ইরান কি আসলেই ধাঁধা

ইরানের রাজধানী তেহরানে জনগণের বিক্ষোভ। ১১ ডিসেম্বর ১৯৭৮ছবি: সংগৃহীত

ইতিহাসে ইরান এক ধাঁধা। প্রাচীন পৃথিবীর চারটি অতিকায় সাম্রাজ্যের একটি ছিল ইরান। ৫৫০ খ্রিষ্টপূর্বে সম্রাট সাইরাসের প্রতিষ্ঠা করা এ সাম্রাজ্য একসময় আয়তনে হয়েছিল ৫৫ লাখ বর্গকিলোমিটার। পশ্চিমে বলকান আর মিসর, পশ্চিম এশিয়ায় সাম্রাজ্যের মূল কেন্দ্র, পুরো মধ্য থেকে উত্তর-পূর্ব এশিয়া আর দক্ষিণ-পূর্বে উপমহাদেশের সিন্ধু উপত্যকা। এ সাম্রাজ্য সপ্তম শতাব্দীতে আরবরা জিতে নিল। এ সময় থেকেই পারস্য তথা ইরানের নিজের ধর্ম, ভাষা বদলে গেছে। তৈরি হয়েছে নতুন স্বকীয়তা।

জাভেদ হুসেন

ইরান: খোমেনির ইসলামি বিপ্লব ও তারপর 

বদরুল আলম খান 

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা; প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২৪; প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল; ২০৮ পৃষ্ঠা; দাম: ৫০০ টাকা।

আজকের বিশ্বরাজনীতিতে ইরানের ভূমিকা অহরহই সামনে আসে। পশ্চিমের সঙ্গে তার বিরোধ কেবল আদর্শিক জায়গায় আর নেই। সোভিয়েত-উত্তর পৃথিবীতে রাজনীতির মেরুকরণে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রশ্ন উঠতে পারে, মুসলিম বিশ্বের সবাই কি ইরানের ভূমিকা ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করে? না করলে কেন করে না?

এই সব বিচারে হাজার বছর ধরে ইরানের বিবর্তন নিবিড় পাঠ দাবি করে। এ জন্য বদরুল আলম খানের লেখা ইরান: খোমেনির ইসলামি বিপ্লব ও তারপর বাংলাভাষী পাঠকের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বই বলে বিবেচিত হতে পারে। লেখক নিজে বিপ্লব সম্পন্ন হওয়া দেশগুলোর ইতিহাস নিয়ে গভীরভাবে আগ্রহী। লিখেছেন সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন, চীনের রূপান্তর, সমাজতন্ত্রের সম্ভাবনা ও সংকট নিয়ে। অস্ট্রেলিয়ার ম্যাকোয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় ও সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। পেশাগত দক্ষতা ও বিষয়ের প্রতি নিবিড় আগ্রহের ছাপ তাঁর বইগুলোতে স্পষ্ট। 

শুরুতে লেখক জানাচ্ছেন, ইরানে বিপ্লব ঘটার মতো রাজনৈতিক-সামাজিক পূর্বশর্ত হাজির ছিল না। সেখানে তখন অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছিল। ছিল শক্তিশালী বামপন্থী আন্দোলন। উপস্থিত ছিল রাজতন্ত্র ও স্বৈরাচারবিরোধী জাতীয়তাবাদী এবং অন্যান্য পরিবর্তনকামী দল। এমন পরিস্থিতিতে কেমন করে শিয়াপন্থী ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি একটি গণ-আন্দোলনকে ইসলামি বিপ্লবে রূপ দিলেন, বদরুল আলম অনুসন্ধানের কেন্দ্রে রেখেছেন সেই প্রশ্নকে। তবে তাঁর মুনশিয়ানা হচ্ছে, একেবারে সমকালীন ইরানের রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার মধ্যেও তিনি এই কেন্দ্রীয় প্রশ্নের অনুসন্ধান কার্যকরভাবে জারি রেখেছেন।

