প্রচলিত ট্যাবু ভাঙার উপন্যাস

২ জানুয়ারি ছিল কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের জন্মদিন। প্রথমা প্রকাশন থেকে বের হয়েছে তাঁর উপন্যাস ডাঙায় ডুবোজীবন। ধর্ষণের শিকার এক নারীকে কেন্দ্রে রেখে লেখা এই উপাখ্যানে মানুষের অন্য এক মনোজগৎ আবিষ্কার করেছেন লেখক।

মোহিত কামাল। প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

উপন্যাসটি একটি বিশেষ সময়ের পটভূমিতে কতিপয় বিশেষ ঘটনাকে অবলম্বন করে রচনা করেছেন কথাশিল্পী মোহিত কামাল। পরিচিত জগৎ ও জীবনকে অতিক্রম করে তিনি এক সুদূর মায়ারাজ্যের সন্ধান এনে দিয়েছেন চরিত্রগুলোর চিন্তার জগতে পরিবর্তন ঘটানোর মধ্য দিয়ে। যা বিশেষ মুহূর্ত, বিশেষ কাল, বিশেষ সামাজিক গণ্ডিকে ছাড়িয়ে সাহিত্যের সব কালের, সব যুগের চিরন্তন মানবহৃদয়ের কাহিনিকে প্রতিভাত করে তোলে।

বিভিন্ন সময় নারীরা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ও হচ্ছেন। ভোগ করছেন নিপীড়ন-নির্যাতন। সমাজ তাঁদের যে খুব সহজে গ্রহণ করছে, তা–ও কিন্তু নয়। ‘নারী’ ও ‘নিরাপত্তা’ শব্দ দুটি যেন আমাদের সমাজে ক্রমেই বিপরীতমুখী শব্দ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে; যেন নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি সমাজের কাছে বেশ অপাঙ্​ক্তেয়। নিষ্ঠুর নিয়তি আর মানুষের অজ্ঞতা, হিংস্রতা ও কুসংস্কার আঘাতে আঘাতে তাঁদের করছে রক্তাক্ত। প্রত্যেক নারীকেই বিবেকবর্জিত, পচনশীল সমাজে যুদ্ধ করে বাঁচতে হয়। কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গির সম্পূর্ণ বিপরীত মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক অবস্থান থেকে লেখা হয়েছে উপন্যাসটির আখ্যান। লেখকের চরিত্রগুলো চেয়েছে, এ ধরনের নারীদের যেন আমরা আনন্দের সঙ্গে সমাজে গ্রহণ করি। ধর্ষিত নারীদের নিয়ে সমাজে একটা ট্যাবু প্রচলিত আছে। লেখক সেটা ভাঙতেই ধর্ষণের শিকার চরিত্রটিকে উপস্থাপন করেছেন। মোহিত কামাল তাঁর লেখার প্রচলিত ধরনের বাইরে গিয়ে উপন্যাসটির আখ্যান সাজিয়েছেন। কখনো ফর্ম ভেঙেছেন, কখনো রক্ষাও করেছেন ফর্মের বিন্যাস।

ডাঙায় ডুবোজীবন 

মোহিত কামাল

প্রকাশক : প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা,
প্রচ্ছদ : মাসুক হেলাল, ১২৮ পৃষ্ঠা, 

দাম: ২৭০ টাকা।

বইটি পাওয়া যাচ্ছে

prothoma.com এবং মানসম্মত বইয়ের দোকানে।

লেখক সমাজের যাপিত ঘটনার নীরব সাক্ষ্য বহন করেন এবং জীবনকে দেখেন রূঢ় বাস্তবতায়। তিনি তাঁর সৃষ্টিকর্মে জীবনের বাস্তব দিকগুলোর প্রাধান্য দেন এবং তাঁকে নিপুণভাবে সৃষ্টিশীল কল্পনাশক্তির মাধ্যমে উপস্থাপন করেন, সমাজবাস্তবতার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে তুলে ধরেন। তাঁর দেখানো জীবনের মুখে কোনো মুখোশ নেই। তাঁর শিল্পের জীবন প্রতিদিনের বাস্তবতায় সমৃদ্ধ। কাহিনির ধারাবাহিকতায় কোনো ছন্দপতন নেই, নেই অতি নাটকীয়তা।

কেন্দ্রীয় চরিত্রের মিলনমাধুর্যে উপন্যাসের আনন্দদায়ক পরিসমাপ্তি পাঠকের মনে স্বস্তির বারতা বয়ে আনবে। পাঠক এ উপন্যাস পাঠ শেষে পাবেন এক ভিন্ন ধরনের আলো। ধর্ষণের শিকার এক নারীকে অবহেলার চোখে না দেখে, অপাঙ্​ক্তেয় না ভেবে, তার জীবনে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনা লেখকের সৃষ্ট চরিত্র স্বামীর মূল উদ্দেশ্য ছিল। ফলে বিষয়বস্তু, মূল ভাবনা ও পরিণতিতে সমস্যা সমাধানে ইঙ্গিতের দিকে দৃষ্টি দিলে স্পষ্ট হয় যে উপন্যাসের নামকরণ ডাঙায় ডুবোজীবন শিল্পসফল ও যুক্তিযুক্ত হয়েছে।

উপন্যাসটিতে সমাজবাস্তবতা, অস্তিত্ব রক্ষার্থে মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন ও চারিত্রিক সক্রিয়তা বিদ্যমান। নানা সংকট, ঘাত-প্রতিঘাত নিয়েই এগিয়ে গেছে উপন্যাসের এ আখ্যান। এখানে বিভিন্ন চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলো শৈল্পিকতার আশ্রয়ে নিখুঁতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। শৈল্পিক শব্দ ও সহজ–সরল অনাড়ম্বর বাক্য প্রয়োগে এর চরিত্র চিত্রণে পাঠক হিসেবে মুগ্ধ হয়েছি। লেখক তাঁর সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে আমাদের জীবনের এক নিভৃত গোপনপ্রবাহ আবিষ্কার করেছেন। সেই শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনা উপন্যাসের পরতে পরতে পাঠক খুঁজে পাবেন এবং তাঁদের মনোজগৎ আলোড়িত হবে।