সরদারের পৃথিবীতে, সরদারের জানালায়

সাম্প্রতিক সময়ে আমার পৃথিবী, আমার প্রিয় মুখ ও আমার জানালা নামে সরদার ফজলুল করিমের তিনটি বই বের করেছে প্রথমা প্রকাশন। এসব বইয়ে রয়েছে তাঁর চিন্তাবিশ্বের খোঁজ। সরদারের ডায়েরি ও অন্যান্য লেখা থেকে বইগুলো কীভাবে তৈরি হলো এবং কী আছে সেখানে, সেই বৃত্তান্ত আছে এ লেখায়।

সরদার ফজলুল করিমছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

সরদার ফজলুল করিম আমার অজানা ছিলেন না। বলতে দ্বিধা নেই, তবে সে জানার পরিধি ছিল বেশ অগভীর।

শীর্ণকায় একটা মানুষ। সমাজতন্ত্রের আদর্শে আস্থাশীল ছিলেন। বিপুল–বিস্তৃত রাজনৈতিক জীবন ছিল তাঁর। বারবার কারারুদ্ধ হয়েছেন। তাঁর লেখা কয়েকটি বই পাঠের অভিজ্ঞতা, বলতে গেলে এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল সেই জানাশোনা। অনেকটা দূর থেকে দেখা—খানিকটা অস্পষ্ট, খুব বিস্তৃত কিছু নয়।

সরদার ফজলুল করিম সম্পর্কে জানার পরিধি বাড়তে শুরু করে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের সংস্পর্শে এসে। তিনি আমাকে সরদার ফজলুল করিম সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলেন।

সরদার ফজলুল করিমের বিপুল কর্মময় জীবনের সঙ্গে পরিচিত হতে থাকি ধীরে ধীরে। জানতে শুরু করি ছোটখাটো মানুষটির চিন্তার বিশালতা, দীর্ঘ সংগ্রামী জীবন। খসে পড়তে থাকে অস্পষ্টতার পর্দা। কীভাবে মানুষটি বরিশালের সেই অজপাড়াগাঁ আটিপাড়ার কৃষিজীবী সমাজ থেকে উঠে এসেছিলেন, কীভাবে দীক্ষা লাভ করেছিলেন সমাজতন্ত্রের, দেখেছিলেন শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন। তাঁর পঠন–পাঠন, জ্ঞানের পরিধি, সামাজিক জীবন, পারিবারিক জীবন, একান্ত ব্যক্তিগত জীবন, তাঁর দার্শনিক অনুসন্ধিৎসু মন, দেশ, সমাজ, রাজনীতি নিয়ে ভাবনা—সবকিছু ঘিরে আগ্রহ বাড়তে থাকে আমার।

বলে রাখা দরকার, মতিউর রহমান সরদার ফজলুল করিমকে নিয়ে কিছু করার একধরনের আন্তরিক তাগিদ অনুভব করতেন সব সময়।

আমরা কাজ শুরু করি। সরদার ফজলুল করিমের রেখে যাওয়া ডায়েরিগুলোই হয়ে ওঠে এ কাজের প্রধান রসদ। বলা যায়, এখান থেকেই শুরু হয় আমার সরদার অনুসন্ধানের দীর্ঘ যাত্রা।

পরিকল্পনা ছিল সরদারের চিন্তার জগৎ সন্ধান করে সেগুলোকে বাছাই করে তুলে আনা, যাতে পাঠক তাঁর ভাবনাগুলো জানতে পারেন সুশৃঙ্খলভাবে। তাঁর চিন্তার প্রধান জায়গা, যেমন দর্শন, সমাজ, রাজনীতি, দেশ, জীবন ও সাহিত্যসম্পর্কিত বিষয়গুলো আলাদা করতে থাকি ডায়েরির পাতা থেকে।

১৯৭৬ থেকে ২০১১ সাল—দীর্ঘ সময় ধরে ডায়েরি লিখেছেন সরদার ফজলুল করিম। তাঁর কন্যা আফসানা করিমের কাছ থেকে ২২টি ডায়েরি আসে আমাদের হাতে। পারিবারিক জীবন, ব্যক্তিজীবন ও তাঁর চারপাশে দৈনন্দিন ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনায় ভরে উঠেছিল এসব ডায়েরির পাতা। তবে এসব লেখার ফাঁকে ফাঁকে জীবন–জগৎ নিয়ে তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও ভাবনা চোখে পড়ে সহজেই। আমরা সেগুলোর ওপর আলো ফেলতে চেয়েছি। অনুসন্ধান করেছি তাঁর চিন্তার বিস্তৃত ক্ষেত্রগুলো।

