবেশিক অথবা ইংরেজদের শাসনের। একই সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের অতীতমুখিতার।

মির্জা গালিবের কাল (১৭৯৭-১৮৬৯) ছিল অপ্রতিরোধ্য ভাঙনের। তার ব্যবধান এক যুগ থেকে আরেক যুগের। আর ১৯৪৭ সালে দেশভাগের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশে জাতিরাষ্ট্রের জন্ম হলো। দাঙ্গা ও সংঘাতের সেই সময়ের একনিষ্ঠ গল্পকার সাদত হাসান মান্টো।

মির্জা গালিব সাক্ষী ছিলেন ১৮৫৭ সালের উত্তাল সময়ের। গালিবের দিনপঞ্জি দাস্তাম্বু তুলে ধরেছে ওই সময়ের কথা। অন্যদিকে মান্টো সাতচল্লিশের দাঙ্গা নিয়ে লিখেছেন গা শিউরে ওঠা গল্প।  উপমহাদেশজুড়ে সেই সময়ের অস্থিরতা আর হিংস্রতাকে আত্মস্থ করতে গিয়ে মান্টো বারবার ফিরে গেছেন মির্জা গালিবের কাছে।

গালিবকে নিয়ে চিত্রনাট্য লেখার আগে গালিবের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে মান্টো লিখেছেন পাঁচটি ছোট নাটক। দিন যত গেছে, মান্টো দেখেছেন কেমন করে সাম্প্রদায়িকতা আঁকড়ে ধরছে চারপাশকে। নিজের চেনা পরিচিত মানুষগুলোও ভাগ হয়ে যাচ্ছে সম্প্রদায়ের দাগে। এই বাস্তবতায় গালিবের আশ্রয়ের ঘরে দম নিলেন কাহিনিকার মান্টো। সাধারণের বুঝে ওঠার আগেই চিত্রনাট্যে আঁকলেন বদলে যাওয়া বাস্তবতার ছবি।

মান্টো ছিলেন তাঁর সময়ের সমাজ নিরীক্ষণে অন্যতম সেরা চোখ। সংবেদনশীল তো বটেই। মির্জা গালিব চিত্রনাট্যে তাঁর সুতীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ আর সূক্ষ্ম রসিকতা তুলনাহীন। সাহিত্যের পরিমণ্ডলে কবিতা, গল্প বা উপন্যাস পড়ার তুলনায় চিত্রনাট্যের জনপ্রিয়তা কম মনে হতে পারে। সেটা সম্ভবত এটি সিনেমার জন্য লেখা হয়েছিল বলে। যেনবা সরাসরি পাঠকের জন্য লেখা হয়নি। তবে মির্জা গালিব চিত্রনাট্য পাঠের ক্ষেত্রে এই বাধা নেই। শব্দ, বাক্যের লাইন ধরে আপনি যখন চিত্রনাট্যের দৃশ্যে পৌঁছাবেন, কল্পনার অদৃশ্য পর্দায় দেখতে পাবেন চরিত্রগুলো কীভাবে জীবন্ত হয়ে উঠছে। আপনি নিজেকে সেই দৃশ্যের কোনো এক চরিত্র ভাবতে শুরু করবেন নিজের অজান্তে।

পড়ার মজাটা ঠিক এখানেই। কল্পনার পথে হাতছানি দেওয়া ছাড়া এই মজা এমনি আসে না। পাঠককে ধরে রাখতে মান্টোর কৌশল ছিল নিজস্ব। এর মূলটা প্রোথিত ছিল আসলে মানুষের প্রতি তাঁর অসহনীয় দরদ ও সততায়। এ কথা তো আজ সুবিদিত, উপমহাদেশে মান্টোর মতো তীব্র ও জীবন্ত গল্পকার বিরল। মির্জা গালিব চিত্রনাট্যে মান্টো তাঁর সময়কে বুঝতে চোখ রেখেছিলেন উপমহাদেশের ইতিহাসে। প্রবল প্রতাপশালী মোগল সাম্রাজ্য নাই হয়ে যাচ্ছিল গালিবের চোখের সামনেই। মান্টো এ কথা জানতেন বলেই হয়তো গালিবকে চিত্রনাট্যে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর নিজের কালে। ফলে সোহরাব মোদির মির্জা গালিব সিনেমা সুপারহিট হয়েছিল।

বাংলায় মির্জা গালিব চিত্রনাট্যের অনুবাদ পরম্পরা চর্চার এক নজির। অনুবাদক জাভেদ হুসেনের সযত্ন ও শ্রমসাধ্য অনুবাদে বইটি সমকালীন অনুবাদ সাহিত্যে মূল্যবান একটি সংযোজন। পড়ার সময় মনে হয়েছে মূল রচনা ও অনুবাদ এক বিন্দুতে মিলনের আকাঙ্ক্ষায় গতিশীল। কাজেই আগ্রহী পাঠকের মনে হবে না তিনি কোনো স্থবির বা খটমট চিত্রনাট্য পড়ছেন। মির্জা গালিব সিনেমাটি এখন ইউটিউবে পাওয়া যায়। কেউ চাইলে এ সিনেমা দেখার সময় সংলাপ ধরে ধরে বোঝার জন্য বইটি ব্যবহার করতে পারবেন।

বইটি সুমুদ্রিত। তবে সামান্য কিছু বানানবিভ্রাট আছে। এগুলো এড়িয়ে বইটি পাঠের ভেতর দিয়ে পাঠক পৌঁছে যেতে পারেন মান্টোর বাস্তবতার নাটকীয় এক জগতে।

মির্জা গালিব

সাদত হাসান মান্টো

উর্দু থেকে অনুবাদ: জাভেদ হুসেন

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২৩, প্রচ্ছদ: আরাফাত করিম, ১৬০ পৃষ্ঠা, দাম: ৩২০ টাকা। 

বইটি পাওয়া যাচ্ছে

prothoma.com এবং মানসম্মত বইয়ের দোকানে।