অপরাধবোধে আচ্ছন্ন করে যে উপন্যাস

এটা কি স্রেফ একটা ভালোবাসার উপন্যাস? না অন্য কিছু? বইয়ে প্রবেশ করার আগেই ফ্ল্যাপে এই জরুরি প্রশ্নের মুখোমুখি হন পাঠক। এটি তাঁর জন্য একধরনের প্রস্তুতিও। কারণ, সামনে ২০০ পৃষ্ঠার যে ভ্রমণ রয়েছে, তার সফল সমাপ্তির জন্য এ প্রশ্নের মীমাংসা করা জরুরি। তবে অর্ধেক তুমি অর্ধেক বনলতা সেন শিরোনামে সুমন্ত আসলামের নতুন এই উপন্যাসের শেষ পৃষ্ঠাটিও পড়ে ফেলার পর কতজন পাঠক এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারবেন, আমি নিশ্চিত নই।

কিছু উপন্যাস কেবল পড়ার আনন্দে পড়া যায়। কিছু উপন্যাস অস্বস্তি জাগায়, গূঢ়তর কোনো উপলব্ধির কাঁটা দিয়ে নিরন্তর খোঁচায়। অর্ধেক তুমি অর্ধেক বনলতা সেন শেষ করার পর কাঁটার খোঁচা খাওয়ার সেই অস্বস্তিই হবে পাঠকের। কারণ, তৃপ্তির অনুভূতি নিয়ে বইটি শেষ করতে পারবেন না তিনি। কয়েকটি পাতা আবার উল্টে দেখতে মন চাইবে। কেউ কেউ হয়তো শুরু থেকেই শুরু করতে চাইবেন।

অর্ধেক তুমি অর্ধেক বনলতা সেন

সুমন্ত আসলাম

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২৪, প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরীর ড্রইং অবলম্বনে এরফান উদ্দিন আহমেদ, ২০০ পৃষ্ঠা, দাম: ৪৮০ টাকা।

বইটি পাওয়া যাবে

prothoma.com এবং মানসম্মত বইয়ের দোকানে।

অথচ আপাতদৃষ্টে কোনো জটিলতা নেই বইটিতে। চেতনাপ্রবাহের জটিল বুনন, আবেগের সুড়সুড়ানি কিংবা তত্ত্বের মারপ্যাঁচ কিছুই নেই। আয়ান, নুভা, শ্রেয়া আপু, মিলি ম্যাডাম, সোমা, রাহাত—আমাদেরই চেনা কয়েকটি চরিত্রের জীবনের টুকরো চিত্র। আর পুরোটা না থাকাজুড়ে আছে মৃদুল। সম্ভাবনাময় এই তরুণের অপমৃত্যুই উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহের বাঁধ খুলে দেয়। পাঠক পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ওলটান আর অস্বস্তিতে নখ কামড়ান। কেন এসব নির্মম হত্যাকাণ্ড? সহোদর ভাইয়ের, বোনের, জন্মদাত্রীর, জনকের? কোনো রহস্যোপন্যাস নয় এটি, তবু প্রথম লাইনটি থেকেই রহস্যের কানাগলিতে ঘুরপাক খাবেন পাঠক এবং এগিয়ে যাবেন অনিবার্য এক উপলব্ধির দিকে। তিনি ভাবতে থাকবেন, যা ভাবছি, তা কি সত্যি? এ-ও কি সম্ভব!

পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ওলটাবেন পাঠক। উত্তর খুঁজবেন প্রশ্নের। রাহাত কেন প্রতি রাতে গোরস্তানে যায় মৃত মানুষদের সঙ্গে কথা বলার জন্য? মিলি ম্যাডাম কি আদতেই এক সাধারণ রিকশাচালক? দৃষ্টিহীন চোখে কাকে খুঁজে বেড়ায় শ্রেয়া আপু? বিদ্যাদায়িনী উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের শিক্ষক কাজী বজলুর রশীদই বা কেন ফাইল বগলে নিয়ে এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ায়? উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা মিলবে এমন সব চরিত্রের, বইয়ের শেষ পৃষ্ঠাটি উল্টে ফেলার পরও মাথার মধ্যে ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকবে যারা। প্রশ্ন করবে। ভাবাবে। পড়া শেষে অবাক বিস্ময়ে পাঠক উপলব্ধি করবেন, হেঁট হয়ে আসছে তাঁর মাথা। চারপাশে অন্যায়ের মহোৎসব আর সর্বব্যাপী পাপের যজ্ঞের জন্য আমরা সবাই সমান দায়ী—এই উপলব্ধি অপরাধবোধে আচ্ছন্ন করে তুলবে তাঁর মনকে।

‘আমি চাই এই শহরের, এই দেশের প্রতিটি বাবার অন্তত একটি সন্তানকে মেরে ফেলা হোক, মারা যাক কেউ হঠাৎ একদিন—বিচারকের সন্তান, জেনারেলের সন্তান, মন্ত্রীর সন্তান, পত্রিকার সম্পাদকের সন্তান, জনপ্রিয় লেখকের সন্তান, দাপুটে ব্যবসায়ীর সন্তান, ডাক্তার–ইঞ্জিনিয়ারের সন্তান, সচিব-আমলার সন্তান, বড় মসজিদের ইমামের সন্তান, মন্দির-গির্জার পুরোহিতের সন্তান।’ নুভার এই স্বগতোক্তি সুতীক্ষ্ণ কোনো অস্ত্রের মতো আঘাত করবে পাঠকের অন্তঃকরণে এবং তিনি আবিষ্কার করবেন যে মামুলি কোনো উপন্যাস পড়ে শেষ করেননি তিনি, জীবনের গভীরতম উপলব্ধির দুর্জ্ঞেয় ভুবনে এ ছিল এক আশ্চর্য পরিভ্রমণ!