৮৯ বছরের সুদীর্ঘ জীবন বিশ শতকের পূর্ব বাংলার ইতিহাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত করেছিল সরদার ফজলুল করিমকে। ব্রিটিশ শাসন, পাকিস্তান আমল, বাংলাদেশ—ত্রিকাল প্রত্যক্ষ করেছিলেন এক জীবনে।

সরদার ফজলুল করিম শৈশবেই বেছে নিয়েছিলেন সাম্যবাদের জীবনদর্শন। এই দর্শন বদলে দিয়েছিল সমাজ ও মানুষ সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি। ক্ষুদ্র ব্যক্তিসুখ অপেক্ষা সমাজের বৃহৎ মানুষের মঙ্গল ও মুক্তি হয়ে উঠেছিল তাঁর আরাধ্য।

নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় বন্ধু মোজাম্মেল হকের সংস্পর্শে বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে সরদার ফজলুল করিমের। চল্লিশের দশকে রণেশ দাশগুপ্ত, কিরণ সেনগুপ্ত, মুনীর চৌধুরী প্রমুখ ব্যক্তিদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা প্রগতি লেখক সংঘের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি।

সরদার ফজলুল করিম ১৯৪৫ সালে পার্টির এককথাতেই বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ ত্যাগ করেন। ১৯৪৮ সালে ইস্তফা দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায়। তাঁকে চলে যেতে হয় আত্মগোপনে। শুরু হয় তাঁর আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন।

আমার প্রিয় মুখ

দাম: ২৯০ টাকা।

আমার জানালা

দাম: ৩২০ টাকা।

আমার পৃথিবী

দাম: ৫২০ টাকা।

ঘরে বসে বইগুলো পেতে অর্ডার করুন: prothoma.com

১৯৪৯ সালে ঢাকার তাঁতীবাজারে পার্টির গোপন আস্তানা থেকে সরদার ফজলুল করিমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ঢাকা, সিলেট, রাজশাহী, কুমিল্লা—এক জেল থেকে আরেক জেলে আবর্তিত হতে থাকে তাঁর বন্দিজীবন। জেলে বসেই তিনি বিভিন্ন দাবি আদায়ে সহযোদ্ধাদের নিয়ে অনশন ধর্মঘট করেছেন। পাকিস্তান কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন জেলে থেকেই।

সরদার ফজলুল করিমের চিন্তাজগতের যে অনুসন্ধান আমরা করেছি, তা নিয়ে প্রথমা প্রকাশন সম্প্রতি প্রকাশ করেছে আমার পৃথিবী বইটি। দর্শন, সমাজ, রাজনীতি, দেশ, জীবন ও সাহিত্য—ছয়টি পর্বে বিভক্ত এই বই সামগ্রিকভাবে তাঁর চিন্তার ধরন ও বিস্তৃতি বুঝতে সহায়ক হবে।

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী মার্ক্সীয় দর্শনে আস্থাশীল সরদার ফজলুল করিম দর্শনের আরেক প্রান্ত ভাববাদকে অস্বীকার করেননি। এই দুই আদর্শকে তিনি নিজের মতো করে মেলাতে পেরেছিলেন। আর পেরেছিলেন বলেই তাঁর বিচরণ ছিল মার্ক্স-এঙ্গেলসের জ্ঞানের দুনিয়ায়। অনুবাদ করেছিলেন ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের অ্যান্টি-ডুরিং। আবার প্লেটোর রিপাবলিক, ডায়ালগ ও অ্যারিস্টটলের পলিটিকসও অনূদিত হয়েছিল তাঁরই হাত ধরে। তিনি মনে করতেন, ভাববাদ আর বস্তুবাদের দ্বান্দ্বিকতাই জীবনকে গতিশীল রাখে। মানুষের অস্তিত্ব টিকে থাকে দুটোকে সঙ্গী করেই।

জীবন-মৃত্যুর মধ্যে যে দ্বন্দ্ব চলে কিংবা মৃত্যু আমাদের মুখোমুখি করে যে অতিকায় জিজ্ঞাসার সামনে, সরদার ফজলুল করিমের দার্শনিক মন সন্ধান করেছে এসব সমস্যার সমাধান। তিনি জীবন-মৃত্যুর দ্বন্দ্বকে বুঝতে চেয়েছেন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সূত্রে, রূপান্তরের নিয়মে। জীবনকে দেখেছেন বিশাল ক্যানভাসে, যেখানে মৃত্যু একটি শব্দমাত্র। জীবন-মৃত্যুর দ্বন্দ্বে জয় হয় জীবনেরই। ব্যক্তিমানুষের মৃত্যু হলেও মানুষের মৃত্যু হয় না।