ভূমিকায় লেখক সংক্ষেপে তাঁর মূল তাত্ত্বিক প্রস্তাবনা ও ইরানের সাধারণ পরিচয় দিয়েছেন। এ অংশে ইরানের প্রাক্​আধুনিক ইতিহাস কিঞ্চিৎ বিস্তার দাবি করতে পারত বলে মনে হয়। কারণ, কীভাবে আরবভূমির ধর্মীয় চিন্তার আদল থেকে তারা ভিন্ন হয়ে উঠল, তা বর্তমানের ইরানকে বোঝার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিপ্লবের ঠিক আগেও শিয়া ধর্মতন্ত্র একাধিক রাজনৈতিক শক্তির একটি ছিল। চূড়ান্ত বিচারে জনগণ যে তাদের বেছে নিয়েছিল, এর পেছনে একটি ঐতিহাসিক কারণ নিশ্চয়ই আছে।

লেখকের ভাষ্যমতে, ইরানের বিপ্লবের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য খুব তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে ইসলামি বিপ্লবের আগে ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতা ব্যবহার করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের নজির নেই বললেই চলে। লাতিন আমেরিকায় ‘লিবারেশন থিওলজি’র ভূমিকা সহায়ক, কেন্দ্রীয় নয়। শাহের রাজতান্ত্রিক শাসন উৎখাতের আন্দোলনের সময় ইরানে আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ধর্মীয় অংশ ছাড়াও শক্তিশালী ছিল পশ্চিমা গণতন্ত্রের অনুসারী ও নানা বামপন্থী ধারা। কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে ক্ষমতা কেমন করে ধর্মগুরুদের হাতে গেল, তা এক বিপুল বৈচিত্র্যময় ঘটনারাজির কৌতূহলোদ্দীপক পাঠ বটে। তৃতীয় ও চতুর্থ অধ্যায় সে বিষয়ে বিশদ আলোচনা আছে। আছে এই বিপ্লবে ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোর আগ্রহ এবং খোমেনির প্রতি সমর্থন নিয়ে আলোচনা। পশ্চিমা বিশ্বের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে ইরানের ইসলামি বিপ্লবকে তিনি দেখেছিলেন চলমান ইতিহাসের একটি ছেদ হিসেবে। একে তিনি আখ্যা  দিয়েছিলেন ‘প্রথম উত্তর-আধুনিক বিপ্লব’ বলে। পরে নারী, ভিন্নমত নিয়ে সহনশীলতা ইত্যাদি প্রসঙ্গে ইসলামপন্থীদের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে তিনি তাঁর অবস্থান পরিবর্তন করেন। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে একটি প্রবন্ধে (ইংরেজি শিরোনাম ‘হোয়াট ইজ এনলাইটেনমেন্ট’) তিনি বিষয়টি বলে গেছেন।  

ইরানের রাজনীতিতে খোমেনিপন্থীদের একচেটিয়া প্রাধান্য এখন প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু সেখানে গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাধীনতার পক্ষশক্তি একেবারে নির্মূল হয়ে যায়নি। বর্তমান ইরানের রাজনীতি ও ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি বুঝতে হলে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্বও বুঝতে হবে। পঞ্চম অধ্যায়ে রয়েছে সেই আলোচনা। ২০২২ সালে বাধ্যতামূলক হিজাবে ‘গাফিলতি’ করার কারণে মাশা আমিনি নামের এক তরুণী গ্রেপ্তার ও নিহত হওয়ার পর সেখানে বিক্ষোভের ঘটনা, ইরানের কবিতা ও সিনেমা সে দেশের মধ্যে বহু অন্তঃস্রোতের উদাহরণ হতে পারে। সেই সঙ্গে শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে সংস্কার ও উগ্রপন্থীদের দ্বন্দ্ব।

বিপ্লব হলো তীব্র জলোচ্ছ্বাস। বিপ্লবের পর জল থিতিয়ে এলে তাতে পলি পড়ে। বহাল কাঠামো ভেঙে নতুন কাঠামো তৈরি করে মানুষ। আবার ভাঙে সেই কাঠামো। সভ্যতার ইতিহাস এমন ধারার কথা বলে কি? এককথায় এর উত্তর দেওয়া কঠিন।