সরদার ফজলুল করিমের কাছে জীবন একমুখী প্রশ্নোত্তরের ব্যাপার নয়। আশা-হতাশা আর ঘাত-প্রতিঘাত নিয়েই জীবন। হতাশাশূন্য নিরেট আশা অর্থহীন। কারণ, একমাত্রিকতার অস্তিত্ব নেই। দর্শন আর জীবন নিয়ে এ রকম আলাপ সহজেই পাঠক পেয়ে যাবেন এই বইয়ে।

সরদার ফজলুল করিমের সমাজ, দেশ ও রাজনীতি মূল্যায়নের যে দৃষ্টিভঙ্গি, তা প্রধানত প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাজাত। দৈনন্দিন যাপিত জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে সমাজের নানা অসংগতি তাঁর মনোজগৎকে ভাবিয়ে তুলেছে। পুঁজিবাদের আগ্রাসন আর যন্ত্রসভ্যতার অমানবিক দিকগুলো তাঁকে করেছে শঙ্কিত। তিনি মনে করেন, সমাজে অসৎ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে ম্যালথাসের তত্ত্বের জ্যামিতিক হারে। সে তুলনায় সৎ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে গাণিতিক হারে। সমাজ চলে যাচ্ছে দুর্বৃত্তদের কবজায়। এসব নিয়ে তিনি লিখেছেন ডায়েরিতে। বুঝতে চেয়েছেন সমাজ ও মানুষের সম্পর্কের সূত্রগুলো। ধরিয়ে দিয়েছেন কোথায় কুঠারাঘাত করা জরুরি। তবু তিনি ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার বাসনা ত্যাগ করেননি। তিনি মনে করেন, বিপুল সম্ভাবনাময় মানুষই হয়তো একদিন সমাজকে, পৃথিবীকে প্রকৃত অর্থে মানুষের করে তুলবে।

সরদার ফজলুল করিম নিজের জীবনের সমান্তরালে বারবার স্বদেশকে উপলব্ধি করতে চেয়েছেন। ফিরে গেছেন দেশের ইতিহাসের কাছে। কথা বলেছেন বর্তমান সমস্যা নিয়ে। সাতচল্লিশের দেশভাগ, পাকিস্তানি শাসন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বারবার উঠে এসেছে তাঁর লেখায়।

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা উন্মেষের ক্ষেত্রে বামপন্থীদের ছিল বিশেষ অবদান। এই সময়ের পুরো ভাগে সরদার ফজলুল করিম রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। আমার পৃথিবী বইয়ে জানা যাবে তাঁর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের নানা কথা। রাজনীতির ক্ষেত্রে চরমপন্থাকে তিনি ইতিবাচকভাবে দেখেননি, ‘যত মত তত পথ’কে গুরুত্ব দিয়েছেন।

সরদার ফজলুল করিম বিভিন্ন সময় নিজের পঠিত বই নিয়ে একান্ত ভাবনাগুলো লিখে রেখেছিলেন ডায়েরিতে। এই বইয়ের ‘সাহিত্য’ অংশে তাঁর একধরনের মূল্যায়ন পাওয়া যাবে।

সরদার ফজলুল করিমের ডায়েরি অনুসন্ধানের সময় নজরে আসে, লেখার ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন ব্যক্তি নিয়ে নিজের অনুভূতি তুলে ধরেছেন তিনি। দীর্ঘ ঘটনাবহুল জীবনে তিনি এমন কিছু মানুষের সংস্পর্শে এসেছিলেন, যাঁরা বিশেষ করে তত্কালীন পূর্ব বাংলার সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সঙ্গে যেমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন, তেমনি এই ভূখণ্ডের মানুষের মুক্তির আন্দোলনে রেখেছিলেন বিশেষ অবদান, যাঁদের তিনি দেখেছেন বা পেয়েছেন ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে সহযোদ্ধা হিসেবে—কারা প্রকোষ্ঠে, দেশের সংকটে, উত্তাল দিনগুলোয়। কিংবা দেশ–কালের গণ্ডি পেরিয়ে যাঁদের আদর্শকে তিনি ধারণ করেছেন নিজেকে সমৃদ্ধ করে তুলতে। সরদার ফজলুল করিমের এসব ব্যক্তিকেন্দ্রিক লেখা নিয়ে এর মধ্যেই প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর আরেকটি বই আমার প্রিয় মুখ।

সম্প্রতি আমার জানালা নামে আরও একটি বই প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। ১৯৯৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রথম আলোয় প্রকাশিত সরদার ফজলুল করিমের ২১টি নির্বাচিত লেখা নিয়ে এই বই। এসব লেখায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের ইতিহাসের নানা দিক, সামাজিক–রাজনৈতিক সমস্যা ও সংকটের কথা।

২০১৪ সালে সরদার ফজলুল করিমের মৃত্যু ঘটলেও তাঁর কাজের মাধ্যমে, তাঁর নির্মিত জগতে আজও তিনি বেঁচে আছেন। সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংকটে আমরা তাঁকে অনুভব করি।